স্নেহের স্পর্শ

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

এই আমি সেই ছোটবেলা থেকেই অঙ্ক বিষয়টা বড় ভয় পেতাম। আমার এই অঙ্কবিদ্যা ভয়ংকরীর কারণেই হাজার চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ, কোথাও কোনো দিন মেধাতালিকার মুখ দেখিনি।

তারপর তা যদি হয় পরিসংখ্যান, হাজারো জটিল সূত্র ও সঙ্গে গাণিতিক যুক্তি। তবে তো অক্কা পাওয়ারই কথা আমার। তাই না? তবে না, এই মার্কিন মুলুকে এসে অঙ্ক নামের খেলার ছক্কাটি কখন যে আমার দিকেই ঘুরেছে, আর ভীতি যে কবে ভালোবাসায় বদলেছে, বুঝতেই পারিনি একদম।

কলেজে আমার অঙ্কের তিনটি ক্লাস দরকার ছিল আমার ডিগ্রিটি শেষ করার জন্য। বছর দুই আগে যখন প্রথম ক্লাসটি পেলাম, অজানা শঙ্কায় কাঁপছিলাম। অঙ্ক? ও মাগো! পারব তো? নাকি আবার সেই রেজাল্ট কার্ডে লাল দাগ? কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া মেধাতালিকার স্বপ্ন?

শিক্ষিকা হিসেবে যাঁকে পেলাম, দেখেই আমার ভয়ডর সব এক নিমেষে উড়ে গেল। এ তো পুতুল একটা। আদুরে, চীনা পুতুল। নামটিও বেশ। নিউ। তো প্রায় সমবয়সী প্রফেসর নিউয়ের মিউ মিউ কণ্ঠের ইংরেজি বোঝা একটু মুশকিল হলেও তিনি অঙ্ক বোঝাতেন খুব সুন্দর। একেবারে ভেস্তে–ভেঙে। আর বোঝানোর ফাঁকে একেকজন ছাত্রছাত্রীর দেশ সম্পর্কে জানতে চাইতেন তিনি। ব্যাংলাডেশের (বাংলাদেশ) গাউনগুলো বেশ সুন্দর। কাজী, তুমি পরতে পারো ওই পোশাক?

বীজগণিতের ফাঁকে এ প্রশ্ন শুনে বেশ বিপদে পড়তাম আমি। বলতে তো আর পারি না, হাতের লাঠি আর পিঠের ব্যাগ সামলে শাড়ি সামলানো যে আমার পক্ষে সম্ভব নয় সোনা। আমি শাড়ি পরতে পারিই না একেবারে।

মুখে বলতাম, ওই গাউনকে শাড়ি বলে। আমার আম্মু পরেন, আমি না। তখনই আবদার, তুমি তো কত সুন্দর স্কার্ফগুলো (ওড়না) পরো। দেশে থাকতেও এমনই পরতে?

জবাবে সত্যি কথাই বলতাম। ওড়না ছাড়া আমি একদম চলতে পারি না। যে পোশাকই হোক, ওড়না আমার চাইই চাই।

এবারে নিউ বেশ মজার একটা খেলা ফেলে দিত আমার সামনে। ধরে নাও, অঙ্কগুলো তোমার ওড়নার নকশা। এবার অঙ্ক দিয়েই ওড়না বানাও।

আমি অঙ্কের সমস্যাগুলোর সমাধান করতাম ওড়না আকারের একটা লম্বা মতো বাক্স এঁকে তার ভেতর। নিউ সেভাবেই দেখতেন আমার খাতা।

যখন সালোয়ার, কামিজ, চুড়ি, কাজলে সেজে ক্লাস করতে যেতাম, কী যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন নিউ! আর সঙ্গে খেলার ছলে শেখানো তো ছিলই। সঙ্গে আবদারও, নাম লিখে দাও, বাংলায়। নতুন কিছু লিখেছ? শোনাও।

মাঝেমধ্যে রেগে যেতাম। বলি, ও মেয়ে, আমায় দেখলেই আবদারের ফুলঝুরি ছোটে কেন তোমার?

এবার টের পেতাম, আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে নিউ। বলছেন, বাকিরা সবাই ছোট, সবে হাইস্কুল পাস করা। একা তোমার কাছে এলেই আমি নিজে ছোট্ট হয়ে যাই। কারণ, একা তুমি আমার বড়। তুমি রাগ করো, কাজী?

দুর্ঘটনায় গোটা পরিবার হারানো নিউ যে স্নেহের কাঙাল, সেটা আমার জানা ছিল। এবার আমিও জড়িয়ে ধরতাম তাঁকে। ওরে, নারে পুতুল, আমি রাগ করি না। আমার ভালো লাগে তোমার আবদার। এখন ভাবি, বাংলাদেশে কোনো প্রফেসরের সঙ্গে যদি এভাবে কথা বলি, না জানি কতগুলো বেত ধেয়ে আসবে আমার দিকে।

এই আদুরে পুতুলের পড়ানোর গুণেই সেবার ১ হাজারে ৭৬০ পেলাম আমি। তখনই টের পেলাম, ভীতি ধীরে ধীরে প্রীতিতে পরিণত হচ্ছে।

অঙ্কের দ্বিতীয় ধাপে যাঁকে পেলাম, তিনি মিসেস বওলস। একেবারে কাকভোরে উঠে নিজেকে সামলে অঙ্ক ক্লাস আমার জন্য সহজ ছিল না মোটেও। তবে মিসেস বওলস আমার কানের কাছে সারাক্ষণ জপতেন—পারবে কাজী, তুমি পারবে। কোন পাগলে বলে তুমি অঙ্ক পার না? আমি আছি তোমার পাশে, যখন খুশি তুমি আমার অফিসে ঢুকে যেয়ো, আমি বোঝাব তোমায়।

অবাক হতাম, বলতাম আমার বারবার অঙ্কে ফেল করার কথা। তিনি বলতেন, তাঁর মেয়েও নাকি আমার বয়সী। বর্ষীয়ান এ ভদ্রমহিলাকে দৃঢ় চরিত্রের বলেই জানতাম। কৌতূহলী আমি একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম তাঁর অফিসে অঙ্ক বুঝতে গিয়ে, কেন তিনি এত আদর করেন আমায়?

জবাবে শ্রাবণঢল দেখেছিলাম ভদ্রমহিলার দুই চোখে। তাঁর একটিমাত্র কন্যা। সে বেশ ভালো ছাত্রী, স্ত্রী, দুটো ফুলের মতো মেয়ের মা। আচমকা মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাঁর কন্যাটি। স্বামী নিজের স্ত্রীর এ দশা দেখে দুই মেয়েসহ স্ত্রীকে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘাড়ে ফেলে দিব্যি অন্য সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছেন।

যেভাবেই পারো, তুমি হাঁটতে পারো কাজী, আমার মেয়ে কিন্তু তাও পারে না। তবু সে কখনোই হার মানে না। তুমি তো দেখি একটা অঙ্ক না পারলেই লেজ গুটিয়ে পালাও।

নাহ্‌, এরপর আর পালাতে পারিনি, বরং আরও বেশি ঢুকে পড়লাম অঙ্কের খেলায়। ফল? এবার আমার ঝুড়িতে ১ হাজারে ৯৭০।

তৃতীয় ধাপে শুধু অঙ্ক নয়, কপালে জুটল পরিসংখ্যান। ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের ফাঁকে আমার চোখ গেল প্রফেসরের কানের দিকে। তার কানে ঝোলানো ছোট্ট ছোট্ট দুটো সাইকেল। আর ঘটনাচক্রে ওই দিন আমাদের অঙ্কটাও সাইকেল নিয়েই ছিল।

মজা পেয়ে নিজের মনেই বলে উঠলাম—বাহ রে দুল, এবার আর হবে না অঙ্ক ভুল!

ভুল না হওয়ার জন্যই তো এমন দুল পরা।

পাল্টা জবাব আশা করিনি। চমকে উঠলাম। আমি দুঃখিত প্রফেসর দোনা।

ধুত্তোরি তোর দুঃখ, আমি তো বেশ মজা পেলাম ছড়া শুনে। পরিসংখ্যান দিয়ে এমন কিছু ছড়া বানাও তো দেখি।

আমি বানাতাম এমন অনেক ছড়া। কঠিন সূত্রকে ছড়ায় বেঁধে নিলে সহজ হয়ে যায়। হয়েও যেত। ক্লাসের পরে সপ্তাহে এক দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত অঙ্ক করতাম আমি তাঁর অফিসে বসে।

সেদিনের পর থেকে ইচ্ছা করেই তাঁর কানের দিকে তাকাতাম প্রতিদিন। সেখানে কখনো তির, কখনো পেনসিল, আরও কত কিছু! এক দিন যদি কান না দেখতাম, চাপা মন্তব্য শুনতে পেতাম—আজ নতুন দুল পরলাম আর আজই কাজী কিচ্ছু বলে না, ধুর!

একদিন নিজের জন্য ব্যাগে ফল ভরতে গিয়ে মনে হলো যেন রুপালি কোঁকড়া চুলে ভরা দোনার হাসিমুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। বাড়তি একটা ফল ভরে নিলাম।

সেদিন দুই হাতের তালুতে দুটি আপেল নিয়ে বাড়িয়ে ধরেছিলাম সুযোগ বুঝে। এই যে মহিলা, ধরো, একটা তোমার আর একটা আমার।

প্রফেসর দোনা উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধলেন আমায়। আমি যে আজ সকালে কিছুই খাওয়ার সুযোগ পাইনি, সেটা কোনো ছোট্ট পাখি গিয়ে বলে এসেছে নাকি তোমাকে?

স্নেহের ভাষা আমি ভালোই বুঝি হয়তো। তারপর থেকে প্রতি ক্লাসেই দুটি ফল নিয়ে যেতাম। এমনিতে খাবার ভাগ করে খেতেই বেশি ভালো লাগে আমার। উপরি পাওনা হিসেবে ওই আলিঙ্গন তো ছিলই।

প্রশ্নপত্রের প্রশ্নের সঙ্গেই কথা বলতাম আমি। অঙ্ক হয়তো কোমল পানীয়তে কর বসানো নিয়ে। আমি সমাধানের পাশে কালো কালিতে লিখলাম, বসাও কর। অনেক রোগবালাই কমে যাবে।

ফিরতি খাতায় কালোর পাশে সবুজ জবাব—তোমার আবার রক্তে চিনি নেই তো, কাজী?

কখনো হয়তো লিখতাম, ভুলে গেছি যে! প্রফেসর আমার ভুল অঙ্ক ঠিক করতেন না, সবুজ কালিতে পাশে লিখতেন—এসে জেনে যেয়ো। আমি হাসতে হাসতেই ঢুকে যেতাম অফিসঘরে।

এক হাজারে এবারও ৯০০-এর ওপরে পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ৮৮০–তে থেমেছে যাত্রা।

শিক্ষিকা, শব্দটির পাশে শ্রদ্ধার অবস্থান অবধারিত। সেই শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালোবাসার মিশ্রণ যদি ঘটে, তবে কঠিন বিষয়ও জলবৎ তরলং হয়ে যায়। এই তিনজন নারীকে আমি কেবল শ্রদ্ধা করতাম, তা–ই নয়, ভীষণভাবে ভালোবাসতাম। তাঁদের ছোট ছোট স্নেহস্পর্শই প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত করত আমায়। তাই আজ ওই ভয়ংকরী বিদ্যা অঙ্ক আমার কাছে ভীষণ মজার এক খেলার নাম।