প্রবাসীর চিঠি: দুঃখের সংক্রান্তি ভোগ

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

তুমি কেমন আছ দেশ? আমি ভালো আছি। এখানে প্রতিটা মুহূর্ত ভালো থাকতে হয়।

আমি চিঠি লিখলাম সে জন্য ভেব না, এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটা আমার একান্ত পাগলামি। আমি বিশ্বাস করি, চিঠি কথা বলতে পারে। জীবনের কথা, ভালো লাগার কথা, ভালোবাসার কথা, মা–বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের কথা। এমনকি আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কথা। আবার কখনো কখনো চিঠির একটি ভাষা থামিয়ে দিতে পারে অনেক ঘটনা।

আমার তো প্রতিটা মুহূর্ত ভালো থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রাম নিজ জীবনের সঙ্গে বাস্তবতার। অসুস্থ হয়ে পড়লে আপন ভেবে সেবাশুশ্রূষা দেওয়ার কেউ নেই। নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে হয়। আমরা যারা একসঙ্গে থাকি, সবাই আমার মতো কর্মব্যস্ত।

এখানে এখন অনেক রাত। এ সময় তোমার কোলে সবাই গভীর ঘুমে বিভোর। আমি রাত জেগে আবোলতাবোল কী যেন ভাবি। সেই ভাবনা থেকেই তো এই চিঠি লেখা। তাই বলে ভেব না, আমি ঘুম ভেঙে সব সময় ছাইপাঁশ ভাবনা ভাবি। রাত জাগা আর ঘুম ভাঙা এক রকম নয়। জগতের চিন্তামুক্ত ও সুখী মানুষেরা ঘুমে বিভোর থাকে। তাই তো তাদের ঘুম ভাঙে। আর যারা আমার মতো পরবাসী, তাদের কাছে রাত জাগা আর ঘুম ভাঙার ব্যবধান অনেক বেশি দেশ।

এখন তো আমার নাম ধরে আমার মাকে কেউ আর ডাকে না। অমুকের মা বাড়িতে আছ? কেমন আছ? জানি এখন আমার মাকে ডাকে সব সময় তার পাশে থাকা অন্য সন্তানের নাম ধরে। ডাকুক, তাতে কী? যে পাশে থাকে তাকেই তো মানুষে চেনে। আমাকে মানুষ চিনবেই বা কেমন করে। ভিনদেশি কলঙ্ক গায়ে মেখেছি। এখন আমাকে কারওর আর না চেনারই কথা। পৃথিবীর জন্য হয়তো আমি অতি ক্ষুদ্র কীট। কিন্তু একটি পরিবারের জন্য অনেক কিছু। সময়মতো আহারের জোগান দাও। বায়না মিটিয়ে মুখের গঠনে সুখের হাসি ফুটিয়ে তোল। এটা কিন্তু কম ঝামেলা নয়।

বলতে পার দায়িত্বের সব বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হয়। সেই যে চলছি তো চলছি। এর কোনো বিরতি নেই। মাঝেমধ্যে বাবা রেগে গিয়ে বলতেন, ও একটা গাধা। পরিবারের বোঝা যে বইতে পারে সেই তো গাধা। সত্যিই দেশ, আমি আজ বড় গাধা। উপলব্ধিহীন পরবাসী গাধা।

এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি জানি, মায়ের কাছে সব সন্তান একই। তারপরও আমার কেন জানি মনে হয়, আমি তার প্রকৃত সন্তান হতে পারিনি। জীবিকার অন্বেষণে অভিবাসীর নৌকায় ভাসছি তো ভাসছি। কোথায় যে এর কিনারা, তা–ও জানি না।

আমি তখন সুখী হই, যখন মাস শেষে উপার্জিত অর্থ প্রিয়জনদের কাছে পাঠিয়ে দিই। আর সেই অর্থ হাতে পেয়ে তারা তাদের দৈনন্দিন দরকারি কাজে ব্যয় করতে পেরে আনন্দিত হয়। জানি, এই সামান্য অর্থ বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন কিছুই নয়। তারপরও সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু তার বেশি অসম্ভব হয়ে যায়। সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে কোনো কিছু নয়, এ কথা সবারই জানা। অথচ এই কথাটি কখনো প্রিয়জনদের বিশ্বাস করাতে পারলাম না!

মাঝেমধ্যে মনে হয়, সত্যি আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। অভিযোগের ঘানি টানায় আমি খুব কাঁচা। প্রিয়জনদের কীভাবে বোঝাই, অভিযোগের ঘানি টানা যে কতটা যন্ত্রণার। এ যন্ত্রণা শুধু ভুক্তভোগীই জানে, দেশ।

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

হয়তো প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে আমাকে খুব বেশি মনে করে আমার প্রিয়জনেরা। আর মনে করবেই না কেন? নতুন নতুন বায়না মেটাতে কে বা পারে। আমি জানি, আমার কাছে ছাড়া তারা কার কাছে বায়না করবে। আমি পরবাসে আয় করি টাকা। সে টাকায় তাদের সংসার চলে। শীতের পোশাক কিনতে পারে। দুধওয়ালার পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারে। পুরোনো চশমার কাচ পরিবর্তন করতে পারে। আবার নিজেদের খাবার থেকে অবশিষ্ট কিছু খাবার দুস্থ ব্যক্তিদের দান করার চিন্তাও করে। এ কথা আমি জানি, দেশ। কিন্তু তুমি বলতে পার দেশ, ভাগ্য পরিবর্তনের বন্ধ তালা খোলা কেন এত কঠিন?

কতটা রোদ-বৃষ্টি মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় এই টাকা আয় করতে, সে খবর কজন আর রাখে। দিন শেষে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে বাসায় আসার পর নিজ হাতে যত কিছু রান্না করে খাই, ক্ষুধার্ত পেটে তাই মনে হয় অমৃত। এতে আমার কোনো কষ্ট নেই, দেশ। কষ্ট যারা পুষে রাখে তারা বড় নয়। একটা পরিবারের বোঝা যে বইতে পারে, সেই তো বড়। মাঝেমধ্যে নিজের সঙ্গে নিজে অট্টহাসি হাসতে হাসতে বলে উঠি, আমিই বড়, আমিই বড়!

আমার জন্য বাবা মাকে কতবার যে গালমন্দ করতেন? বাবা বলতেন, ‘খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করবি না। খেলাধুলা করবি না।’ তুমি বল মা, তখন আমি কি বুঝতাম কে ভালো কে খারাপ। সবাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। সবাই আমার বন্ধু। যতটা ভেদাভেদ সব এখন না হয় বুঝতে পারি। কিন্তু সময় যে পেছনে ফেলে দিয়েছে এক পৃথিবী হিসাবনিকাশ।

একদিন নদীতে গোসল করার পর চোখ লাল করে বাড়িতে এসেছিলাম। আমার সেই লাল চোখের অবস্থা দেখে বাবা নারকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে আমাকে কী মারটা না দিয়েছিল। বাবার সেই মার আর চোখ রাঙানো শাসনের কথা খুব মনে পড়ে। আজ শাসন করে মানুষ কত কিছুই না করছে। সত্যকে মিথ্যা বলছে। প্রতিবেশীর অর্থসম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে। নির্দোষ মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করছে। পৃথিবীর অনেক কিছু এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে, দেশ।

বাবার প্রতি আজ আমার কোনো ক্ষোভ নেই। পরিশ্রম করতে করতে আর অভিযোগের ঘানি টানতে টানতে আমার আপন পৃথিবীতে রাগ বলতে কিছুই নেই। যারা রাগ করে, তারা সহজে পরাজিত হয়। আমি সহজে পরাজিত হওয়ার মানুষ নই। প্রতিদিন কষ্টকে পরাজিত করে আমি হই জয়ী।

আমার শরীরের ঘামের গন্ধ বিলাসী সমাজে খুবই বেমানান, আমি তা–ও বুঝি। কিন্তু কী করব, দেশ! প্রিয়জনদের মুখে আহার তুলতে আমার শরীর থেকে রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে যায়। কী অদ্ভুত এই বিলাসী সমাজ। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরলে চিৎকার দিয়ে সেবা দেওয়ার জন্য কত মানুষ এগিয়ে আসে। কিন্তু প্রবাসীরা সেখানে নাকি বেমানান। তাদের শরীরে ঘামের গন্ধ। অথচ তারা ভুলে যায় প্রবাসীর টাকায় সমাজ সচল হয়। দেশ তুমি বল? তুমি সচল হওনি?

আজ আমার মতো পরিশ্রমী প্রবাসীর শরীর থেকে, রক্তের রং পরিবর্তনে সাদা হয়ে ঝরে যে জল, তার নাম ঘাম। দুর্গন্ধ। এই দুর্গন্ধ শরীরের কাছে কেউ এগিয়ে আসে না। কিন্তু আমি কীভাবে এই পরিচয় মুছি। এটা তো একজন প্রবাসীর পরিচয়পত্র। এই বড় পরিচয়পত্র দিয়েই তো প্রিয়জনদের মুখে আহার তুলে দিতে পারি। সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের চাহিদা মেটাতে পারি।

দেশ, এ দেশে ক্যানটিনের খাবারের মূল্য অনেক। রেস্টুরেন্টে বাহারি রকমের খাবার দোকানিরা বিক্রি করে। রোজ রোজ ডিউটির শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করে খেতে আর ভালো লাগে না। খাবার দেখে মনে হয় ক্যানটিন থেকে কিনে খাই। কিন্তু মন চাইলেও খেতে পারি না। নিজে রান্না করে খাওয়াতে কিছুটা খরচ বাঁচে। তাই রান্না করে খাই। মন চাইলেও প্রিয়জনদের কথা ভেবে মনের দরজায় শিকল দিয়ে রাখি। বাহারি খাবার না খেয়েও পৃথিবীতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের দিন কেটে যাচ্ছে। আমি তো আর তাদের বাইরের কেউ নই।

ভাবতে পার দেশ, পৃথিবীর সেই সব ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কথা? আমি বুঝি ক্ষুধার কী জ্বালা। যখন ডিউটি শেষে বাসায় আসি তখন পেটের ক্ষুধার জ্বালায় কবি সুকান্তকে ডেকে বলতে ইচ্ছা করে, পূর্ণিমা চাঁদ আমাকে দাও। আমি রুটি ভেবে খেয়ে নিই। তখন খাদ্যবঞ্চিত মানুষের কথা ভেবে আমার দুই চোখের নদীতে বান নেমে আসে। তবু সেসব খাদ্যবঞ্চিত মানুষের থেকে বহুগুণে ভালো আছি, দেশ। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করছি। প্রিয়জনদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার পর দৈনন্দিন কাজেও মাঝেমধ্যে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারছি।

এ দেশের নিয়ম। এসব নিয়ম মেনে নিয়েই, তবু পরবাসে ভালো আছি। বেঁচে আছি। নিজে বেঁচে অন্যকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছি। মাঝেমধ্যে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যখন তোমার বুকে থাকা উচ্চাভিলাষী সোসাইটির মানুষ, পরবাসে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে মূর্খ বলে গালমন্দ করে।

এটা আমার পরিশ্রমী শরীর। বলে বলুক লোকে তবু তাতে কিছু যায় বা আসে না। তুমি বিশ্বাস করো দেশ, আমি পরবাসে নিজের রক্ত দিয়ে রোজ ভাগ্য করি কেনাবেচা।

লেখক
লেখক

দেশ, প্রতিবছরই তো ভাবি এই পরবাসের শিকল ভেঙে চলে আসব তোমার বুকে, কিন্তু পারি না। কেন যে পারি না, তা–ও জানি না। যেভাবেই হোক একদিন সত্যিই তোমার কাছে ফিরে আসব। পৃথিবীর ঘূর্ণনের আবর্তনে কে জীবিত আর কে মৃত, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে ফিরে আসা। ভাগ্যকে সাক্ষী রেখে বিধাতার কাছে অনুমতি চেয়েছি। অনুমতি পেলেই তোমার কাছে ফিরে আসব।

প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতাহীন একটি দ্বীপের মধ্যে পড়ে আছি। এখানে প্রতিটা মানুষ নিজস্ব ব্যক্তিস্বাধীনতায় জীবনযাপন করে যাচ্ছে। কারও হাতে মন খুলে কথা বলার মতো সময় নেই। ইস্পাতের মতো কঠিন একটি শহর। এই শহরে পরবাসী পাখিগুলো প্রতিনিয়ত সুখ খুঁজে বেড়ায়।

এই পরবাসের বন্দী শিকলে আটকা পড়ে, আপনজনের মৃত্যুসংবাদ শুনে ক্ষোভ–যন্ত্রণায় দুই চোখটা সমুদ্র বানিয়েছি। শেষ দেখার সৌভাগ্যটুকুও হয়নি। এই পরবাসে দুঃখের সংক্রান্তি ভোগ করতে করতে সুখগুলো হয়ে যাচ্ছে পাথরচাপা সাদা ঘাসের মতো। আমি চলে আসব দেশ। আপাতত তোমার বুকে রেখে আসা আমার প্রিয়জনদের বেঁচে থাকার ঠাঁই দিও। মাকে বলে দিও তার পাশে যে সন্তান তার ওপর আস্থা রাখতে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। সুখে-দুঃখে প্রতিবেশীই তো তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

দেশ, রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। সকালে আবার সেই পরবাসে মেনে নেওয়া কর্মব্যস্ত জীবন। ঘামে ভেজা শার্ট। রোদ-বৃষ্টি সবই আমার আজ আপন হয়ে গেছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাকে ওষুধ খেতে বলবে। চশমার কাচ পরিবর্তন করে নিতে বলবে। চলতে চলতে সবকিছুই একটা সময় পুরোনো হয়ে যায়। অচল হয়ে যায়। ধুলো জমে যায়। আমার জীবনে ধুলো কি আর কম জমেছে? জমে জমুক ধুলো, দেখি এর শেষ কোথায়! তোমার বুকে রেখে আসা আমার প্রিয়জনদের বাঁচার মতো বাঁচিয়ে রেখ। আমি ভালো আছি দেশ।