ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘শুভ জন্মদিন, মামণি...’। ঘুমন্ত মেয়ের কপালে ছোট্ট চুমু এঁকে শুভেচ্ছা জানালেন শামস।

ঘ্রা–উ–উ–উ! সোনালি লেজ নেড়ে টফিও শুভেচ্ছা জানাল তার মানুষ মাকে।

পাপার আদর পাওয়ার লোভেই যে কৃষ্ণা ঘুম ভাঙার পরেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল সেটা শামস ভালোই জানতেন। নয়তো সকাল আটটার পর কৃষ্ণাকে বিছানায় রাখা কঠিন। যদি সে অতিরিক্ত অসুস্থ না হয়।

শামস উঠতে গিয়ে দেখেন, দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরেছে মেয়ে।

‘পাপা অফিস যাবে না আজ।’ শুভর কণ্ঠ নকল করে বলে ওঠে কৃষ্ণা।

মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে গিয়ে শামস টের পেলেন, কৃষ্ণার গায়ে বেশ জ্বর। টিউমার অপারেশনের পর কৃষ্ণা আর ঘনঘন অসুস্থ হয় না ঠিক, তবে শামস জানেন, এ মেয়ের সহ্যশক্তি অতটা বেশি নয়। হালকা সর্দিজ্বরেও কাবু কৃষ্ণা।

শামসের মন বলছিল আজ মেয়ের জন্মদিনটা ওর সঙ্গেই থাকবেন। তবে ওদিকে ব্যাংক এমন একটা জায়গা, যেখানে হুট করে ছুটি চাওয়াও যায় না। অতএব নিজের সবচেয়ে ভালো বান্ধবীই ভরসা। হাঁক ছাড়েন শামস, ‘কোথায় গেলে গো, ও প্রীতিলতা?’

স্বামীর এমন কণ্ঠস্বর চেনেন লাইলি। মন আর মস্তিষ্ক, দুটো মিলিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেন শামস। এ মুহূর্তে হয়তো দুটোকে কোনো কারণে মেলাতে পারছেন না। তাই এমন কাঁপা কণ্ঠ।

লাইলি ভোরেই দেখেছেন কৃষ্ণা একটু অসুস্থ। তবে মা চান না একটুতেই হার মানুক মেয়ে। ওকে মস্তিষ্কের টিউমার থেকে বেশ কষ্ট করেই বাঁচিয়েছেন সবাই মিলে। এবার বাকি জীবনটা আনন্দে কাটাক কৃষ্ণা। মা হিসেবে এমন চাওয়া তো অমূলক মোটেও নয়।

আমেরিকানরা সর্দিজ্বরের টিকাকে আদর করে ফ্লু শট বলে ডাকে। কৃষ্ণাকে সেই টিকা যতই দেওয়া হোক, ঋতু পরিবর্তনের সময় সে জ্বরে পড়বেই! লাইলি স্যুপ বানাচ্ছিলেন মেয়ের জন্য। সে এখন নোনতা বিস্কুট আর স্যুপ ছাড়া কিচ্ছু খেতে চাইবে না।

‘কীরে মেয়ে, আজ তো বড় হলি, ব্যাস অমনি জ্বর বাঁধালি? এই টুকুতে বিছানায় পড়ে থাকলে তো চলবে নারে মা, ওঠ ওঠ ওঠ!’

কৃষ্ণাকে হালকা ঠেলা দিলেন লাইলি। বাবার গলা ছেড়ে এবার মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিল কৃষ্ণা।

‘মা পাপাকে বলো না আজ অফিস না যেতে...।’ আবদার জুড়ল কৃষ্ণা।

‘হুম, তুই আজ তো প্রাপ্তবয়স্ক হলি, এখন তোর সিদ্ধান্তই সব! চল, পাপা অফিস যাবে, তবে মা আজ ক্লাস নেবে না, ঠিক আছে? চল আমরা কেক বানাই তোর জন্য।

সদ্য অষ্টাদশী কৃষ্ণার দেহের সঙ্গে মনেও পরিবর্তন ঘটছে। সে যেমন মার্কিন মেয়েদের মতো হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি (এবং সঙ্গে এমন আরও অনেক পোশাক) পরতে চায় না বলে মাঝেমধ্যে দু–একজনের কটু মন্তব্যও কানে আসে যে, সে হয়তো নিজের দেহ নিয়ে নিজে সন্তুষ্ট নয় বলেই নিজেকে বেশি ঢেকে রাখে। আঠারো বছর বয়স হলেও এখনো কৃষ্ণার জীবনে কোনো বিশেষ পুরুষের আগমন ঘটেনি। তাতেও দু–একজন জানতে চায়, ‘কৃষ্ণা তুমি কি সমকামী?’

শব্দটা শুনে শুধু মৃদু হাসে কৃষ্ণা। মায়ের কাছে শুনেছে, বাংলাদেশে হিজড়া দেখে আজও কিছু মানুষ ভয়ে পালায়। সেখানে সমকামী শুনলে এক দল করবে ছি, ছি। আরেক দল মূর্ছা যাবে।

লাইলি-শামস দুজনেই মেয়েকে ছোট থেকেই শিখিয়েছেন, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই। তাই হিজড়া বা সমকামীরাও আছে কৃষ্ণার বন্ধুবান্ধবীদের দলে। বরং কৃষ্ণা এখন নিজেই বলে, এমন মানুষের মন অনেক বড় হয়।

দ্রষ্টব্য: এ পর্বটি ইচ্ছা করেই ছোট লিখছি। গল্পের মোড় একটু ঘুরবে পরের পর্ব থেকে। খলনায়িকার আগমন কিছুটা ঝড় তুলবে ওদের জীবনে। ওরা কি পারবে সেই ঝড়ের তাণ্ডব সামলে নিতে? (চলবে)
–––

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন