বেড়ানো: পৃথিবীখ্যাত মেরিন ড্রাইভ গ্রেট ওশান রোড

অ্যাঙ্গেল সি সমুদ্রসৈকত। ছবি: লেখক
অ্যাঙ্গেল সি সমুদ্রসৈকত। ছবি: লেখক

গ্রেট ওশান রোড একটি পরিপূর্ণ রোড ট্রিপ। মেলবোর্নের একদিক দিয়ে রওনা দিলে, আরেক দিক দিয়ে ফেরত আসা যায়। প্রায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কিলোমিটার যাত্রা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এই পুরো রাস্তার প্রতিটি কোণে কোণে লুকিয়ে আছে অজস্র সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। যার মোটামুটি একটা অংশ দেখে মেলবোর্নে ফিরে আসতে দুই থেকে তিন দিন লাগে।

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর টানা পাঁচ-ছয় মাস অফিস–বাড়ি করার পর মনটা আসলে হাঁপিয়ে উঠছে।

শিলাকে অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে মনের এই গোপন ভাব বলতেই সে বলে উঠল, সামনে এক দিনের একটি ছুটি আছে শুক্রবার। সঙ্গে সোমবার ছুটি নিলে মোট চার দিনের লম্বা ছুটি। মেলবোর্নের স্বর্গখ্যাত গ্রেট ওশান রোড ঘুরে আসি।

‘উহু! ওটা দ্য গ্রেট ওশান রোড। সামনে একটি The বসবে।’

‘ওকে, ওকে। The-ই সই।’

সপ্তাহ দুই পরে নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে অজানার উদ্দেশ্যে। এ ক্ষেত্রে অজানা বলাটা সমীচীন হচ্ছে কি না, জানি না। কারণ, আমি ম্যাপ দেখে ও গুগল ঘেঁটে একটি যাত্রাপথের পরিকল্পনা করেছি। সঙ্গে দুই রাত দুই জায়গায় থাকার জন্য রুমও ভাড়া করে ফেলেছি। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক রকম থাকার ব্যবস্থা আছে। ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে খুব কম ডলার খরচ করে ব্যাগপ্যাকার্স পর্যন্ত সব ব্যবস্থা আছে।

ব্যাগপ্যাকার্স আসলে একটি কম মূল্যের থাকার জায়গা। যেখানে একেকটা রুমে বেশ কয়েকটা দোতলা বেড থাকে। একটা ছোট হাতব্যাগ নিয়ে রাত কাটানোর সুব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে বাথরুম শেয়ার্ড হয়ে থাকে। তবে আমি ওসব ব্যাগপ্যাকার্স বা ফাইভ স্টার হোটেলের কোনোটাই বুক করিনি। আমি অন্যের বাসায় এক রুম বুক করেছি। অনেকটা আগের দিনের পেয়িং গেস্ট থাকার মতো। এটি একটি অ্যাপসের মাধ্যমে করা যায়, যার নাম এয়ারবিএনবি।

গ্রেট ওশান রোডের প্রাকৃতিক দৃশ্য। ছবি লেখক
গ্রেট ওশান রোডের প্রাকৃতিক দৃশ্য। ছবি লেখক

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে যথারীতি আমি উঠে বসে আমার স্ত্রীকে উঠে পড়ার তাগাদা যখন দিচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে বলল, ‘নেমে এসো বলছি। আমি চালাব।’

কথা শুনে তো আমি মহাখুশি। কিন্তু মুখের সামনে একটি মৃদু মন খারাপ দেখিয়ে বললাম, ‘তোমার কষ্ট হবে না? কত দূর জার্নি বল তো।’

এ কথা বলতে বলতে আমি প্যাসেঞ্জার সিটে সুড়ুত করে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবি, যাক বাঁচা গেল। বসে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখব।

‘জয় নারী শক্তির জয়’, ‘জয় বঙ্গ রমণীর জয়’ বলে জয়ধ্বনি তুলে চলতে শুরু করল গাড়ি। মেলবোর্ন শহরটা পার হয়ে গাড়ি ছুটে চলছে মেলবোর্নের পশ্চিম দিক দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে।

মজার কথা হলো, যেই না মেলবোর্ন শহর খানিকটা পার হয়েছি, চোখ মেলে চেয়ে দেখি চারদিকে শুধু অবারিত সবুজ মাঠ। যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। বিজ্ঞানের ভাষায় ক্লোরফিলের জয়জয়কার। মেলবোর্ন যেহেতু একটু পাহাড়ি অঞ্চল, তাই দূরে বা অদূরে ছোটখাটো টিলা দেখা যাচ্ছে। সবুজ যেন দূরে ঢেউ খেলিয়ে চলছে আমাদের সঙ্গে। শিলাকে ঠায় রাস্তার ওপরে কড়া দৃষ্টি রেখে স্টিয়ারিং হাতে বসে থাকতে হচ্ছে আর আমি চারদিকের সবুজ চাদরে মোড়া প্রকৃতি দেখে আহা, আহা, করছি!

আমাদের প্রথম স্টপেজ হলো টরকোয়ে সমুদ্রসৈকত। দুপুর একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেখানে। হয়তো বিধাতার মনে ছিল অন্য ইচ্ছা। সেখানে আমরা যেন খুব বেশি সময় নষ্ট না করি, সে জন্য বোধ হয় আমরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বাতাস আর তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশে মেঘমল্লার যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সূর্য মামাকে মেঘ তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। এরপরও সমুদ্রের জলরাশিতে একটা হালকা নীল রঙের ছোঁয়া রয়েছে।

এখানে একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। সমুদ্রসৈকতের ওপরে একটু উঁচু জায়গায় যেখানে একটি পার্কের মতো আছে, সেখানে একটি পাবলিক টয়লেটও রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ানরা ট্যুরিস্টদের কথা বেশ চিন্তা করে দেখলাম। যেকোনো পাবলিক জায়গায় তারা একটি গণশৌচাগার করে রেখেছে এবং সেটা বেশ পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে। ভেতরে টিস্যু বা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সব সময় পূর্ণই থাকে। স্বভাবতই ভীমরতি হওয়ার বয়সে আমার একটু পরপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়।

গ্রেট ওশান রোডের সিংহ তোরণ। ছবি: লেখক
গ্রেট ওশান রোডের সিংহ তোরণ। ছবি: লেখক

এই ক্ষণে একটা কথা বলে রাখি, বাঙালি হওয়ার কারণে আমার মনে একটা চাপা অহংকার চেপে রয়েছে। বাংলাদেশে যেকোনো ট্যুরিস্ট স্পটে দেখা যায় রাস্তা ঘাটে বা পার্কে ময়দানে চিপসের প্যাকেট, না হয় সিগারেটের টুকরো কিংবা টিস্যু পড়ে আছে যত্রতত্র। তার মানে বোঝা যায়, বাঙালিরা খুব একটা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন নয়। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বাহার। সব যেন ঝকঝকে তকতকে।

অনেকে ভাবছেন, ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। পরিষ্কারের কথায় যদি তুললেন, তাহলে অহংবোধের বিষয়ের অবতারণা কেন। এর যথেষ্ট কারণ আছে। বিদেশিরা টয়লেট করার পর শৌচকর্ম করে না, টিস্যু ব্যবহার করে থাকে। বাঙালিরা আর যা–ই করুক, পানি ব্যবহার করে আসল জায়গা পরিষ্কার রাখে। তাই এই অহংকার। মানে বাঙালিদের ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’—এ কথা শত্রুও বলতে পারবে না।

বাথরুম থেকে বের হতেই লক্ষ করলাম, ওই পার্কে রয়েছে বসার জায়গা। বাচ্চাদের জন্য দোলনা ও একটি সুন্দর কাঠের ভাস্কর্য। প্রতিটি ভাস্কর্যে একটি বক্তব্য থাকে। যেটি বোদ্ধা ও শিল্পীরা ছাড়া আর কেউ ব্যাখ্যা করতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ Artistic Beauty দেখে বলবে, ‘বাহ! কী সুন্দর!’

এটুকুই ব্যস।

ভাস্কর্যটিতে চারটি মানুষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বোদ্ধা হওয়ার ভান করে আমিও বললাম, কী অপূর্ব!

টরকোয়ে সমুদ্রসৈকতে খাবার জন্য বেশ ভালো কিছু রেস্টুরেন্ট আছে দেখলাম। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। তাই বৃষ্টির মধ্যে আর সময় নষ্ট না করে ছুটে চললাম পরের স্টপেজ অ্যাঙ্গেল সির দিকে।

দুই.

ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ করে পৌঁছালাম অ্যাঙ্গেল সিতে। জায়গাটা বেশ ছোট এক চিলতে শহর মনে হলো আমার। তিন দিকে উঁচু উঁচু পাহাড় যেন ঘিরে রয়েছে শহরটিকে, আর একদিকে রয়েছে সমুদ্র। শিলা কিন্তু এখনো গ্যাট হয়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে আছে। ড্রাইভারি করার সুযোগ আমার এখনো আসেনি।

টেডিস লুক আউট থেকে তোলা ছবি। ছবি: লেখক
টেডিস লুক আউট থেকে তোলা ছবি। ছবি: লেখক

রাস্তার সেই সবুজের সমারোহ এখন চোখে সয়ে গেছে। তার ওপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কী একটা মন খারাপ অবস্থা! আগেই বলেছি, শহরের একদিকে আছে সমুদ্র। তার মানে একটি সুন্দর সমুদ্রসৈকতও আছে। সমুদ্রের বোধ হয় চুম্বকের মতো একপ্রকার আকর্ষণশক্তি আছে। সেই আকর্ষণের কারণেই বৃষ্টি থামতেই আমরা সৈকতে একটু হেঁটে এলাম আর সঙ্গে দু-একটা ক্লিক। ক্যামেরায় একটা ক্লিক দিতেই আমার স্ত্রীর তাড়া। ‘চল তাড়াতাড়ি’—একেবারে স্কুলের কড়া দিদি মণিদের মতো।

গাড়িতে ওঠামাত্র আমার পেটের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। বুঝলাম, প্রকৃতির সৌন্দর্য খেয়ে আর পেট চলছে না। এখন কিছু উদরপূর্তি না করলে উদরে বাঁদর দৌড়াবে। ওদিকে শিলারও একই অবস্থা। বেচারি এত ড্রাইভ করে একটু যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তাই আমরা কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গাড়ি দাঁড় করলাম। খুব একটা দামি বা পরিচিত রেস্টুরেন্ট নয়। বাইরে থেকে দেখে বুঝলাম যে ভেতরে মোটামুটি বার্গার, চিপস বা মুরগি ভাজি পাওয়া যাবে।

যেহেতু আশে পাশে তেমন কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট নেই, তাই আমরা ওই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। একজন বেশ সুন্দরী তরুণী এগিয়ে এলেন খাবারের মেন্যু নিয়ে। আমরা চিকেন ফ্রাই ও বার্গারের অর্ডার দিলাম। খাবার আসার পর আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। খুব খেয়াল করে আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম যে কোথাও কোনো বাঙালি চোখে পড়ে কি না।

আমার চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা দেখে শিলা বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার তোমার। ঘুরে ঘুরে কি সুন্দরী ললনা দেখ নাকি।’

‘আরে না! দেখ তো কোনো বাঙালি পাও কি না।’

‘কেন হঠাৎ করে তোমার বাঙালি খুঁজতে হবে কেন। কী সমস্যা।’

‘মুরগি ভাজি দেখেছ? চারপাশে কেমন লাল হলুদের সংমিশ্রণ। মনে হচ্ছে চকবাজারে কাবাব। চরম স্পাইসি। অজিরা তো এত স্পাইসি খায় না জানি। তাই ভাবলাম দোকানের মালিক বা বাবুর্চি বাঙালি হবে হয়তো।’

‘হুম, বুঝেছি। বহুত হয়েছে। এখন খাও তাড়াতাড়ি। যেতে হবে বহু দূর। এরপর থাকার জায়গা।’

আমি একটু অভয় দিয়ে বললাম, ‘আরে আর বেশি দূরে নয় সুন্দরী।’

অ্যাঙ্গেল সি থেকে খেয়ে দেয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

তিন.

যদিও আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লোর্ন নামের একটি জায়গা। কিন্তু খানিক দূর আসার পর অবাক হয়ে দেখলাম, রাস্তার ওপর একটি প্রকাণ্ড সাইজের কাঠের তোরণ। তোরণের ওপরে লেখা ‘গ্রেট ওশান রোড’। আর সেই তোরণের বাঁ পাশে দুজন মানুষের মূর্তি ও একটুখানি গাড়ি রাখার জায়গা। শিলা ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে যে এটি একটি দেখার জায়গা অর্থাৎ ট্যুরিস্ট স্পট। তাই সুন্দর করে গাড়ি পার্ক করে ফেলল। আমরা নেমে এলাম।

কনক্রিশনসের ছাঁচ। ছবি: লেখক
কনক্রিশনসের ছাঁচ। ছবি: লেখক

ওহ মাই গড! সত্যিই একটি বিশাল সিংহ দরজা। মনে হলো যেন আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছে গ্রেট ওশান রোডে ঢোকার জন্য। তোরণের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভের ওপর গ্রেট ওশান রোডের ইতিহাস লেখা রয়েছে আর বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট–সংবলিত একটি ছোট্ট ম্যাপ রয়েছে। আমি খুব ভালো করে ইতিহাস পড়তে লাগলাম। গ্রেট ওশান রোডে ঢুকব, আর তার ইতিহাস জানব না, সেটা তো হতে পারে না।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার সেনাদের নিহত হওয়ার ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। যার কারণে যেসব বীরযোদ্ধা সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন, তাঁরাও একপ্রকার যুদ্ধ–পরবর্তী মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল। যুদ্ধের বীভৎসতা তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তখন তৎকালীন সরকার এই রোড নির্মাণের দায়িত্ব দেয় সেসব অকুতোভয় বীর সেনানীকে। দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রচেষ্টায় তৈরি হয় পৃথিবীর মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর এই মেরিন ড্রাইভ।

এই সিংহ তোরণ পার হওয়া মানে এবার আমরা অফিশিয়ালি গ্রেট ওশান রোডে প্রবেশ করলাম। আর আনন্দের বিষয় হচ্ছে, ড্রাইভিং সিটে আমি। কারণ, শিলা এখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যদিও ড্রাইভিং করতে না পেরে মুখ ভার করে বসে আছে প্যাসেঞ্জার সিটে। আমি এখন অবশ্য বেশ পুলকিত। দুপুর গড়িয়ে এবার বিকেলের দিকে। আরও চার ঘণ্টার মতো আলো থাকবে। আমরা এরপর লোর্নে থামব। রাস্তা এখন আঁকাবাঁকা শুরু হয়েছে। হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে বেশ দূরে সাদা একটি উঁচু স্তম্ভের ওপর লাল গম্বুজ মতো কী যেন একটা।

শিলার মুখ ভার কেটে গেছে অনেকক্ষণ। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যাব ওখানে।’

আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম, ‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার? ওই যে দেখ বাতিঘর দেখা যাচ্ছে। ওখানে যাব।’

আমি কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম। আসলে আমি তো নিজেই ঠিক করেছি যে ওখানে যাব।

মূল যে প্রধান সড়ক দিয়ে আমরা চলছি, বাতিঘরে যাওয়ার রাস্তা তার পাশে একটি সরু গলির মতো। আমি ভুস করে ঢুকে গেলাম সেই সরু রাস্তায়। গাড়ি চলছিল এতক্ষণ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে। এখন এই সরু রাস্তায় ৪০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। মনে হচ্ছে গাড়ি যেন চলছেই না, খুঁড়িয়ে চলছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতিঘরের নিচে পৌঁছে গেলাম। কী প্রকাণ্ড এক স্তম্ভ। এর নিচে নিজেদের অনেকটা হাতির সামনে সরিষা দানার মতো নগণ্য মনে হতে লাগল। সেখান থেকে পড়ন্ত বিকেলে নীল সমুদ্র দেখতে দেখতে মন আমার গুন গুন করে গান গেয়ে উঠল।

‘আমি সাগরের নীল...।’

গান গাওয়া বেশি দূর বাড়তে দিলাম না। ঝটপট দেখা শেষ করে, কিছু ছবি তুলে রওনা দিলাম আবার মূল গন্তব্যের দিকে। একটু মুচকি হেসে বললাম, ‘এভাবে কিছু দূর পরপর গাড়ি দাঁড় করলে এ জীবনে আর থাকার জায়গায় পৌঁছানো লাগবে না। গাড়িতেই রাত্রিবাস করতে হবে।’

কিন্তু কথায় বলে না, বিধি বাম। কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ‘টেডিস লুক আউট’ নামের সুন্দর একটি দেখার জায়গা। শিলার দিকে তাকাতেই সে মুচকি হেসে সম্মতি দিল।

এটি পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ খানিকটা ওপরের একটি জায়গা। বনজঙ্গল ঘেরা। গাড়ি নিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে, বড় বড় গাছপালার মাঝখান দিয়ে ওপরে উঠছি তো উঠছি। সে ওঠার মনে হয় শেষ নেই। পরে যখন একেবারে ওপরে উঠে গেলাম, তখন দেখি এই জনমানবহীন পাহাড়ের মাথায় গাড়ি পার্কিংয়ের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবাকই হলাম পার্কিংয়ের জায়গা দেখে। একটু আগে গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলাম, ‘কোথায় যে যাচ্ছি, কূলকিনারা নেই।’ আর এখন পেয়ে গেলাম এক সুন্দর গাড়ি রাখার জায়গা।

গাড়ি রেখে সামনে একটু হেঁটে গেলেই টেডিস লুক আউট।

আমরা এখন সমতল ভূমি থেকে বেশ অনেকটা উঁচুতে। সেই উঁচু পাহাড়ের একদম কিনারায় একটি কাঠের প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা ওপর থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে পারেন। আমরাও দুই চোখ মেলে দেখতে লাগলাম সেই সুন্দর দৃশ্য। দূরে দেখা যাচ্ছে আরেকটি পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল আকৃতি রাস্তা বয়ে চলেছে। আর সেই সবুজ পাহাড়ের নিচে দুধসাদা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের নীল জলরাশি। মনে হচ্ছে, এ যেন সবুজের প্রসারিত শান্তি ও আকাশে নীলের হাতছানির মধ্যে সুনীল সমুদ্রের অবিরাম ঝংকারে চকিত নৃত্য। আমি সেই দৃশ্য দেখে মাঝেমধ্যে পাগল হয়ে উঠছি। শিলা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত স্বভাবের মানুষ। একমনে তাকিয়ে সুন্দরকে উপভোগ করছে আর ছবি তুলছে। তাঁর চোখমুখে ছড়িয়ে রয়েছে খুশির ঝিলিক।

আর আমার ক্ষেত্রে ঘটছে অন্য ঘটনা। আমি যেন তখন ছন্দপাগল জীবনানন্দ। সমুদ্রের আছড়ে পড়া জলরাশি আমার রক্তে রক্তে তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত আমার সংবিৎ ফিরল শিলার ডাকে। ওই লুক আউট থেকে ফেরার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, কিছু পাথরের পৃষ্ঠদেশে চায়ের কাপ সাইজের ছোট ছোট গর্ত এবং তাতে পানি জমে আছে। ব্যাপার কী? বৃষ্টির পানি কি তাহলে এই গর্ত করেছে পাথরের ওপর? পরক্ষণেই মনে হলো, বৃষ্টির পানি যদি গর্ত করবে, তাহলে কত দিন লেগেছে বা শুধু ওই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় করবে কেন? সম্পূর্ণ পাথরের গায়েই তো গর্ত হওয়ার কথা।

শিলা মনে হয় আমার চিন্তা বুঝতে পারল। ডেকে বলল, ‘দেখো, ওখানে একটা প্ল্যাকার্ড আছে, এই সম্বন্ধে। পড়ে দেখ।’

কেনেট নদীর তীরে টিয়া। ছবি: লেখক
কেনেট নদীর তীরে টিয়া। ছবি: লেখক

প্ল্যাকার্ড পড়ে যা বুঝলাম তা হলো, বৃষ্টির পানি ও বিভিন্ন কেমিক্যাল মিলে পাললিক শিলার ভেতরে একটি বলের আকৃতির পিণ্ড তৈরি করে। তার নাম ‘কনক্রিশনস’। এটি তৈরি হতে ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন বছর লাগে। এই পাথরের পৃষ্ঠ থেকে ওই বলসদৃশ তিনটি বের হয়ে গেছে। পড়ে রয়েছে তার ছাঁচ। আমি চিৎকার দিয়েই উঠছিলাম প্রায়, ১২০ মিলিওওওন বছর! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তবে এখন বিস্ময়ে বিস্মিত হলে তো হবে না। তাই কোনো রকমে বিস্ময়কে পেছনে ফেলে গাড়িতে উঠে পড়লাম।

শুরু হলো আবার পথচলা। এখন গাড়ি চালানোর ব্যাপারে আমার অনুভূতি মিশ্র। কিছুটা ‘এই পথ যেন না শেষ হয়, তবে কেমন হবে...’ জাতীয় অনুভূতি। আবার কখনো কখনো ‘আমি ভয় করব না...ভয় করব না’ রকমের অবস্থা।

এর অবশ্য কারণ আছে। গাড়ি ছুটে চলছে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। রাস্তার একেকটি বাঁক প্রায় ইউটার্নের মতো। আবার কখনো রাস্তা খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে। আবার কখনো হঠাৎ করেই নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই একটু ভয় ভয় করছে।

অন্যদিকে রাস্তার বাঁ পাশে সুনীল সাগরের হাতছানিতে মনটা ভরে উঠছে। এখন অবশ্য বৃষ্টি থেমে ঝলমলে রোদ উঠে গেছে। এই রাস্তার স্পিড লিমিট লেখা আছে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু আঁকাবাঁকার কারণে আমি ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার স্পিডে চালাচ্ছি।

আমার পেছনে মাঝেমধ্যে প্রচুর গাড়ির সারি জমে যাচ্ছে। কিছু দূর পরপর রাস্তার পাশে একটি বাড়তি লেন রাখা হয়েছে যাতে ‘স্লো ভেহিকল ওভার টেকিং’ লেখা।

আমি প্রায়ই ওই সব লেনে চলে যাচ্ছি যাতে আমার পেছনের গাড়িগুলো ওভারটেক করে চলে যেতে পারে। এভাবে ভুস ভুস করে আমার পেছনের গাড়ির চালকেরা জানালার বাইরে হাত নেড়ে ধন্যবাদ দেওয়ার ইশারা করে চলে যাচ্ছেন। এটা অস্ট্রেলিয়ার একটি ভালো রীতি। কেউ সামান্য একটু ভালো কিছু করলে তার একটা ভালো মূল্যায়ন করা।

কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়ল ‘কেনেট রিভার হলি ডে পার্ক’ নামে একটি জায়গা। সেখানেই গাড়ি থামিয়ে বাথরুমে দৌড়। বাথরুম থেকে ফিরে দেখি শিলা একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ওই গাছের নিচে অনেক মানুষ বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছে। আমি কাছে যেতেই শিলা বলল, ‘দেখ কী সুন্দর প্যারোট! একেবারে হাতের ওপর নেমে আসছে। ঠোঁটের সামনে খাবার ধরলে খাবার খাচ্ছে।’

দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে কালো রঙের ভারী সুন্দর পাখি গলা ও মাথা লাল রঙের। লাল ঠোঁট দিয়ে মানুষের হাতে বসে খাবার খাচ্ছে। চমৎকার দৃশ্য! বাংলাদেশে এ ধরনের দৃশ্য দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের দেশের পাখিরা মানুষকে ভয় পায় বলে আমার মনে হয়। একসময় বাংলাদেশে যখন বার্ড ফটোগ্রাফি করতাম, তখন খুব সাবধানে অনেক দুর থেকে টেলি লেন্স দিয়ে ছবি তুলতে হতো। মানুষের একটু পদশব্দ পেলে পাখিরা ফুড়ুত করে উড়ে চলে যেত। ক্যামেরাবন্দী করা বেশ কঠিন হতো।

এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কথায় আছে, পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। হলোও তাই। গাড়িতে উঠতে না উঠতে সন্ধ্যা হয়ে এল। এখন রাস্তার ক্ষীণ আলো ও গাড়ির হেডলাইট সম্বল। সূর্যমামা নেই। তবে চাঁদমামা আছে। খুব সাবধানে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এখন গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এমনিতেই পথ আঁকাবাঁকা। তার ওপর বেশ অন্ধকার। ফলে পথ চলতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর গুগলের সহায়তায় একেবারে সোজা পৌঁছে গেলাম আমাদের ভাড়া করা বাসায়। জায়গাটির নাম অ্যাপোলো বে। এটাই আমাদের প্রথম রাতের থাকার জায়গা। একটি ছিমছাম সুন্দর এক রুমের অ্যাপার্টমেন্ট।

বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে দেখি ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। বাড়ির মালিক একজন চায়নিজ ভদ্রলোক। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন, সামনে একটু দূরে বাজার আছে, সেখানে ভালো খাবার পাওয়া যায়। বেরিয়ে পড়লাম দুজনে খাবারের উদ্দেশ্যে।

বাড়ির মালিকের কথা শুনে গিয়ে দেখি, সত্যিই ছোট্ট একটি বাজারের মতো একচিলতে জায়গা। আর সেখানে একটিই মাত্র দোকান খোলা আছে। খুব সম্ভবত ভিয়েতনামিজ রেস্টুরেন্ট। সেখানে খেয়ে ফিরে এলাম আজকের রাতের মতো নিজেদের ডেরায়। (চলবে)