জাপানের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার উৎসব 'সেইজিন নো হি'

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার উৎসবে সমবেত একদল জাপানি ছেলেমেয়ে। ছবি: সংগৃহীত
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার উৎসবে সমবেত একদল জাপানি ছেলেমেয়ে। ছবি: সংগৃহীত

জাপানে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সোমবার ২০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের যুবক-যুবতী হয়ে ওঠার দিন। রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে এদিন তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নতুন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনটি উৎসবের মতো। এই উৎসবকে বলা হয় ‘সেইজিন নো হি’। ইংরেজিতে Coming of age day.

গতকাল ১৩ জানুয়ারি ছিল সেই দ্বিতীয় সোমবার। এদিন ছুটি থাকে। শনি ও রোববারের সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ‘সেইজিন নো হি’র ছুটি মিলে টানা তিন দিনের ছুটি। এই ছুটিতে বাসায় একটানা আড়াই দিন কাটিয়ে বাইরে চনচনে রোদের আভাস দেখে বেরিয়ে পড়লাম।

দুটি আমন্ত্রণ থাকলেও বাইরে একাকী সময় কাটানোর ইচ্ছা হলো। ঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়ল বাসস্ট্যান্ডে কিমানো পরিহিত এক মেয়ে একাকী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তাকে পরির মতো মনে হলো। তখনই মনে পড়ল ওহ, আজ তো সেইজিন নো হি। ওদের ২০ বছর বয়সে পড়ার দিন। বয়সের বাধার সব দেয়াল ভেঙে মুক্ত-স্বাধীন হয়ে ওঠার দিন।

বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত মেয়েটাকে দেখে ভালো লাগল। গায়ে পড়ে তাকে অভিনন্দন জানালাম। মেয়েটির চোখ জ্বলে উঠল। মিষ্টি হাসিতে মেয়েটি অভিনন্দনের জবাব দিল। বললাম, তোমার একটি ছবি নিই? এতক্ষণ নিজের পরিবার ও বন্ধুদের কাছে নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা পেয়েছে। এই প্রথম একজন বিদেশির কাছ থেকে শুভেচ্ছা পাওয়াটা মনে হয় মেয়েটি উপভোগ করেছে। তাই বাসে উঠেও ধাবমান বাস থেকে হাত নেড়ে বিদায় নিল।

বাসস্ট্যান্ডে কিমানো পরিহিত এক মেয়ে। ছবি: লেখক
বাসস্ট্যান্ডে কিমানো পরিহিত এক মেয়ে। ছবি: লেখক

একটু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম, নিজেদের পরিচিত কার ছেলেমেয়ে আজ ২০ বছরে পড়ল। বন্ধু সনৎ বড়ুয়ার মেয়ে অহনা বড়ুয়া, বন্ধু ইলিয়াছ মুন্সীর মেয়ে আয়েশা, মিশু ভাইয়ের মেয়ে সুস্মিতা ও শাহিন ভাইয়ের মেয়ে মায়েদা রিসার নাম মনে পড়ল। কোনো ছেলের নাম মনে পড়ল না।

দিনটিতে মনে মনে অহনা, আয়েশা, সুস্মিতা ও রিসাকে প্রাণভরে দোয়া ও শুভকামনা জানালাম।

জাপানপ্রবাসী বেশির ভাগই এই দিনের কথা জানেন। পাঠকদের জন্য এই দিনটি সম্পর্কে তথ্য নিচে উদ্ধৃত করলাম।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অহনা। ছবি: লেখক
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অহনা। ছবি: লেখক

জাপানে সম্প্রতি এই আইন সংশোধন করা হয়েছে। নতুন আইনে দুই বছর আগেই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন তরুণ-তরুণীরা। দেশের সরকার ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স ২০ বছর থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করার বিল পাস করেছে। নতুন এ আইন ২০২২ সাল থেকে কার্যকর হবে।

এ আইনে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি ঘটবে, তা হচ্ছে ছেলেমেয়েরা এখন ১৮ বছর বয়সেই মা-বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করার এখতিয়ার পাবেন। ১৮৭৬ সালে জাপানে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর এই প্রথম তাতে পরিবর্তন আনা হলো।

দেশটির বর্তমান আইন অনুযায়ী ছেলেরা ১৮ বছরের পর এবং মেয়েরা ১৬ বছর বয়সের পর বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সে জন্য তাদের মা-বাবার অনুমতি নিতে হয়। শুধু ২০ বছর হওয়ার পর কেউ নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারেন। নতুন আইন কার্যকর হলে ১৮ বছর বয়সী সব ছেলেমেয়েই নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আয়েশা। ছবি: লেখক
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আয়েশা। ছবি: লেখক

১৮ বছর বয়সেই মা-বাবার অনুমতি ছাড়া তাঁরা চাইলে ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে পারবেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাঁরা নিজেদের পাসপোর্ট পাবেন। যার মেয়াদ হবে ১০ বছর। জাপানে বর্তমানে অপ্রাপ্তবয়স্করা পাঁচ বছর মেয়াদে পাসপোর্ট পান এবং এ জন্য মা-বাবা বা আইনি অভিভাবকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। নতুন আইন চালু হলে ‘জেন্ডার আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার’-এর চিকিৎসা চলছে—এমন কেউ ১৮ বছর হওয়ার পর আইনগতভাবে নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তনের আবেদন করতে পারবেন।

নতুন আইনে দুই বছর কমিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স ১৮ করা হলেও কিছু কৌশলগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ১৮ বছর হলেও তাঁরা মদ্যপান, ধূমপান, জুয়া খেলা ও শিশু দত্তক নিতে পারবেন না। এ জন্য তাঁদের ২০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুস্মিতা। ছবি: লেখক
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুস্মিতা। ছবি: লেখক

নতুন বিলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স কমলেও কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এটা নিয়ে খুব একটা খুশি হতে পারেনি। এক টুইটার ব্যবহারকারীর প্রশ্ন, ‘তাহলে আমি ১৮ বছরে পড়ব ও প্রাপ্তবয়স্ক হব। কিন্তু আমি মদ্যপান করতে বা জুয়া খেলতে পারব না? এটি কিছু হলো না।’

অন্য একজন লেখেন, ‘১৮ বছর হলে আমি ঋণ করতে পারব। কিন্তু মদ্যপানের ওপর তখনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে!’ জাপানে প্রতিবছর জানুয়ারিতে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া উপলক্ষে উৎসব আয়োজন করা হয়। ওই দিন ছুটি থাকে ও ২০ বছরের তরুণেরা তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াকে স্বাগত জানান।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রিসা। ছবি: লেখক
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রিসা। ছবি: লেখক

কয়েক দশক ধরেই জাপানে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স নিয়ে বিতর্ক চলছে। ২০০৯ সালে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল অব দ্য মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স কমিয়ে ১৮ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জাপানে জন্মহারের নিম্নগতির কারণে দেশটির মোট জনসংখ্যায় ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স কমিয়ে দেওয়ায় তরুণ বয়সীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানে উৎসাহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে ভোটার হওয়ার বয়সও ২০ থেকে কমিয়ে ১৮ করা হয়।