মমতার স্পর্শের টানে

প্রতীকী ছবি। ছবি: জিয়া ইসলাম
প্রতীকী ছবি। ছবি: জিয়া ইসলাম

বছর দুই পরপর ঢাকা যাই আমি। বাচ্চাদের স্কুলের ছুটি ও কাজের ছুটি মিলিয়ে যে কটা দিন ছুটি পাই।

এত অল্প দিন। চোখ বন্ধ করলেই কেটে যায়। তারপর প্রত্যেকবার রাতের ডিউটি শেষ করে লাফিয়ে প্লেন ধরি। পথে জ্বর, গায়ে ব্যথা, মাথা ঘোরা তো আছেই।

এবারের ভ্রমণ আরও স্মরণীয়। কারণ, প্রায় এক বছর আগে ছুটি চেয়েছি। নামঞ্জুর হয়েছিল। সার্জিও (কলিগ) কাজটা করে দেওয়াতে ছুটি পেলাম। বছরের মাঝামাঝি এসে মৃত্যুর দরজা ঘুরে এলাম। তারপর থেকে অপেক্ষা করছি কখন কিছু অতি প্রিয় কাছের মুখগুলো দেখব। ভাবনাচিন্তাহীন ১০ দিন কাটবে।

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে টিকিট করব, ছেলে বলে বসল, প্রতিবার দেশে গেলে সে ভয়ানক অসুস্থ হয়। সুতরাং সে যাবে না। সে বড় হয়েছে। একা খুব ভালো থাকবে।

আমি তো জানি, কী ভালো সে থাকবে। অনেক কথা বলার পরও সে মত বদলায় না। অতঃপর তাকে মোবাইল ফোনে টেক্সট করলাম, মা হিসেবে সারা জীবন তোমাকে সাপোর্ট দেব। কিন্তু জীবনে কখনো আমার সঙ্গে কথা বলবে না।

সেদিনই টিকিট করে ফেলব। ছেলের পরের টেক্সট ছিল ‘মা আমি যাব’। কাজ শেষ করার দুই দিন পর জিনিস গুছিয়ে রওনা হলাম। ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে। সমুদ্রের পাশে সানডিয়েগো বিমানবন্দর।

উবার ড্রাইভারও মনের অবস্থা বুঝে যেন বলল, ‘খুব রিফ্রেশিং ট্রিপ হোক তোমাদের।’

প্লেন ডিলে ছিল এক ঘণ্টা। হিসাব করে অনেক আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম। পৌঁছে ফেসবুকে সেলফি দিলাম, আসছি।

সানডিয়েগো বিমানবন্দরে নাশতা সেরে প্লেন ধরে সিয়াটল বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। ঘণ্টা চারেক পর দুবাইগামী এমিরেটসের বিমানে উঠব। ঢোকার মুখে কাস্টমসের লোক জিজ্ঞাসা করল, আমাদের সঙ্গে ১০ হাজার ডলারের বেশি আছে কি না।

আমার কাছে ১০ হাজার ডলারের সামান্য কিছু বেশি ছিল। কিন্তু ডিক্লেয়ার করিনি। কারণ, আশপাশে কোনো ফরম ছিল না। আমার ধারণা ছিল জনপ্রতি ১০ হাজার করে নেওয়া যায়। আমাদের আলাদা করে সব ডলার সিজ করল তারা। এমনকি ছেলের পকেটের খুচরাগুলোও। এতে সময় লাগল এক ঘণ্টা।

জানতে পারলাম, সিয়াটল থেকে দিনে মাত্র এমিরেটসের একটা ফ্লাইট ছাড়ে। আমরা ফ্লাইট মিস করেছি। কাস্টমসের লোকেরা বলল, সব লাগেজসহ (ওরা আগেই নামিয়ে নিয়েছিল) পাঁচতলায় এমিরেটসের অফিসে যেতে। বহু খুঁজে অফিসে গেলাম। আশপাশের লোকজন জানাল, এমিরেটসের কর্মীরা তো বাসায় চলে যাওয়ার কথা প্লেন ছাড়ার পরপরই।

এমিরেটসের অফিসের সামনে বসে ফোনে ট্রাভেল এজেন্টদের ফোন করলাম। যাকেই ফোন করি সেই বলে ভয়াবহ ব্যস্ত সময় এখন। আবার সমান দামে টিকিট করতে হবে। যেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। ছেলে বলে বসল, এক্ষুনি তাকে যেন সানডিয়েগো নিয়ে যাওয়া হয়। সে ঢাকা যাবে না। তাকে বুঝিয়ে ফোনের পর ফোন করে মোটামুটি রিজেনেবল দামে টিকিট পেলাম। লোকাল হোটেল ঠিক করলাম।

লেখিকা
লেখিকা

সৃষ্টিকর্তা যে আছেন তার প্রমাণ পেলাম তারপরের প্রতিটি ঘটনাতে। হোটেলের ফ্রি শাটলে পৌঁছালাম হোটেলে। এটিএম মেশিন কোথায় আছে জানতে চাইলে তারা জানাল রাস্তার উল্টো দিকে দুই মাইল দূরে। একটা হোটেলের মধ্যেই আছে কিন্তু কাজ করে না। দৌড়ে গেলাম চেষ্টা করে দেখতে। কাজ করল মেশিন। এরপরে আর কারও জন্যই কাজ করেনি সেটা। দুই শ ডলার তোলা গেল। ভাংতি করে পোর্টারকে দিলাম। ডিনার করে সবাই ঘুমাতে গেল।

শনিবার রাত। প্রায় নির্ঘুম কাটালাম। মার আমার কাছ থেকে নিয়ে বিভিন্ন চ্যারিটিতে টাকা দেন। এসে দেব জাতীয় কত কিছু বলেছি। ভাবলাম, কীভাবে ১৯৮ ডলার নিয়ে দেশে যাব? রোববার সবকিছু বন্ধ।

ভোর রাতে ব্যাংকে ফোন করলাম। বললাম কী করব বল। তারা বলে দিল সাময়িকভাবে এক দিনে ২৫০০ ডলার তোলা যাবে। ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। নাশতার পরে উবার নিয়ে গেলাম এটিএম কাউন্টারে। তুলতে পারলাম টাকা।

এমিরেটসের লোকেরা আমাদের দুরবস্থা শুনেছিল মনে হয়। টিকিট ফ্রি আপগ্রেড করে দিল। দুবাইতে ৯ ঘণ্টার জন্য হোটেল দেবে না বলেছিল। হোটেলও দিল।

শেষ পর্যন্ত ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। নতুন স্থাপনা দেখলাম। আব্বু–আম্মু আর ভাইকে দেখলাম। একনিমেষে দূর হয়ে গেল যত কষ্ট।

এক দিন পরই বাচ্চাদের চট্টগ্রাম পাঠাতে হয়েছে। অসম্ভব প্রতিকূলতার কারণে নিজে যেতে পারিনি। ওদের ভিড় ঠেলে প্লেনে তুলে দেওয়া আর পরদিন সন্ধ্যা থেকে বিমানবন্দরে বসে রাত নয়টায় ফিরে পাওয়ার সময়টুকু প্রায় ঘুমহীন কাটল।

প্রতিবারের মতো এবারও ছেলে অসুস্থ হয়েছে চট্টগ্রামে গিয়ে। এ কারণে দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের সে দেখতে যেতে পারেনি। এত দূর জার্নি করে কী উচিত বা অনুচিত, সে যুক্তি যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গে খাটে। বাসায় রান্না খাবার খেয়ে মূলত তারা ভালো থাকে।

পরের চার দিন গেলাম বিভিন্ন স্থানে। আড়ংয়ে গেলাম নিজের উৎসাহে। মেয়ে কিনল বন্ধুদের গিফট। প্রিমিয়ামে রঙিন ফুচকা খেল।

এবার বহু বছর পর ভাগনে–ভাগনি এল লন্ডন থেকে। বোন নিউরো ফিজিওলজিতে ফেলোশিপ শেষ করে এল। তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যা আশা করিনি। সবাই মিলে একদিন শুধু ভালো রেস্টুরেন্টে যেতে পারলাম।

যে অবস্থাতেই থাকি দুলাভাইয়ের আমাদের প্রতি আদর বা সম্মান কখনো কমতে দেখিনি। দেশে যা দেখি এত ভালো লাগে। সব মমতার স্পর্শ খুব দরকার ছিল।

একদিন গেলাম মিরপুরে এক বৃদ্ধাশ্রমে। যাঁদের কেউ নেই, কী পরম মমতায় তাঁরা আছেন সেখানে।

সাতটা দিন ঝড়ের গতিতে চলে গেল। চলে আসার দিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। বাচ্চাদের নিয়ে একা এতটা পথ। আবার কী নাটক অপেক্ষা করছে জানি না। দুবাই পর্যন্ত ভালোভাবে কাটল। পাশে বসেছিল আমার খুব কাছের বান্ধবীর ছোট্ট ভাগনে। ফেসবুকের টাইমলাইনে দেখেছি শুধু। অথচ মনে হলো কত চেনা।

দুবাই থেকে সানফ্রান্সিসকো আসার পথে ওভারহেড ঘোষণা শুনলাম, মেডিকেল প্রফেশনাল কেউ যদি থাকেন, তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। মনে মনে চিন্তা করলাম, আবার কী সমস্য। তারপরও গেলাম। গিয়ে দেখি এক নারী বমি আর ডায়রিয়ায় নেতিয়ে পড়েছেন। শরীরে বেশ জ্বর। ব্লাড প্রেশার কম। হার্টবিট কম।

শেষ কবে আইভি লাইন করেছি মনে পড়ে না। তাকে দেখি ট্রাভেলার্স ডায়রিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে বসে আছে। একটু সাহস পেলাম। অন্য সব ওষুধসহ সে অ্যান্টিবায়োটিক তাকে খেতে বললাম। অল্প অল্প করে ফ্লুইড খেতে পারছেন তিনি। ঘণ্টাখানেক তিনি বমি করলেন না। ব্লাড প্রেশার বাড়ল। বুঝে গেলাম আইভি লাইন বা ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং লাগবে না।

বাচ্চাদের নিয়ে বহুবার এ রকম সমস্যা হয়েছে। প্রতিবার চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে বা পরে। বুঝে গেলাম কেন আমার ছেলেটা মা ছাড়াও এত অসুখ নিয়ে চলে আসতে পেরেছিল এবার। মানুষ শুধু নিমিত্ত।

সানফ্রান্সিসকোতে মাত্র দুই ঘণ্টার বিরতি থাকলেও সানডিয়েগোগামী প্লেন ঠিকই ধরতে পারলাম। এখানে এসে ব্যাগ হারানো ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটল না। পরদিন ব্যাগ ফেরত পেলাম আর তার পরদিন ছেলেকে ডর্মে দিয়ে এলাম। ওদের ক্লাস শুরু হয়েছে। আর আমি কয়েকটা দিন পেলাম ছুটি।

মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে ভাবি আম্মু–আব্বুর সঙ্গে এক কাপ চা খাব। তারপর বাস্তবতা মেনে নিজে বানিয়ে নিই। বাংলাদেশ আর আমার প্রিয়জনদের খুব মিস করছি।