জাপানের পর্যটন ও আমাদের শিক্ষা

পাহাড় আর লেকের দেশ জাপান। ছবি: লেখক
পাহাড় আর লেকের দেশ জাপান। ছবি: লেখক

নিজ নামেই জাপানের পরিচয়। ভূমিকম্পনপ্রবণ এই দেশ প্রযুক্তির উৎকর্ষে আকাশচুম্বী যেসব নয়নাভিরাম অট্টালিকা গড়েছে, সেসব দেখলে অবাক হতে হয় বৈকি। এদের গাড়ি, ইলেকট্রনিকস শিল্প আজও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। প্রযুক্তির পরতে পরতে এদের বিচরণ। শুধু কি তা–ই! যেকোনো পণ্য প্রস্তুতে মানের প্রশ্নে এরা আপসহীন।

তবে কি ইট-পাথর, লোহালক্কড়, প্রযুক্তি নিয়ে সর্বদা উদ্ভাবনে নিমগ্ন এ জাতি জীবনের অন্যদিকে উদাসীন? না, মোটেও তা নয়। জীবনের সব দিকেই এরা সমভাবে সিদ্ধহস্ত। এরা শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা পছন্দ করে। মেয়েরা সুন্দর করে সাজতে ভালোবাসে। ছেলেরাও প্রসাধনে অভ্যস্ত।

শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, সময়ানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম ও বিনয়—এই শব্দগুলো যেন এদের শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মেশানো। শৈশবে মা-বাবা সন্তানদের শেখান, ‘যদি তুমি তোমার চারপাশের ময়লা পরিষ্কার করো, তবে তোমার অন্তরটাও পরিষ্কার থাকবে।’ ডাস্টবিনের ময়লা প্রক্রিয়াজাত করে জাপান সম্পদে রূপান্তর করে।

জাপানিরা সাদা কাপড় পরতে খুব পছন্দ করে। জনবহুল শহরে কোনো জনতার ভিড়ে তাকালেই দেখা যায়, শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মানুষ সাদা পোশাক পরিহিত (ছেলেরা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট এবং মেয়েরা সাদা জামা)। বিনয়ে আর কোনো জাতি এদের সমকক্ষ কি না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ বিদ্যমান।

জাপান সাগরের ঊর্মিমালা। ছবি: লেখক
জাপান সাগরের ঊর্মিমালা। ছবি: লেখক

কাজপাগল এ জাতি ঘুরতে বেশ পছন্দ করে। ছুটির দিনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এক-দুজনের জন্য ঘুমানোর বিছানা ও সন্নিবেশিত টয়লেটসহ নানা রকম সুবিধাওয়ালা বিশেষ গাড়ি ভাড়ায় পাওয়া যায়। যেটি ভাড়া নিয়ে অনেকে ঘুরতে বের হন। বনে-বাদাড়ে কিংবা সাগর-পাহাড়ে যেখানে ইচ্ছা গিয়ে স্পটেই এর ভেতরে অনায়াসে রাত যাপন করা যায়।

জাপানের অট্টালিকা। ছবি: লেখক
জাপানের অট্টালিকা। ছবি: লেখক

জাপানের পর্যটনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি স্থানীয় সরকার (বাংলাদেশের উপজেলা পরিষদ/পৌরসভা) নিজ নিজ এলাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর পর্যটন স্পট তৈরি করেছে। তাই যেকোনো প্রিফেকচার বা সিটিতে গেলেই প্রচুর পর্যটন স্পট মেলে।

পুরো দেশটাই ঘুরে দেখার মতো। প্রতিটি শহর, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে পর্যটন তথ্যকেন্দ্র আছে। যেকেউ তথ্য চাওয়ামাত্র ছাপানো কাগজে পর্যটনবান্ধব মানচিত্রসহ তথ্য পাওয়া যায়। এসব কেন্দ্রে সেবা প্রদানকারীরা সর্বদা হাসিমুখে বিনয়ের সঙ্গে সেবা প্রদান করেন।

শুধু এসব কেন্দ্রে নয়, যেকোনো সরকারি দপ্তরে গেলে এ নিয়মেই সেবা পাওয়া যায়। প্রতিটি সিটি যেন একেকটি বিশেষ পর্যটন নগরী। প্রচুর আবাসিক হোটেল, বিস্তৃত যাতায়াত নেটওয়ার্ক, অবাধ তথ্য, মোড়ে মোড়ে তথ্যকেন্দ্র, লিফলেট-ম্যাপ। দেশের সর্বত্র ওয়ান টাইম পিকনিক দ্রব্যসামগ্রী সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়।

সবচেয়ে সুখকর দুটি বিষয় হলো, জাপানে কোথাও টিপস চাওয়া বা দেওয়ার একেবারেই প্রচলন নেই। এ ব্যাপারে কেউই আপনাকে কখনোই বিরক্ত করবে না। আরেকটি হলো পুরো দেশের সবখানে নির্ধারিত মূল্যে সবকিছু চলে। আপনি এক পয়সার কোনো দ্রব্য কিনলেও দ্রব্যটিতে মূল্য লেখা থাকবে। কেনার পর আবশ্যিকভাবে আপনাকে রিসিট দেওয়া হবে।

ইয়ামাগুচির সবুজ উদ্যানে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ইয়ামাগুচির সবুজ উদ্যানে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

ট্রেন, গাড়ি, ট্যাক্সি ভাড়া কিংবা পর্যটন স্পটের রাইডস ভাড়া নিয়ে কখনোই দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কেউ আপনাকে ঠকানোর চিন্তাও করবে না। এসব বিষয়ে নাগরিক কিংবা পর্যটক শতভাগ ঝামেলামুক্ত থাকে।

গ্রীষ্ম, শীত ও বসন্ত, বছরে তিনবার জাপান রেলওয়ে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য জু-হাচি কিপ্পু নামে ‍সুলভ মূল্যে বিশেষ টিকিট সরবরাহ করে। ২ হাজার ৫০০ ইয়েনের এ টিকিট ব্যবহার করে যেকেউ জাপান রেলওয়ের সাধারণ ট্রেনে ‍দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের যেখানে যতবার ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারেন।

ঘোরাফেরার পাশাপাশি এরা মজার মজার খাবার খায়। রসনাবিলাসে জাপানিরা অনেক দূর এগিয়ে। সুশি-সাশিমি, রামেন, তেমপুরা, কারে রাইসু, ওকোনো মিয়াকি, শাবু শাবু, মিসো স্যুপ, ইয়াকিতোরি, ওনেগিরি, উদন, গিয়োদন, সোবা, ওমুরাইস, কাৎসুদন, গ্রিন টি জাপানের বিখ্যাত খাবারের অন্যতম। জাপানিজ খাবার ২০১৩ সালে ইউনেসকো হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

পৃথিবীর যেকোনো পর্যটক ঘুরতে বেরোনোর আগে নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার ভাবেন। বিশেষত সপরিবার কেউ যদি ঘুরতে বের হন, লেখকের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী জাপানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা অনন্য। পুরোপুরি নিরাপদ। আপনি যদি আপনার ব্যাগ, গাড়ি, সাইকেল কোথাও রেখে যান, কেউ তা ছুঁয়েও দেখবে না। দু-এক দিন প্রত্যক্ষ করার পর মালিক না পাওয়া গেলে নিকটস্থ থানায় তা জমা হবে। কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখলে পুলিশকে বলামাত্র জানপ্রাণ দিয়ে তারা আপনাকে সাহায্য করবে। এটাই তাদের পেশাগত দায়িত্ব।

জনবহুল টোকিও নগরীর মধ্যে সবুজের সমারোহ। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
জনবহুল টোকিও নগরীর মধ্যে সবুজের সমারোহ। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

দেশের মোট আয়তনের ৭৩ ভাগ পাহাড়। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, ঘন সবুজ বনাঞ্চল। দেশটির চারদিক সমুদ্রে ঘেরা। চারটি প্রধান দ্বীপের এ দেশ ৮টি বিশেষ অঞ্চল ও ৪৭টি প্রিফেকচারে ভাগ করা। ২০১৭ সালে বহির্বিশ্ব থেকে জাপানে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯১ হাজার ৭৩ জন পর্যটকের আগমন ঘটে, যা ২০১৮ সালে ৩ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৮৫৬ জনে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার ক্রমে বেড়েই চলেছে। সূত্র: জাপান ন্যাশনাল ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন: <tourism.jp/en/tourism-database/stats/inbound/#annual>

সূর্যোদয় ও ভূমিকম্পের দেশ নামে খ্যাত জাপান প্রকৃতির অন্যতম লীলাভূমি। এ দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ইতিহাসখ্যাত শহর হিরোশিমা সীমানায় অবস্থিত ইয়ামাগুচি প্রিফেকচার অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এলাকা। এর মোহনীয় রূপ যেকাউকে মুগ্ধ করে। ইয়ামাগুচি শব্দের অর্থ হলো পাহাড়ের মুখ।

লেখক ইয়ামাগুচি সিটি কর্তৃক সরকারিভাবে ‘ট্যুরিজম অ্যাম্বাসেডর’ মনোনীত বিধায় এ দেশের ট্যুরিজম সম্পর্কে সম্যক অবগত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকেও এ দেশে তুলে ধরার সুযোগ অর্জন করেছেন।

জাপানের নানা খাবার। ছবি: লেখক
জাপানের নানা খাবার। ছবি: লেখক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পুরাকীর্তি, সুস্বাদু খাবার ও আতিথেয়তায় অনন্য বাংলাদেশও বিশ্বের ভালো উদাহরণকে অনুসরণ করে অনতিবিলম্বে পর্যটনে সমৃদ্ধ হবে—সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।


আনোয়ার সাদাত: শিক্ষার্থী, ইয়ামাগুচি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপান সরকারি কর্তৃপক্ষ মনোনীত ‘ট্যুরিজম অ্যাম্বাসেডর’ ইয়ামাগুচি, জাপান।