ছায়াময়ী-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিছু করার না পেয়ে শেষমেশ শওকত গ্রামে হেঁটে বেড়াতে লাগল।

সমস্যা হচ্ছে, কোনো এক বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেই কেউ না কেউ ডাক দেয়। সবার একই প্রশ্ন, সে কার ছেলে, কার বাড়িতে এসেছে, কী করে ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন জিজ্ঞেস করল, তাদের টাকাপয়সা আছে কেমন। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে শওকত বিরক্ত হয়ে গ্রামের উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল।

মাঠের ওই ধারে ছোট নানার একটা বেশ বড়সড় ফলের বাগান। শওকত সেই বাগানে ঢুকে একটা গাছের নিচে বসে মোবাইলে গেম খেলতে শুরু করে দিল। কতক্ষণ পার হয়েছে শওকত জানে না, হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ওকে দেখছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে পেল না সে।

খচমচ আওয়াজ শুনে ওপরে তাকিয়ে দেখে, একটি মেয়ে গাছের ওপরে বসে কৌতূহলভরে তাকে দেখছে। শওকত এত অবাক হলো যে বলার না, এই মেয়ে কখন গাছে উঠল?

অস্বস্তিভরে শওকত বলে, ‘হ্যালো, আমার নাম শওকত। আমিনুল ইসলাম আমার নানা হন।’

মেয়েটি কোনো কথা না বলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে বলে মনে হচ্ছে। ছিপছিপে দেহ। কচি কলাপাতা রঙের সালোয়ার–কামিজ পরা। ওড়না কোমরে পেঁচিয়েছে। আলুথালু চুলের ফাঁকে বড় বড় চোখ।

শওকত আবার বলে, ‘তুমি গাছে কখন উঠলে? আমি তো অনেকক্ষণ ধরে এই গাছের নিচে।’

এবারে মেয়েটি চিকন কণ্ঠে বলে, ‘তোমার হাতে কী?’

শওকত মোবাইলটা নেড়ে বলল, ‘এটা? এটা শাওমি ফোন। আমি আইফোন চেয়েছিলাম, আম্মু দাবড়ানি দিয়ে এটা কিনে দিয়েছে।’

‘ফোন?’ মেয়েটি মাথা ঝাঁকায়, ‘ফোন এই রকম? ফোনে তো গোল ডায়াল থাকে, বড় রিসিভার থাকে। এটা ফোন কেমনে?’

শওকত এবারে সত্যিকার অর্থে অবাক হয়। সদরে ইন্টারনেট পর্যন্ত আছে। গ্রামে প্রতিটি ঘরে অন্তত একটা করে মোবাইল ফোন আছে। আর এই মেয়ে মোবাইল চেনে না?

শওকত বলে, ‘এটা মোবাইল ফোন। এখানে ডায়াল হচ্ছে স্ক্রিনে আর রিসিভার ফোনের ভেতরেই। এটা দিয়ে ছবি তোলা যায়, গেম খেলা যায়, নেট ব্রাউজিং হয়—মোটকথা খাবার রান্না করা ছাড়া আর সবকিছুই এই ফোন পারে।’ নিজের জোকসে নিজেই হাসে শওকত।

মেয়ে চোখ সরু করে তাকায়, ‘কই দেখি?’

শওকত মোবাইলটি বাড়িয়ে দেয়।

মেয়েটি নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু হাত পৌঁছায় না।

‘তুমি একটু গাছে ওঠো, তাহলে ভালো করে দেখতে পারব।’

শওকত মাথা চুলকায়। এই জনমে সে কোনো গাছে ওঠেনি। তা–ও ছোটখাটো পেয়ারাগাছ হলে চেষ্টা করে দেখত। বিশাল এক আমগাছে মেয়েটি বসে আছে।

শওকত বলল, ‘ইয়ে…মানে, গাছে চড়া ভালো না। পিঁপড়া কামড় দেবে, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙতে পারে। তুমি বরং নিচে নেমে এসো।’

মেয়েটি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে, ‘হি-হি-হি, তুমি কেমন মানুষ? গাছে তো ক্লাস ওয়ান–টুর বাচ্চাও চড়তে পারে।’

অপমানে শওকতের কান লাল হয়ে যায়। ঝাঁজালো স্বরে বলে, ‘আমি শহরের মানুষ। ঢাকায় কোনো গাছ নেই, আছে উঁচা বিল্ডিং। আমি বিল্ডিং বেয়ে তিরিশ তলা উঠতে পারি, তুমি পারো?’

চোখ বড় করে তাকায় মেয়েটি, ‘বিল্ডিংয়ের দেয়াল বেয়ে?’

শওকত কাঁধ ঝাঁকায়, ‘না, হয় সিঁড়ি কিংবা লিফট দিয়ে! ওপরে ওঠা নিয়েই তো কথা!’

মেয়েটি হাসতে থাকে, ‘হি-হি-হি তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি একটু বেকুব কিসিমের। কিন্তু আসলে পেটে অনেক বুদ্ধি।’

রাগ করতে গিয়েও শওকত হেসে ফেলে। ‘তা তুমি কি নিচে নামবে নাকি আমি মইয়ের খোঁজে যাব?’

চোখের পলকে মেয়েটি গাছ বেয়ে নেমে আসে। শওকত দেখে হাঁ। মনে হলো ভিডিও গেমের কোনো ক্যারেক্টার কয়েন কালেক্ট করার জন্য মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে নিচে নামল।

মেয়েটি সতর্কভাবে মোবাইল উল্টে–পাল্টে দেখে। শওকত তাকে ফোনের ডায়াল দেখাল। নোটবুকে নোট করা দেখাল। দুজনে মিলে একটি সেলফি নিল। ছবি দেখে মেয়েটি হতভম্ব। বারবার করে বলল, কী সুন্দর! কী সুন্দর! তবে ছবি এখন প্রিন্ট করা যাবে না শুনে একটু মন খারাপ করল। শওকত তাকে কথা দিল, ঢাকা থেকে ছবি প্রিন্ট করে সে তাকে পাঠিয়ে দেবে।

‘আচ্ছা তুমি ম্যাট্রিক পাস দিছ?’

শওকত মাথা নাড়ে, ‘না, আমি ও–লেভেল কমপ্লিট করেছি। এখন এ–লেভেলে।’

‘এইগুলা কী? ম্যাট্রিক হয় নাই?’

শওকত পরিস্থিতি বিবেচনা করে বুঝল, অনেক কথা বলতে হবে এখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। যেগুলো নিজেও সে ঠিক ভালো জানে না। তাই বলল, ‘হ্যাঁ, ধরো আমি ম্যাট্রিক পাস করে ফেলেছি। এখন ইন্টারে পড়ছি। তুমি?’

মেয়েটি হিংসার দৃষ্টিতে তাকায়, ‘আমার ম্যাট্রিক পাস করার অনেক শখ ছিল। আর এক বছর পরেই আমার পরীক্ষা ছিল। দিতে পারি নাই।’

শওকত সান্ত্বনা দেয়, ‘অসুবিধা নেই, আগামী বছর দিয়ো। কত কারণে মানুষের ইয়ার লস যায়।’

‘নাহ, আমি আর কখনোই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারব না।’

‘কেন?’

জবাবে মেয়েটি মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শওকতেরও মন খারাপ হয়ে যায়। গ্রামে একটি মেয়ের না জানি কত অজানা ভয়ংকর সমস্যা থাকতে পারে। যে পড়াশোনা জোর করে তাকে গিলিয়ে দেওয়া হয়, সেটি অন্য কারও কাছে সোনার হরিণের মতো আরাধ্য বস্তু। শওকত তাই প্রসঙ্গ পাল্টায়, ‘আচ্ছা তুমি গেম দেখবে? আমার ফেবারিট গেম হচ্ছে এই যে এইটা। খেলবে? খুব মজা!’

মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে তাকায়, ‘কীভাবে খেলব?’

‘এই যে, এইগুলা হচ্ছে শয়তান লোক। এরা তোমার রাজ্য আক্রমণ করতে আসছে। নিজের রাজ্যকে বাঁচাতে হলে তোমার যুদ্ধ করতে হবে।’ বলে ভয়ংকর শব্দে গুলি চালিয়ে শওকত এক রাক্ষস ধরনের ভিলেনকে উড়িয়ে দেয়।

মেয়েটি অবাক হয়ে খানিকক্ষণ শওকতের খেলা দেখে, তারপরে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে বলে, ‘তোমার কাছে যুদ্ধ, মারামারি এসব মজা লাগে?’

শওকত থতমত খেয়ে যায়, ‘না, না, আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না। কিন্তু এটা তো গেম, মিথ্যামিথ্যা। আনন্দের জন্য।’

মেয়েটি হঠাৎ শওকতের হাত ধরে, ‘এটা মজার জিনিস?’

শওকত চিন্তায় পড়ে, ‘ইয়ে, কী জিনিস?’

‘চলো!’

বলেই মেয়েটি দৌড় দিল। শওকত কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও দৌড়াতে শুরু করে। মেয়েটি অসম্ভব দ্রুত দৌড়ায়। শওকত বেচারা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে যায়। মেয়েটি একটু পরপর থেমে কটাক্ষ করে, ‘কী, যুদ্ধের জেনারেলের মনে হয় পায়ে নূপুর?’ শওকতের সেটার উত্তর দেওয়ার মতো এনার্জি নেই। ছুটতে ছুটতে একটা ব্রিজের কাছে এসে মেয়েটি থামে। শওকত ব্রিজের রেলিং ধরে বুকে হাত দিয়ে ধুলার মধ্যেই বসে পড়ে। এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে আজকে তার জীবন শেষ।

‘এই...যে...মানে...এটা...কোথায়...।’

মেয়েটি ঠোঁটে আঙুল রাখে, ‘শশশ, কথা বলো না। এটা খুবই বিপজ্জনক একটা সেতু। খুব সাবধান।’

শওকত চোখ বুলিয়ে বিপদের কিছু বুঝতে পারল না। সেতুটা ভাঙাচোরা, সেটা অবশ্যই একটা বিপদের কারণ হতে পারে। এক পাশ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত। মানুষ চলাচল করতে পারবে হয়তো, কিন্তু ভ্যান-রিকশা চলার সম্পূর্ণ অনুপযোগী। সেতুর নিচে ধানি জমি। বাতাসে সবুজ ধানগাছগুলো এদিকে–ওদিকে দুলছে। সাপ আর জোঁকের ভয় ছাড়া শওকত আর কোনো বিপদের চিহ্ন খুঁজে পেল না।

মেয়েটিকে সেটি বলতে যেতেই শওকত হতভম্ব। মেয়েটি যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে, কোথাও নেই। ডাকতে গিয়ে শওকতের খেয়াল হয় যে সে মেয়েটির নাম জানে না। এখান থেকে বাসায় ফিরে যাওয়ার রাস্তাও সে চেনে না। মেয়েটি নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে তাকে এ রকম বিপদে ফেলে মজা নিচ্ছে। সেতুর রেলিং ধরে উঠে দাঁড়িয়ে শওকত বরফের মতো জমে যায়। কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। হয় তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে অথবা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার মতো সে প্যারালাল কোনো জগতে চলে এসেছে।

ম্যাজিকের মতো সেতুর দৃশ্যপট এখন বদলে গেছে। ভাঙা অংশ আর দেখা যাচ্ছে না, একদম সাধারণ এক সেতু। টিং টিং শব্দে এক সাইকেল তার পাশ ঘেঁষে চলে গেল, শওকত লাফ দিয়ে সরে যেতেই চোখে পড়ল নিচের ধানি জমি আর নেই। সেখানে রাজ্যের পানি এসে জমা হয়েছে। মনে হচ্ছে বেশ গভীর একটা ঝিল। চারপাশ আরও অনেক বেশি সবুজ আর নির্মল। শওকত কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে চিমটি কাটে—প্লিজ আল্লাহ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দাও। আমি নিশ্চয়ই আমগাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছি। প্লিজ আল্লাহ আমাকে জাগিয়ে দাও।

সহসাই মেয়েটিকে দেখতে পায় সে। পরিপাটি করে চুল বেণি করে মাথার ওপরে বাঁধা, সালোয়ার–কামিজের রংও ভিন্ন। আঁতকে উঠে শওকত দেখে, মেয়েটি হাতে একটি স্টেনগান নিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকছে। শওকত চিৎকার করে ডাকলেও সে তাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে। শওকত ভয়ে ভয়ে তাকে অনুসরণ করে।

জঙ্গলের ভেতরে একটু খোলা জায়গা। সেখানে প্রায় সাত-আটজন তরুণ-কিশোর হাসাহাসি করে ডাল-রুটি খাচ্ছে। তেজি সব চেহারা তাদের। শওকত অবাক হয়ে দেখে, তাদের প্রত্যেকের পাশে অস্ত্র আর গুলির বাক্স। মেয়েটি এগিয়ে যেতেই তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী একজন তরুণ গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করে, ‘কী খবর ইনফরমার?’

বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি উত্তর দেয়, ‘খবর পাকা। ছয়টা জিপ নিয়ে বদমাইশের বাচ্চারা সাতপাড়া আক্রমণ করতে আসবে। তাদের আনতেছে রাজাকার করিমুদ্দীন।’ একটু থেমে সে যোগ করে, ‘রুবেল ভাই তার বাড়িতে দেখা করতে গিয়া ধরা পড়ছে। করিমুদ্দীন ধরায়ে দিছে। তার বাড়িতে আগুন দেওয়া হইছে।’

দাঁতে দাঁতে ঘষে তরুণ, ‘হারামজাদারে আমি নিজে গুলি করে মারব। পাকিস্তানিদের ওপর আমার এত ঘৃণা নাই যতটা না এই বেজন্মা রাজাকারগুলার ওপরে। বেইমান!’

ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলের এক তরুণ বলে, ‘তাইলে আমাগো প্ল্যানটা কী জামিল ভাই?’

‘প্ল্যান সহজ। হাতে গুলি বেশি নাই। ব্রিজ উড়ায় দিতে হবে। বোমাও খুবই অপ্রতুল। পুরা ব্রিজ ভাঙা যাবে না। উত্তর দিকটা ধসায় দিতে হবে। তাহলেই পুরা ব্রিজ যাবে আনস্টেডি হয়ে। হারামজাদারা সাঁতার জানে না। আর আমরা থাকব পেছনের এই জঙ্গলে। ব্রিজের ওপর দুইটা গাড়ি উঠবে ম্যাক্সিমাম, তখনই বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। তারপরেও পিছে থাকবে চারটা জিপ।’

জামিল নামের ছেলেটি চারপাশে একবার তাকিয়ে নেয়।

‘আমাদের দুজনের একটা করে জিপ, কী বলো ইমরান?’

ইমরান নামের ছেলেটা হাসে, ‘আমি একাই তিনটা নেব! বাকি একটা আপনারা সবাই মিলে নেন!’

সবাই উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে।

শওকতের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই সামান্য অস্ত্র আর গুলি নিয়ে আটজন ছেলে পাকিস্তানি সেনাদের ছয়টা জিপ আক্রমণ করবে? এদের কি জানের মায়া নেই?

তার প্রশ্নের উত্তর দিতেই মনে হয় জামিল বলে ওঠে, ‘আমাদের আজকের মিশন সুইসাইড মিশন। আমরা কোনোভাবেই জিততে পারব না। কিন্তু হাটখোলার আরেক প্রান্ত থেকে চল্লিশজনের এক বাহিনী আসতেছে। আমরা যদি জিপ দুই ঘণ্টাও দেরি করাইতে পারি, ওরা এসে ঝাঁঝরা করে দেবে পাকিস্তানিদের। জেনে রাখো মুক্তিযোদ্ধারা, আমাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ আমাদের ভাইবোনেরা নেবেই। কেউ আমরা ধরা পড়ব না। হয় মারব, নয় মরব; কিন্তু কেউ আমরা ধরা পড়ব না। বলো রাজি?’

উত্তরে তীব্র আবেগে সবাই মুষ্টিবদ্ধ করে, ‘জয় বাংলা!’

জামিল হাসিমুখে মেয়েটির দিকে তাকায়, ‘তাহলে ইনফরমার? বোমাটা উড়াতে যাবে কে?’

মেয়েটি ভ্রু উঁচু করে, ‘আমি ছাড়া আপনাদের উপায় আছে?’

রুদ্ধশ্বাসে শওকত গাছের আড়াল থেকে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি সাঁতরে গিয়ে কচুরিপানার আড়ালে পজিশন নেয়। আটটি ছেলে বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়েছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো খেলায় অংশ নিচ্ছে। শান্তভাবে তারা অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিপের শব্দ শোনা গেল। সবুজ রঙের জিপগুলো সতর্কভাবে আসছে। ব্রিজের কাছে এসে তারা থেমে যায়। দুজন নেমে ব্রিজ পরীক্ষা করে, এরপর সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে নির্দেশ দেয় বাকিদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। দুটি জিপ যখন ব্রিজের ওপরে আর একটা মাত্র উঠতে শুরু করেছে তখনই মেয়েটি কচুরিপানার ভেতর থেকে নিখুঁতভাবে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর মিলিটারিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে।

এত কাছ থেকে বোমার আওয়াজ শওকত কখনো শোনেনি। কানে তালা মেরে দেওয়ার মতো ভয়ংকর শব্দ করে ব্রিজের একাংশ ধসে পড়ে এবং জিপগুলো ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে যায়। প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে পেছনের জিপের সৈন্যরা। মুক্তিবাহিনী পাল্টা গুলি ছোড়ে। কিন্তু তারা দশটির জবাবে গুলি ছোড়ে একটি, ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাওয়াই তাদের উদ্দেশ্য।

যখন মনে হচ্ছিল মুক্তিবাহিনী তাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পেরেছে, তখনই আকস্মিকভাবে পেছন থেকে আরও চারটি জিপভর্তি মিলিটারি চলে আসে। এই চারটির খবর তাদের জানা ছিল না। সবার প্রথমে সাতপাড়ার মাটি রক্তাক্ত হয় ইমরানের রক্তে। দেশের পতাকার লাল বৃত্ত আঁকতে এরপরে নিজের রক্ত দেয় জামিল। শওকতের সামনে একে একে লুটিয়ে পড়ে সাহসী–তেজি অপূর্ব একেকজন যোদ্ধা। শওকত চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে যায় মিলিটারির প্রবল গুলিবর্ষণে।

শান্ত রণাঙ্গনে মিলিটারিদের উল্লাসধ্বনি কানে আসতে শওকত দুই হাতে কান চেপে ধরে। টগবগ করে ফুটছে তার রক্ত। ঠিক তখনই ব্রিজের অন্য পাশ থেকে শুরু হয়ে গুলিবর্ষণ। চলে এসেছে মুক্তিবাহিনীর দলটা। সমস্ত খেলা সাঙ্গ হতে মিনিট ত্রিশের বেশি সময় লাগে না। সম্মুখসমরে দেশের মাটিতে নিজেদের পতাকা আরেকবার বসায় মুক্তিবাহিনী। শওকত ছলছল চোখে তাদের দেখে। জামিলদের দল তাদের কাজ নিখুঁতভাবে করেছে। তারা বেঁচে থাকতে চায়নি, শুধু চেয়েছে কেউ এসে তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিক। কেউ এসে স্বাধীন একটা বাংলাদেশ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলুক।

কয়েকজন পানি থেকে একটা শরীরকে টেনে তোলে। শওকত না চাইলেও সেদিকে তাকায়। মেয়েটির শরীরের এত জায়গায় গুলি লেগেছে যে তাকে চেনা মুশকিল। তবে তার মুখের হাসি আগের মতোই আছে। বাংলার মাটি পরম আদরে তার এক সাহসী কন্যাকে জড়িয়ে ধরে।

শওকত কতক্ষণ কেঁদেছে সে জানে না। হঠাৎ সে চোখ খুলে দেখে যে দৃশ্যপট ঠিক আবার আগের মতো হয়ে গেছে। ১৯৭১ থেকে কখন যেন সে আবার ২০২০-এ চলে এসেছে। মেয়েটি ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে।

‘এখন বলো দেখি, কে বেশি ভালো গুলি করে? তুমি না আমি?’

নির্বাক শওকত ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।

মেয়েটি হাসিমুখে বলে, ‘কেঁদো না। তোমরা সবাই যদি আমাদের ভুলে যাও, তাহলে আমরা থাকব কী করে বলো! এই জন্য মনে করায়ে দিলাম। তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম। এই যে সামনের এই রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে যাও। তারপরে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তোমার বাসা দেখায়ে দেবে।’

শওকত বহু কষ্টে প্রশ্ন করে, ‘তোমার নাম কী?’

কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটি বাতাসে মিলিয়ে যায়।

রাত্রে ছোট নানি ভীষণ ঝাল মুরগির মাংস আর ঘন ডাল রান্না করেছেন। শওকত খাবার নিয়ে শুধু খুঁটছে দেখে ছোট নানা বলেন, ‘ইশ্‌, তোর নানি বেশি ঝাল দিছে, না? বারবার বলি এরা শহরের ছেলে, ঝাল খাইতে পারে না। তারপরেও ঝাল দেবে।’

‘না নানা, খুব মজা হয়েছে। আমি আসলে একটা কথা ভাবছিলাম।’

‘কী কথা?’

‘ওই যে গ্রামে একটা ব্রিজ আছে না, ভাঙা? আজকে ওই দিকে গিয়েছিলাম।’

‘কোন ব্রিজ? ছায়াময়ীর ব্রিজ? ওইখানে তো আর চলাচল করা যায় না। তবে জমি ভালো। সুন্দর জায়গা। এত দূর একা চলে গেছিলা!’

‘ছায়াময়ীর ব্রিজ?’

ছোট নানা হাসেন, ‘হ্যাঁ। আমাদের গ্রামে পনেরো বছরের সাহসী এক মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। মেয়েটার নাম ছিল জয়নব। সে একলাই ওই ব্রিজ উড়ায়ে দিছিল যুদ্ধের সময়। স্বাধীনতার পর লোকজন খামোখা ওই জায়গায় যেতে ভয় পায়। কেউ কেউ নাকি সেই মেয়েকে দেখে। লোকের মুখে মুখে এখন ওই জায়গার নাম হইছে ছায়াময়ীর ব্রিজ। সে এক দুর্দান্ত সাহসিকতার গল্প। তোমারে খাওয়ার পরে শোনাব।’

শওকত দ্রুত মোবাইল বের করে জয়নবের সঙ্গে তোলা সেলফিটি বের করে। যা ভেবেছিল তা–ই। ছবিতে শুধু তাকে দেখা যাচ্ছে। পাশের জায়গাটি খালি। শওকত মোবাইল বন্ধ করে। তার চোখের সামনে ভাসে অস্ত্র হাতে সাহসী এক কিশোরীর অবয়ব, এক ছায়াময়ীর মুখ। (শেষ)
–––

সামারা তিন্নি: অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া।