পিরুর অমীমাংসিত জীবন

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

এত ভোরে কেউ এ রকম গভীর গান শোনে না। কিন্তু পিরু শুনছে। কলিম শরাফীর কণ্ঠে খান আতাউর রহমানের লেখা গান।

‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে/ সেই দুঃখে চোখেরও পানি/ ও আমার চক্ষু নাই/ পাড় নাই কিনার নাই রে/ ও আমার চক্ষু নাই/ ঘর নাই ও মোর জন নাই/ তবু দিলাম ভাঙা নায়ে/ অথৈ সায়র পাড়ি...।’

পিরু গানের মানে বোঝার চেষ্টা করছে। যার চোখ নাই তার কেমন করে চোখের পানি ঝরে। তার দুঃখই বা কীভাবে প্রকাশ পায়। যে মাঝির পাড়, কিনার কিছুই নাই, সেই বা কী করে ভাঙা নায়ে সায়র পাড়ি দিতে চায়।

এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই অমীমাংসিত। অন্যকে নিজের কাছে, নিজেকে অন্যের কাছে। রাজা-রানির কাছে প্রজা, প্রজার কাছে রাজা-রানি। ইতিহাসের কাছে মানুষ, মানুষের কাছে ইতিহাস। অনেক কিছুরই উত্তর নেই। থাকে না। থাকবে না। এটাই নিয়ম। এভাবেই চলছে। চলবে অনন্তকাল।

পিরু ব্যাপারটা আরেকটু গভীরে ভাবতে চেষ্টা করল। কেন এমনটি হয়। তার ভাবেরও কোনো কুল নাই। কোথা থেকে শুরু করবে তা–ও সে জানে না। চোখ বন্ধ করে সে অনেক কিছু ভাবতে চেষ্টা করল।

কিন্তু তার ভাবনাগুলো এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন, ভবঘুরে। কখনো সে সাহারা মরুভূমির বুকে ছুটে চলা উটে বসা এক বেদুইন। পরক্ষণেই সে আবার নিউইয়র্কে শহরের হাইওয়েতে ছুটে চলা উবার ড্রাইভার। কখনো বিশাল অট্টালিকার ভেতর শুয়ে-বসে থাকা আরামপ্রিয় সফল মানুষ। কখনো সে তরুণ, কখনো বৃদ্ধ। কখনো নায়ক, কখনো ভিলেন। পিরু জানে না, কোনটা তার আসল পরিচয়। সে আসলে কে? কোথায় ফিট হয়। জীবনের প্রতি তার কী কর্তব্য, কী করা উচিত। হোয়ার হি বিলংস টু।

এলোমেলো চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি পেতে সে চোখ মেলে তাকাল। সকাল হয়ে গেছে। তার চিরাচরিত ঘুম ভাঙার সময়ও তখন অতীত হয়ে গেছে। জানালার কাছে এসে বাইরে তাকাল। বাইরে নিউইয়র্ক শহরের রংচটা দালানের সারি। সে থাকে জ্যামাইকার এগারোতলা অ্যাপার্টমেন্টে। বিশাল উন্মুক্ত আকাশ এই শহরকে ঢেকে দিয়েছে। কোথাও সূর্যের আলো পুরোপুরি প্রবেশ করতে পারে না। একটু–আধটু শূন্যতা পেলে ধারালো আলো সামনে ঝুঁকে পড়ে।

নিদ্রাহীন নিউইয়র্ক শহর তার চিরাচরিত নিয়মেই ব্যস্ত। একটা দ্রুতগামী অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। পেছন পেছন অনেকগুলো গাড়ি সেই ফাঁকা রাস্তার সুযোগ নিল। এ জীবনে সবারই তাড়া শুধু সে ছাড়া। আজ তার ছুটি। এ ছুটি তার কাম্য। মাঝেমধ্যেই সে নিজেকে এভাবে ছুটি দেয়। এ দিনটিতে সে কোনো কিছুই কর্তব্যের মধ্যে রাখে না। এমনকি চিন্তাভাবনাও থাকে শূন্য। ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নেয় সে কী কী করতে চায় বা করবে। কোথায় যাবে, কার সঙ্গে দেখা করবে ইত্যাদি। অনেকটা সময় নিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে। হয় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। তারপর কিছু একটা করা যা মনে হয়। এদিন গান শোনা ছাড়া সে মোবাইল ফোনকেও দূরে রাখে।

পিরু চটপট তৈরি হয়ে নেয়। আজকে সে যাবে ব্যাটারি পার্ক হয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি। তারপর জার্সি সিটি। সারা দিন একা একা ঘুরে কাটাবে। গাড়ি নেবে না। বাসে চড়ে ঘুরবে। খাবে স্ট্রিট ফুড। রংবেরঙের মানুষ দেখবে। পৃথিবীর সব পদের মানুষ দেখতে চাইলে এই শহরের চেয়ে ভালো কিছু থাকতে পারে বলে তার জানা নেই। নিচে নেমে সে গেল কফি কিনতে। দোকানের নাম গডস কফি। রাস্তা আর কফি শপের দরজার পাশে একজন বয়স্ক ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে। সাদা চামড়ার ভিক্ষুক। ভাংতি পয়সা চায়। অবিরাম বলে চলেছে, গড ব্লেস ইউ, গড ব্লেস ইউ, গড ব্লেস ইউ। গডস কফির পাশে গডস ব্লেসিং শুনতে খারাপ লাগে না।

পিরু পকেট থেকে দুই ডলার বের করে ভিক্ষুকের হাতে গুঁজে দিল। কাঁপা হাতে ভিক্ষুক সেই ডলার নিজের নোংরা পকেটে লুকিয়ে রাখল। দুবার বলে উঠল গড ব্লেস ইউ মাই ফ্রেন্ড।

বাসে পিরুর পাশে বসল একটা একুশ কি বাইশ বছরের শ্বেতাঙ্গ মেয়ে। ভদ্রতাসুলভ হাই, হ্যালো বলতে বলতে মেয়েটির সঙ্গে পিরুর কথোপকথন অনেকটা গভীরে গেল। আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পিরু বেশ সাবধানতা অবলম্বন করে। বিশেষ করে যদি কোনো শ্বেতাঙ্গ মেয়ে হয়। এতগুলো বছর আমেরিকায় থাকায় মানুষের আঙ্গিক, ভাষা সে বেশ বুঝতে পারে। আগ বাড়িয়ে কখনোই কথার গভীরে যায় না। যদি না আগন্তুক ততটুকু আগ্রহ দেখায়। কথায় কথায় জানল, মেয়েটির নাম সিলভিয়া। পড়ে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সে–ও যাচ্ছে স্ট্যাচু অব লিবার্টির দিকে। ওখানে কারও সঙ্গে নাকি দেখা হবে। হয়তো ডেট কিংবা অন্য কিছু।

: কেমন আছ? সিলভিয়াই কথা শুরু করেছিল।

: ভালো আছি। তুমি কেমন?

: এই উদ্ভট পৃথিবীতে ভালো থাকা বিরাট চ্যালেঞ্জিং কিন্তু তারপরও বলব ভালো আছি।

: উদ্ভটের কী হলো? পিরুর প্রশ্ন।

: সত্যিই কি শুনতে চাও?

: শুনতে আপত্তি নেই যদি বলতে চাও। আমাদের গন্তব্যের তো আরও কিছুটা পথ বাকি।

: আজ সকালে এই বাসে চড়ার আগে একটা ঘটনা ঘটেছে।

: কী সেটা?

: আমি কফি নিয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একটা বৃদ্ধমতো লোক ওখানে ভিক্ষা করছিল আর বারবার আমাকে দেখছিল।

: হ্যাঁ, আমিও দেখেছি। তাকে আগে কখনো ওখানে দাঁড়াতে দেখিনি। পিরু উৎসাহী কণ্ঠে বলল।

: সে আমাকে এমনভাবে দেখছিল যা চোখে পড়ার মতো। আমি কাছে গিয়ে তাকে পাঁচ ডলার দিলাম। আফটার অল, ও তো হোমলেস, গরিব। সিলভিয়া বলে চলল। আমি ওর হাতে ডলার গুঁজে দিয়ে চলে আসব এমন সময় ও আমার হাত ধরল। আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার পাশে থাকায় সাহসও পাচ্ছিলাম। জানো, ওর মুখ থেকে ভরভর করে অ্যালকোহল আর সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছিল।

নিজের হাত ছোটাতে যাব এমন সময় আমার মুখের কাছে মুখ এনে সে বলল—তোমার নাম কি সিলভিয়া ব্রেইনার্ড, তোমার মায়ের নাম কি ম্যারি ব্রেইনার্ড, তোমার একটা আংকেল আছে নাম মাইক মুজাক। তুমি কি জার্সি সিটিতে বড় হয়েছ। তোমার বাঁ পায়ের হাঁটুর দিকে একটা বার্থ মার্ক আছে।

জানো, একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন শুনে আমি হতবাক। সে কাঁপা কাঁপা হাতে তখনো আমার হাত ধরে আছে। আমি আমার হাত ফিরিয়ে নিইনি। নিতে ভুলে গেছি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

: তুমি কী করলে? তোমার ব্যাপারে ও যা যা বলেছে তা কি ঠিক ছিল? কেনই–বা ও তোমাকে ওগুলো বলতে গেল? পিরুর প্রশ্ন

: হ্যাঁ, আমার ব্যাপারে ওর সব কথাই ঠিক ছিল।

: তুমি কী করলে?

: তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করলাম যে আমার ব্যাপারে এত কিছু সে জানে কী করে। সে কে? কী তার পরিচয়।

পিরুর প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই সিলভিয়া বলে চলল, লোকটা আমার বায়োলজিক্যাল বাবা। যখন হাত ধরেছিল তখন বুঝতে পারিনি। আমার শৈশবে মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সে পুরোপুরি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অ্যালকোহল প্রবলেম তার আগেও ছিল কিন্তু আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তার আসক্তি আরও বাড়ে। নিউ জার্সির বাড়ি বিক্রি করে চলে আসে নিউইয়র্ক শহরে। কিছুদিন এদিক-ওদিক কাজকর্ম করে চলতে থাকে। আসক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটে। হয়ে যায় ভবঘুরে, নিরুদ্দেশ। আমার কিশোরী বয়সে শহরের এদিক-ওদিক গেলে তাকে খুঁজতাম। অনেক খুঁজেছি। পাইনি। তারপর ধীরে ধীরে স্মৃতির পাতা থেকে সে মুছে যেতে থাকে। আমি প্রায় ভুলেই গেছি।

পিরু সিলভিয়ার দিকে একপলক তাকাল। ওর নীল চোখ আর মুখের ওপর চলে আসা সোনালি চুলের মাঝখানে অশ্রু গঙ্গা বয়ে চলেছে। সিলভিয়ার কাছে পিরুর অনেক অনেক প্রশ্ন। জীবনে এই পর্যন্ত সে কীভাবে এল? কখনো কি তার জীবনে বাবার প্রয়োজনীয়তা ছিল? এখনো কি আছে? ভবঘুরে বাবা কীভাবে তাকে খুঁজে পেল? কেনই–বা সে খুঁজে চলেছিল? কেন? কেন? হারানো বাবাকে পেয়ে এখন সে কী করবে? কী তার কর্তব্য?

শোঁ শোঁ করে বাস হাইওয়েতে ছুটে চলেছে। সিলভিয়ার দৃষ্টি আটকে আছে সামনে জানালার ওপাশে কালো পিচের হাইওয়েতে। পিরু ব্যাপারটা আরেকটু গভীরে ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার ভাবনাগুলোও ভবঘুরে, হোমলেসদের মতো বিচ্ছিন্ন। কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পারে না। আজ ভোরের মতো। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হেডফোন দিয়ে সে কান ঢেকে দিল। ফোনে একটা গান ছাড়ে। অনেক বিখ্যাত ও প্রিয় একটা গান। লুইস আর্মস্ট্রংয়ের হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড। বাস ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলে। পিরু ডুবে থাকে তার ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড গানের ভেতর। তার এলোমেলো ভাবনাগুলো গানটির বাংলা সংস্করণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাবনাগুলো পুরো বাস দখল করে সমস্বরে গাইতে থাকে—

আহা! কী অপূর্ব এই পৃথিবী!
আমি সবুজে ঘেরা গাছগাছালি দেখি
তাদের মাঝে লাল গোলাপ প্রস্ফুটিত
তোমার ও আমার জন্য
বিস্ময় নিয়ে ভাবি আহা! কী সুন্দর এই পৃথিবী!

আহা! কী অপূর্ব এই ধরিত্রী,
আমি নীলাবরণে ঢাকা আকাশ দেখি
সঙ্গে শ্বেতশুভ্র মেঘের মাখামাখি
একটা উজ্জ্বল আশীর্বাদপুষ্ট দিন,
আর পবিত্র অন্ধকার রাত।
অতঃপর নিজেকেই বোঝাই আহা! কী সুন্দর এই আরাধনা! কী সুন্দর!
–––

জামাল সৈয়দ: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>
ফেসবুক: <Jamal.MN>