মানবিক বাংলাদেশের অপেক্ষায়

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

একটি সমাজ বা জাতি কত উন্নত, তা দেখতে চাইলে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি দেখেই মাপলে হবে না; সঙ্গে সঙ্গে তারা কতটুকু মানবিক, তাও দেখতে হয়।

মানবিক না হলে মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আবার যন্ত্রও অমানবিক লোক থেকে অধিকতর শ্রেয়। তাই উন্নত জাতি হতে হলে অমানবিক নয়, যন্ত্রও নয়, বরং যন্ত্র থেকে অধিকতর ভালো ও যন্ত্রকে ‍নিয়ন্ত্রণ করার মানবিক সক্ষমতা থাকতে হয়।

আমি প্রধানত একটি কেমিক্যাল ল্যাবে কাজ করি। মাঝেমধ্যে প্রাসঙ্গিক কিছু কাজে অন্য একটি বায়োলজি ল্যাব ব্যবহার করতে হয়।

আমাদের মূল কাজ যেহেতু বায়োলজি নয়, তাই সচরাচর এটিতে কাজ করা হয় না। আর আমার ব্যাকগ্রাউন্ড বায়োলজি হওয়ায় ও সার্টিফিকেশন থাকায় অন্য গ্রুপের বায়োলজি কাজ থাকলে আমারই করতে হয়। বিনিময়ে আর্টিকেলে নাম থাকবে, এটা নিশ্চিত।

এটা কখনো আমাকে মনে রাখতে হয় না। এটা মনে রাখা বরং যাঁর কাজ করছি তাঁরই মাথাব্যথা। তিনি যদি আমার সাহায্যের কথা ভুলে যান, সেটা তাঁর অপরাধ।

মাসখানেক আগে আমাদের সেফটি অফিসার এসে জানতে চাইলেন, আমি বায়োলজি ল্যাবে কাজ করছি কি না।

আমি বললাম, কাজের মাঝখানে আছি। শেষ করতে আরও পাঁচ–সাত দিন লাগবে।

সেফটি অফিসার বললেন, পরদিন আমি যখন ল্যাবে যাব, তাঁকে যেন আগে অবহিত করি। তিনি সঙ্গে থাকবেন।

সেফটি অফিসার সঙ্গে থাকতে ও ল্যাবরেটরি প্র্যাকটিস দেখতে পারেন। পরদিন ল্যাবে যাওয়ার আগে আমি আমার ল্যাব ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালগুলো একটু রিভিউ করে নিলাম।

পরদিন আমরা দুজন একসঙ্গে ল্যাবে গেলাম। আমি আমার কাজগুলো করতে লাগলাম অতি সতর্কতার সঙ্গে। সেফটি অফিসার সঙ্গে বলে কথা।

আমি ঘণ্টা দুই কাজ করে গেলাম। আর তিনি ল্যাবে এদিক–সেদিক পায়চারি করলেন। একটিবারও আমার কাছে এলেন না। এটি আমাকে একটু অবাক করল। কাজ শেষ করলাম।

আমার কাজ সেদিনের মতো শেষ। তাঁকে বললাম, আপনি কি যেতে চান?

সেফটি অফিসার বললেন, হ্যাঁ, চলো যাই। তবে দেখো এই ল্যাবের এয়ার কোয়ালিটি ভালো না (যদিও আমার তেমন খারাপ কিছু মনে হয়নি)। তুমি কখনো একা এখানে কাজ করতে এসো না। সঙ্গে কমপক্ষে একজনকে রেখো। অসুস্থ হয়ে গেলে কেউ সাহায্য করতে পারে।

তিনি বারবার অনুরোধ করলেন প্রতিদিনের ‍সিডিউল শেয়ার করার জন্য। তিনি সঙ্গে থাকবেন যত দিন না এই সমস্যার সমাধান হয়।

তাঁরা কত মানবিক। একটি ইনজুরি বা লাইফ নিয়ে কত সচেতন, এমনকি সেটি যদি দুর্ঘটনায়ও হয়। তাঁদের কাছে সেফটি অনেক বড় ব্যাপার। তাঁরা কাজপাগল হলেও সেফটি সবার আগে।

ফেনীর নুসরাত হত্যার রায়ের পরদিন আমাদের ল্যাবের এক কানাডিয়ান জানতে চাইছিলেন, কী ঘটেছিল যে এতগুলো মানুষের (১৬ জন) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।

শুধু নুসরাত নন, সম্প্রতি ডাকসুর ভিপি নুর ও অন্যদের ওপর হামলাসহ এ রকম অনেক উদাহরণ আছে, যা দুর্ঘটনা নয়। আমাদের ইচ্ছাকৃত ঘটনা।

এসব ঘটনা আমাদের সত্যিই বিব্রত, লজ্জিত ও অপমানিত করে। জানতে ইচ্ছা করে, আসলে আমরা মানুষ হিসেবে কতটুকু মানবিক।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি ভবনের ইটের মতো। ইটগুলোকে একটির ওপর আর একটি রাখতে চাইলে যেমন যথাযথ ও ভালো মানের সিমেন্ট লাগে, না হলে টেকসই হয় না, তেমনি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ের জন্যও জাতিকে মানবিক হতে হয়। না হলে টেকসই হয় না।

২০২০ সালের বাংলাদেশ ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও মানবিকতায় ভরে যাক—এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছি।

নূর আলম: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।