আরোরা ভূত

আরোরা বা নর্দান লাইটস। ছবি: লেখক
আরোরা বা নর্দান লাইটস। ছবি: লেখক

ছোটবেলার অনেক ভূত আমার মাথার মধ্যে এখনো দিব্যি চেপে আছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, মাথার মেমোরি রি-ফরম্যাট করে সব ডিলিট করলে কেমন হয়? কিন্তু আবার কেমন যেন মায়াও হয় এগুলোর ওপরে। কে জানে এগুলো আছে বলেই হয়তো এত ঝুট-ঝামেলার মধ্যেও বেঁচে থাকতে বেশ লাগে।

আমার এ রকম হাজারো ভূতের মধ্যে সবচেয়ে পাজি আর পুরোনো ভূতের নাম আরোরা। না, এটা ওর পদবি (family name) না, এটাই ওর ডাকনাম। তবে আরও একটা পরিচিতি আছে, ওকে Northern Lights বলেও চেনে অনেকে।

দ্বিপ্রহর। ছবি: লেখক
দ্বিপ্রহর। ছবি: লেখক

এবার সংক্ষেপে বলি, এ ভূত আমাকে আসর করল কীভাবে। আমি তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি। সিলেট শহরে থাকি। ওই সময়টাতে নিয়মিত সিলেট পৌর পাঠাগারে যাওয়া-আসা ছিল। ওখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত কিছু ম্যাগাজিন আসত। সুন্দর সুন্দর ছবির কভার থাকত বইগুলোর। আর ভেতরেও থাকত নানা রঙের সুন্দর সুন্দর ছবি। এগুলোর কোনো এক কপিতে প্রথম চোখে পড়ে Northern Lights। তারপর আমার মাথায় এ ভূতের স্থায়ী ঠিকানা।

আধুনিক বিজ্ঞান একে আবার এক বিশেষ রকমের আলোকরশ্মি হিসেবে দেখে। এটা সৃষ্টি হয় যখন সৌরমণ্ডলের দ্রুত গতিশীল ইলেকট্রন কণা আর আমাদের বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ইলেকট্রন কণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন অণুগুলোতে শক্তি সরবরাহ করে আর উত্তেজিত করে তোলে। পরে এ অণুগুলো আবার যখন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তখন তারা আলোকরূপে ফোটন বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরও অনেক রশ্মির প্রকাশ করে। এটাতেই সৃষ্টি হয় ম্যাজিকাল Northern Lights. (আরও জানতে চাইলে গুগল করতে পারেন)।

বরফে জমে যাওয়া লেক। ছবি: লেখক
বরফে জমে যাওয়া লেক। ছবি: লেখক

এখানে আমার ভূতের অভিজ্ঞতা লিখে নিজেকে মহান বানানোর বা জাহির করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। আসল কথা, আমি এ ভূতের আসর থেকে এখন মুক্ত। তাই এ লেখা তাদের জন্য, যাদের মাথায় আরোরা ভূতের আসর আছে আর এ ভূতের থেকে চিরতরে মুক্তি চান। এটা একরকমের প্রেসক্রিপশন মনে করতে পারেন। মোদ্দাকথা, এ ভূতকে সামনাসামনি বিদায় দিতে হবে। নইলে ওটা আপনাকে খোঁচাতেই থাকবে। আর তার জন্য কোথায় যেতে হবে বা কী করতে বা জানতে হবে, তা নিচে লিখে দিলাম।

কোথায় পাবেন ভূতের দেখা
তা অনেক দেশেই পাবেন। তবে আমি সুইডেনের আবিস্কো (Abisko-North of the Arctic Circle) শহরকে লক্ষ্য করেই ট্যুর প্ল্যান করেছিলাম। এটা স্টকহোম থেকে ১ হাজার ৫০৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর পেছনে বেশ কয়েকটা কারণও ছিল। যেমন তুলনামূলকভাবে অন্য লোকেশনের চেয়ে গত কয় বছরে সবচেয়ে বেশি আরোরা দেখা গেছে এ শহরে। ভৌগোলিক কারণে এ শহরের রাতের আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে (এটা আরোরা দেখতে পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, আকাশে মেঘ থাকলে আরোরা হলেও আপনি দেখতে পাবেন না)। আর সঙ্গে তো অর্থনৈতিক কারণটাও ছিল (এখানে খরচাপাতি তুলনামূলকভাবে কম)।

বরফে জমে যাওয়া নদী। ছবি: লেখক
বরফে জমে যাওয়া নদী। ছবি: লেখক

কেমন করে যাবেন
ধরে নিলাম আপনি স্টকহোমে আছেন। তা এখান থেকে আপনি দুভাবে আবিস্কো যেতে পারেন।

ফ্লাইটে করে কিরুনা শহর পর্যন্ত। তারপর ট্যাক্সি বা বাসে করে আবিস্কো (এ রুটে কিছুটা সময় বাঁচবে কিন্তু খরচ আর কষ্টটা বেশ হবে)। ট্যুরিস্টদের কাছে কিরুনার আরেক বিরাট আকর্ষণ বিশ্ববিখ্যাত আইস হোটেল। লিংক: <icehotel.com/icehotel-original>। আবিস্কো থেকে এক দিনের জন্য কিরুনাটাও ঘুরে যেতে পারেন।

আবিস্কো শহর। ছবি: লেখক
আবিস্কো শহর। ছবি: লেখক

দ্বিতীয় উপায় ট্রেনে করে। সময় মোটামুটি ১৬ বা ১৭ ঘণ্টার মতো লাগবে। কিন্তু চমৎকার অভিজ্ঞতা হবে। ট্রেন ছাড়ে স্টকহোম সেন্ট্রাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে। আবিস্কো পৌঁছাবে পরদিন বেলা ১১টার দিকে। যদি আপনার সঙ্গে ইউরো রেল পাস থাকে, তবে শুধু রাতে ঘুমানোর ব্যাংক রিজার্ভেসনের টাকাটা লাগবে (প্রায় ৯০ ইউরো বা ২৫০ সুইডিস ক্রোনা)। আর যদি পাস না থাকে তবে প্রায় ৩৫০ ইউরোতে রিটার্ন টিকিট পেয়ে যাবেন। আগেভাগে টিকিট কাটলে দামটাও আরও কম পড়বে।

সুইডেনের ট্রেনের ওয়েব লিংক: <www.sj.se/en/about/about-sj/our-trains.html>

কখন যাবেন
সেপ্টেম্বর থেকে মার্চের মাসের রাতের অন্ধকারেই এ ভূতের দর্শন পাবেন।

গ্রোসারি স্টোর। ছবি: লেখক
গ্রোসারি স্টোর। ছবি: লেখক

থাকবেন কোথায়
আবিস্কোকে আসলে শহর না বলে গ্রামই বলা যেতে পারে। এর লোকসংখ্যা ৭০-এর নিচে। একটা গ্রোসারি স্টোর, কয়েকটা ছোট আবাসিক হোটেল আর জলবায়ু গবেষণাকেন্দ্র নিয়েই এ গ্রাম। যেহেতু এখানে থাকার বেশি হোটেল নেই, তাই হোটেলটা আগেভাগে বুক করে নেবেন। আমি ছিলাম Abisko Guesthouse-এ (ট্রেন স্টেশনের খুব কাছে)।

বেশ ছিমছাম পরিষ্কার। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আপনাকে কষ্ট করে পাহাড়ে চড়তে হবে না আরোরা দেখতে। হোটেলের বারান্দা বা রুম থেকেও দিব্যি আরোরা দেখতে পাবেন। বুকিং ডটকমের মতো যেকোনো অ্যাপ থেকে রুম বুকিংটা ঝামেলা ছাড়া করে ফেলতে পারেন। তবে এ কাজে একটা Credit Card লাগবে।

আবিস্কো স্টেশন। ছবি: লেখক
আবিস্কো স্টেশন। ছবি: লেখক

কোথায় খাওয়াদাওয়া করবেন?
মজার ব্যাপার, এ শহরে কোনো রেস্টুরেন্ট বা ফাস্ট ফুডের দোকান পাবেন না। তাই আপনার ভরসা এ শহরের একমাত্র গ্রোসারি স্টোর। এখন আপনি যদি অলস মেজাজের হন, তবে ফ্রোজেন ফুড এনে মাইক্রোওয়েভ করে খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ওখানে নেই (অনেক হালাল অপশন পাবেন)। আর যদি একটু কাজকাম করতে আপত্তি না থাকে, তবে ওই গ্রোসারিতেই রান্নার সবকিছু সস্তায় পাবেন আর হোটেলেই পাবেন কমন রান্নাঘর (কয় দিন সপাক খেয়ে দেখেন কেমন লাগে)।

কী করবেন
ওখানে আরোরা ছাড়াও অনেক কিছুরই ব্যবস্থা আছে, একটা ছোটখাটো ধারণার জন্য নিচের তালিকা।

Snowmobile driving
Dogsled tour
Aurora Photo tour
Hiking
Snowshoe walk
Narvik sightseeing (Tour to Norway)
Ice Fishing
Moose Spotting
Ice Climbing
Lake Torneträsk ইত্যাদি...।

আবিস্কো শহরে লেখক
আবিস্কো শহরে লেখক

কিছু বিষয় মাথায় রাখবেন
শীতকালে আবিস্কোর তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৬ থেকে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি (আমি মাইনাস ২১ ডিগ্রিতেও ছিলাম)। তুষারঝড় যেকোনো সময় হতে পারে। তাই শীতের কাপড়চোপড় চিন্তাভাবনা করে সঙ্গে নেবেন (নইলে হোটেল বুকিংয়ের সময় হোটেলকে বলে দেবেন। ওরাই ব্যবস্থা করে দেবে)।

আর যাদের অ্যাজমার (শ্বাসের) সমস্যা আছে, তাদের সতর্কতার সঙ্গে থাকতে হবে।

আর কী, দেখে আসুন প্রকৃতির চরম সুন্দর একরূপ আর সঙ্গে মাথার ভূত থেকে চিরতরে মুক্তি।

অনুপ সরকার: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া