নভেল করোনাভাইরাস ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে চীনের মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হন। ছবি: এএফপি
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে চীনের মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হন। ছবি: এএফপি

সর্দি-ঠান্ডাজনিত ভাইরাল ইনফেকশন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবছর পরিবারের এক থেকে দুজন ভাইরাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয় এবং সংক্রামক রোগ হওয়ার কারণে তা পরিবারের অন্যদের থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছড়ায়।

আশার কথা হলো ভাইরাল ইনফেকশনজনিত রোগ নিজে নিজে ভালো হয়ে যায় এবং বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রে তা কোনো লক্ষণও প্রকাশ করে না।

তবে সাম্প্রতিক কালে নতুন কিছু ভাইরাসজনিত রোগ মানবসমাজের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; বিশেষ করে যেসব ভাইরাস অন্য প্রাণীর দেহ থেকে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করছে। তাই ভাইরাসজনিত রোগে আমাদের সতর্ক থাকা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

ভাইরাসজনিত রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে সর্দিকাশি, নাক-চোখ দিয়ে পানি পড়া, মাথাব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি। এসব লক্ষণ তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি থাকতে পারে। ইদানীং নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাসকষ্ট ও কিডনির সমস্যা কিছু ভাইরাল ইনফেকশন বেশ কিছুদিন পর দেখা দিচ্ছে।

তবে মনে রাখতে হবে, ভাইরাল ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ভাইরাল ইনফেকশনে না জেনে, না বুঝে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নামক আরেক মহামারির জন্ম দিচ্ছে। তাই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের অনুমতি (প্রেসক্রিপশন) ব্যতীত কোনোভাবে অ্যান্টিবায়োটিক কেনা উচিত নয়।

ভাইরাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে আমরা এপিডেমিক ও প্যান্ডেমিক নামক দুটি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখে থাকি। খুব সহজ ভাষায়, নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো রোগ যখন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে এবং তা আশপাশের এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তাকে এপিডেমিক রোগ বলা হয়। আর রোগটি যদি সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তবে তাকে প্যান্ডেমিক বলে ঘোষণা করা হয়।

আরও সহজ ভাষায়, এপিডেমিক নির্দিষ্ট এলাকার মহামারি আর প্যান্ডেমিক হলো পৃথিবীব্যাপী মহামারি। যেমন গত বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ঢাকার জন্য এপিডেমিক বলা যাতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগ এপিডেমিক হয়েছে, যার উৎপত্তি চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। চীনের সরকারি হিসাবে আজ পর্যন্ত সাড়ে দশ হাজারের বেশি লোক আক্রান্ত এবং ২১৩ জন মারা গিয়েছেন করোনাভাইরাসে। আরও ২১টি দেশে সরকারিভাবে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

ইতিমধ্যে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচও থেকে আরও বলা হয়েছে, জার্মানি, জাপান, ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্রে মানবদেহের মাধ্যমে ছড়িয়েছে—এমন ১৮টি ঘটনা পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কোনো সীমান্ত না থাকলেও চীন বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। প্রতিদিন অসংখ্য লোক (প্রথম আলো পত্রিকার সূত্রমতে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করে) যাতায়াত করেন এই দুই দেশে। চীন নভেল করোনাভাইরাস ছাড়াও আরও কিছু এপিডেমিক রোগের উৎপত্তিস্থান। তাই সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ভাইরাসজনিত রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, সরকার চীনের উহান প্রদেশ থেকে ৩৬১ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাঁদের বিমানবন্দরের বিপরীত অবস্থিত হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইন করা হবে।

এই সংবাদ একদিকে যেমন শঙ্কার, অন্যদিকে আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, তাদের জন্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা প্রশান্তির, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখন প্রবাসী প্রতিটি মানুষ এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে যে আমার দেশ বিপদে পাশে থাকবে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকার ও এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

চীন থেকে যাঁরা ফিরলেন, তাঁদেরও সরকারের এই আন্তরিক চেষ্টার প্রতি সম্মান জানানো উচিত। তাদের উচিত কোনো কিছু গোপন না করে তাঁদের শারীরিক যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্টদের দেওয়া।

বিখ্যাত জার্নাল দ্য ল্যানচেটে অতিসম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী নভেল করোনাভাইরাসে ২৫ থেকে ৬৫ বছরের লোকেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তাঁদের সবারই পূর্ববর্তী রোগের ইতিহাস আছে। তাই যাঁরা ফিরলেন, তাঁদের উচিত হবে সব বর্তমান ও পূর্ববর্তী রোগের তথ্য দেওয়া, এমনকি গত এক মাসে তাঁরা যদি কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে থাকেন, তাও জানানো। যদি সরকার এই জটিল পরিস্থিতিকে ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে আমি মনে করি, এটা হবে প্রবাসীদের জন্য মুজিব শতবর্ষের সেরা উপহার।

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত? ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের হয়তো একদল নির্ভীক চিকিৎসক-নার্স (যারা ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফল) আছেন, কিন্তু তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা এখনো তৈরি হয়নি।

মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু মশার মাধ্যমে ছড়াত। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষ ছড়াবে। এ ছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা প্রকাশ পেতে ২ থেকে ১৪ দিন লাগবে। এখন ৩৬১ জনকে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইন করে রাখার পর যদি একজনও আক্রান্ত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে বাকি ৩৬০ জনের মাঝে যে তা ছড়ায়নি তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

আমার মতে, যারা সুস্থ, তাদের বিভিন্ন গ্রুপে (পরিবারকেন্দ্রিক বা সম্ভব হলে একা একা) ভাগ করে রাখা উচিত। ১৪ দিন পর যে গ্রুপে কোনো লক্ষণ দেখা যাবে না, তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্প ঢাকার আরেকটু দূরে কম ঘনবসতি এলাকায় হলে ভালো হতো।

চীনের একটি দলের গবেষণামতে করোনাভাইরাস ৫৭ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মারা যায়। তাই আশার কথা, আমাদের আসছে গরমে করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারবে না। এ ছাড়া গবেষক দল দাবি করেন, ইথারের মিশ্রণ, ৭৫ শতাংশ ইথানল, ক্লোরিনযুক্ত জীবাণুনাশক ও পেরোক্সাইসেটিক অ্যাসিড ভাইরাস নির্মূলে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

তাই যাঁরা কোয়ারেন্টাইন এলাকায় থাকবেন, তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার ব্যবস্থা থাকতে হবে। জাপানি ডাক্তারদের মতে, আমাদের দেশে এই সময় পরিষ্কার থাকা মাস্ক ব্যবহারের থেকে জরুরি। কিন্তু এর মানে এটা না যে মাস্ক ব্যবহার করা যাবে না। যেসব মাস্ক আঁটসাঁটভাবে মুখের সঙ্গে লেগে থাকে, তা ব্যবহার করতে হবে।

আজ বিখ্যাত জার্নাল দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে করোনাভাইরাস নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রি এই আর্টিকেলে আমেরিকার আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু ক্লিনিক্যাল তথ্য আছে, যা হয়তো আমাদের চিকিৎসকদের কাজে লাগতে পারে।

পরিশেষে বীররা কখনো মরে না। যাঁরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উহানের লোকদের আনতে গিয়েছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। সব চিকিৎসাসেবী ও তাঁদের পরিবারের প্রতি থাকল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ ভালো থাকুক।

ড. মো. আরিফুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক (বিশেষভাবে নিযুক্ত), ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং সহযোগী অধ্যাপক (ছুটিতে), ফার্মেসি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।