বেড়ানো: লেকস এন্ট্রান্স ও নেরোলির কটেজ

লেকস এন্ট্রান্স। লুক আউট থেকে। ছবি: লেখক
লেকস এন্ট্রান্স। লুক আউট থেকে। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ায় পাবলিক হলিডে বছরে মোটে ১২-১৩ দিন। লম্বা ছুটি বলতে বড়দিনের সময়টাই। ক্রিসমাস আর বছরের শুরুর এই সময়টায় তাই এখানে বেশির ভাগ মানুষই লম্বা একটা ছুটি নিয়ে নেয়।

বাসা বদলানোর ঝামেলায় এবার আমাদের তেমন একটা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল না। কিন্তু মনের ভেতর ঠিকই কেমন উসখুস করছিল। সমস্যা একটাই, ছুটির মৌসুমে হঠাৎ করে কোথাও গেলে থাকার জায়গা খালি পাওয়া যাবে না।

এ সময় কোথাও থাকতে হলে মাসখানেক বা তারও আগে থেকে বুকিং দিতে হয়। তাই কোনো কিছু খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত যাওয়া ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

আমাদের প্রিয় ঘুরতে যাওয়ার জায়গার একটা হচ্ছে লেকস এন্ট্রান্স। ঠিক করলাম যাবই। আর থাকার মতো কোনো গেস্টহাউস ফাঁকা পাওয়া গেলে রাতটা থাকব। না হলে সেদিনই সন্ধ্যার পরপরই ফিরে আসব।

দাবানলে পুড়ে যাওয়া বন। ছবি: লেখক
দাবানলে পুড়ে যাওয়া বন। ছবি: লেখক

থাকার জায়গা যে পাওয়া যাবে না, সেটা প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম। এরপরও মনে হলো একটু খুঁজে দেখি। অনেক সময় শেষ মুহূর্তে বুকিং বাতিল হয়। দু-তিনটা ট্রাভেল বুকিং পেজ আর এয়ার বিএনবি ঘেঁটে লেকস এন্ট্রান্সে বা এর কাছাকাছি যাও-বা পাওয়া গেল, সেগুলোর তখন আকাশছোঁয়া ভাড়া।

শুধু একটা বাড়ি মোটামুটি অ্যাফোর্ট করা যাচ্ছে। উইকেন্ডেও খালি আছে। কিন্তু সেটা লেকস থেকে আরও প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। ডব্লিউ ট্রি নামের ছোট্ট একটা পাহাড়ি এলাকায়।

বুকিং দেব কি দেব না, দিলে কোন দিন দেব। আবহাওয়া কোন দিন কেমন, খুব বেশি গরম না ঠান্ডা। এত শত দেখে লুবনাকে জানাতে জানাতে উইকেন্ডের দিনগুলোও ততক্ষণে বুকড হয়ে গেল।

উপায় না পেয়ে দেখি পরদিন, মানে ঠিক ক্রিসমাসের দিনেই দুই রাতের জন্য খালি আছে, আর সময় নষ্ট করলাম না। ঠিক করলাম পরদিনই যাব। আর সেই সঙ্গেই এয়ার বিএনবি থেকে ‘অন্তস ফার্ম, বিএনবি’ কটেজ বুক করা হয়ে গেল।

আমাদের বাসা থেকে লেকস এন্ট্রান্স মোটামুটি সাড়ে চার ঘণ্টার ড্রাইভ। মাঝখানে বিরতি নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে সেটা অবধারিত ছিল। সেখানে লেক এন্ট্রান্স থেকে কটেজে। তার ওপর যোগ হচ্ছে আরও এক ঘণ্টা।

ঠিক করলাম সকালের দিকে রওনা দিয়ে প্রথমে লেকস এন্ট্রান্স যাব। সেখানে বিচে একটু সময় কাটিয়ে এরপর অন্তস ফার্মে চলে যাব। সেখানে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আশপাশে ঘুরব। তার পরের দিন চেক আউট করে ফেরার পথে আবার লেক হয়ে সোজা বাসায় ফিরব। সংক্ষিপ্ত প্ল্যান।

পরদিন সকালে তাড়াহুড়া করে খাবার দাবার কিছু প্যাক করে সব গুছাতে গুছাতে ১১টা বেজে গেল। রওনা দেওয়ার আগে কী ভেবে মেইলটা চেক করতে গিয়ে দেখি আমাদের হোস্ট নেরোলি (Neroli) আগের দিন সন্ধ্যায় একটা ই–মেইল করেছেন। মেইলে আমাদের বুকিংয়ের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়েছেন, সেই এলাকায় কিছুদিন আগে বুশফায়ার হয়েছিল। এখন সেটা দক্ষিণে সরে গিয়েছে। কিন্তু বাতাসে কিছু ধোঁয়া থাকতে পারে। তবে তাদের ফার্ম হাউস থাকার জন্য নিরাপদ।

নেরোলির কটেজ। ইনসেটে পানি ছিটানোর স্প্রিংকলার। ছবি: লেখক
নেরোলির কটেজ। ইনসেটে পানি ছিটানোর স্প্রিংকলার। ছবি: লেখক

বলা প্রাসঙ্গিক, অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মকালে যখন খুব গরম পড়ে, তখন প্রায়ই বনবাদাড়ে আগুন লাগে। কারণ, এখানে গরমের সময়টা অনেক শুষ্ক। তার ওপর তিন বছর ধরে যতটুকু বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না। কখনো প্রাকৃতিক কারণে, কখনো মানুষের হাতে, বনের গাছে আগুন ধরে যায়। তারপর এর ব্যাপ্তি এতটাই হয়ে যায় যে তখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

ক্রিসমাসের কিছুদিন আগে নিউ সাউথ ওয়েলস আর সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে ভয়াবহ আগুনে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা (যার অনেকাংশই বন, পাহাড় আর খামার জমি) আর হাজার খানেকের বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। আর কিছু আগুন তখনো জ্বলছিল।

যা হোক, যেহেতু এই এলাকায় ইতিমধ্যে পুড়ে গেছে, সেই কারণেই আবার লাগার আশঙ্কা তেমন একটা নেই ধরে নিয়েছিলাম। তার ওপর তেমন গরমও ছিল না। সাতপাঁচ ভেবে রওনা দিয়েই দিলাম।

প্রথমে যেতে হবে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। তারপর সেখান থেকে আরও ১০০।

মনে করেছিলাম, বড়দিনের মধ্য দুপুরে রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা থাকবে। তা নয়। মেলবোর্নের পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পার হতেই লেগে গেল এক ঘণ্টার বেশি। শহর পার হয়ে পূর্ব দিকে মোটামুটি সমতল রাস্তা। এক সময় মেট্রোপলিটন এলাকা পার করে ফেললেই দুই পাশে শুধু খালি জমি। বেশির ভাগই গরু, ছাগল, ভেড়া অথবা ঘোড়ার খামার; নাহয় সবজির খেত।

একসময় রাস্তা অনেকটা একঘেয়ে হয়ে যায়। মেলবোর্নের সবচেয়ে বড় রাস্তা ‘এম ১’। সেটা পার করে ‘এ ১’ উঠতে উঠতে তেমন একটু একটু করে বদলাতে থাকে আশপাশের দৃশ্য। ঘনবসতি কমতে কমতে ধীরে ধীরে গ্রাম অংশ, খামার, ফাঁকা মাঠের দৃশ্য বেড়ে যায়।

রাস্তার নির্ধারিত গতি ১০০-১১০ কিলো/ঘণ্টা। তবে মাঝেমধ্যে ছোট শহরের মাঝখান দিয়ে যখন যেতে হয়, তখন সেটা কমে গিয়ে হয় ৬০।

ওয়ারাগুল, ট্রাফাল্গার, মো—এ রকম আরও কিছু ছোট শহর পার হয়ে ট্রারাল্গন একটা বড় শহর। সেখানে একটা মধ্যবিরতি নিয়ে কিছু খেয়ে নিলাম। বিশ মিনিটের মাথায় আবার পথে। তার আরও প্রায় দুই ঘণ্টা পর গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য লেকস এন্ট্রান্স।

লেকস এন্ট্রান্স অনেকটা আমাদের হাওর এলাকার মতো। অসংখ্য ছোট-বড় খাল মিলে এই জায়গাটাকে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় জলাভূমির নেটওয়ার্ক। এই জায়গাটার ম্যাপ দেখলে এর নামকরণের কারণ ঠিক বোঝা যাবে। মনে হবে সাগরের পানি একটা ভাঙা অংশ দিয়ে স্থলভাগে ঢুকে এসব লেক সৃষ্টি করেছে।

যা হোক, বিচের পাশে পার্কিং স্পটে পার্ক করে পানিতে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পার্কিং স্পট থেকে ভেতরে যেতে হয় একটা পুল পার হয়ে। সেই অংশটা লেকের মতো। পানি একেবারে শান্ত। তারপরে একটু বালির মতো উঁচু পাড়। সেটা পেরোলেই আসল বিচ।

এই বিচটা অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচের (৯০ মাইল বিচ) অংশ।

হলদে বালি আর নীল সমুদ্র, এই দুইয়ের টানে ছেলে ফাইযানকে নিয়ে নেমে পড়লাম। এমনিতে যদিও পানি প্রচণ্ড পছন্দ, বিকেল হয়ে যাওয়ায় পানি তখন একটু ঠান্ডা আর তার ওপর ঢেউ অনেক বেশি থাকাতে আমরা বেশিক্ষণ আর থাকতে পারলাম না। সমুদ্র থেকে উঠে বিচের বালি দিয়ে খেলা। তারপর গা–হাত–পা ধুয়ে ফাইযান তার স্কুটার নিয়ে কিছুক্ষণ খেলল।

মা ক্যাঙারু আর থলের ভেতর তার ছানা। ছবি: লেখক
মা ক্যাঙারু আর থলের ভেতর তার ছানা। ছবি: লেখক

ততক্ষণে প্রায় সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছে। ওখান থেকে গেস্টহাউস প্রায় এক ঘণ্টার পথ। যদিও সূর্য ডোবে সাড়ে আটটার পরে, তাও বাকি পথ পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা আর বেশি দেরি করলে যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই রওনা দিয়ে দেওয়াটাই শ্রেয় ছিল।

অন্তস ফার্ম ডব্লিউ ট্রি নামের একটা ছোট্ট এলাকায়। জায়গাটা অনেকটা পাহাড়ি গ্রামের মতোই। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কতগুলো ফার্ম। তার একপাশে গিরিখাদ, আরেক পাশে কিছু বসতি। তা–ও অনেক দূরে দূরে।

লেকস এন্ট্রান্স থেকে যাওয়ার পথ প্রায় পুরোটাই পাহাড়ের গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া রাস্তা। ড্রাইভটা যেমন সুন্দর, তেমনি ভয়ংকর। খুব সাবধানে দেখেশুনে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। যতই ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম।

গাড়ি চালানোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে রাস্তায় মনোনিবেশ করতে করতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা তেমন উপভোগ করা যায় না। তার জন্য মাঝেমধ্যে লোভ সামলাতে না পেরে গাড়ি থামিয়ে নেমে ছবি তুলছিলাম। আর কিছু দূর চলার পরেই লক্ষ করলাম মোবাইলের নেটওয়ার্ক মাঝেমধ্যেই চলে যাচ্ছে।

গুগল ম্যাপ ফলো করতে করতে একসময় খুব কাছাকাছি যখন চলে এসেছি, তখন সূর্য অনেকখানি ঢলে পড়েছে। সেই আলোয় দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল গাছগুলো কেমন লাল আভা ছড়াচ্ছে। আর কিছু দূর গিয়ে বুঝতে পারলাম এই গাছগুলো আসলে দাবানলে পুড়ে গেছে। দেখে বেশ খারাপই লাগল।

মেইন রাস্তা থেকে ফার্মে ঢোকার জন্য একটা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। আর তার দুই পাশে পুড়ে যাওয়া বন। একসময় রাস্তাটা সেই বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। অল্প দূর যেতেই দেখি বৌদ্ধদের পরিচালিত একটা রিট্রিট সেন্টার। আর তার আশপাশে কতগুলো ক্যাঙারু নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করছে।

আর কিছু দূর যাওয়ার পরে খুঁজে পেলাম একটা শিকল দিয়ে বাঁধা আমাদের কটেজের মেইন গেট। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ, যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক নেই সেখানে কাউকে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভবই হয়ে যেত। গাড়িটা এক জায়গায় রেখে প্রথমেই আমাদের হোস্ট নেরোলির খোঁজ করা শুরু করলাম। কটেজের একপাশে নেরোলি থাকে তার পরিবার নিয়ে। আরেক পাশে থাকব আমরা। তবে পুরোটাই আলাদা প্রাইভেট ইউনিটের মতো।

নেরোলির বাসার কাছে একটু উঁকিঝুঁকি দিতেই আমাদের দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। আমাদের ছয়টার মধ্যে চেক ইন করার কথা ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। বেশ দেরি হয়ে গেছে, তা–ও কোনো রকম বিরক্তি না দেখিয়ে বরং জিজ্ঞেস করলেন আমাদের আসতে পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না। হয়নি শুনে আশ্বস্তই হলো।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম বুশফায়ার কবে হয়েছিল। কীভাবে তারা নিরাপদে ছিল?

নেরোলি হেসে বললেন, তাদের অভ্যাস আছে। তবে সেই রাতে সারা রাত তারা ঘুমায়নি। বাড়ি আর খামারের পশুপাখিদের দেখাশোনা করেছে। পরে লক্ষ করেছিলাম বাসাটায় বুশফায়ারের জন্য অগ্নিপ্রতিরোধক–ব্যবস্থা ভালোই ছিল। বাসাটা আশপাশের তুলনায় অনেকটাই নিচু জায়গায় বানানো। একটু ঢাল বেয়ে। আর আগুনের সহজাত প্রবৃত্তি হলো ওপরের দিকে ওঠা। এ ছাড়া বাতাসে ডালপালার মাধ্যমে আগুনের ফুলকি উড়ে এলেও সেটা নেভানোর জন্য বাসার ছাদে পানি ছিটানোর স্প্রিংকলার লাগানো। দারুণ ব্যবস্থা।

যা হোক, আরেকটু গল্প করার পর আমাদের সঙ্গে ঘরে ঢুকে কোথায় কী আছে বুঝিয়ে দিয়ে নেরোলি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলাম দরজা বন্ধ করব কীভাবে। দরজার কোনো লক তো দেখছি না। নেরোলি হেসে বললেন, দরজার তালা বন্ধ করার প্রয়োজন নেই, এই জায়গাটা অনেক নিরাপদ। শুধু নিশ্চিত করতে স্লাইডিং দরজাটা ভেড়ানো থাকে। না হলে কিছু অপ্রত্যাশিত অতিথি ঢুকে পড়তে পারে। হাসি দেখে বুঝলাম হয়তো পোকামাকড় অথবা নিরীহ বন্য প্রাণীর (কোয়ালা, ক্যাঙারু) কথাই বলছে।

সূর্য তখন ডুবে গেছে। একটু সময় পাওয়া গেল বাসার ভেতরটা একটু ঘুরে দেখার। কটেজে ঢুকেই একটা ছোট পোর্চ মতো। এরপরেই বসার ঘর আর রান্নার একটা জায়গা। আর ভেতরে তিনটি শোবার ঘর। পুরো বাসাটায় ছয়জন থাকতে পারে।

বাসাটা অনেক খোলামেলা। আর প্রতিটি ঘরে বড় বড় জানালা। একটা ঘরের জানালায় আবার পর্দা নেই। বাইরে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রকৃতির একেবারে মাঝখান, আকাশ, জঙ্গল আর পাহাড় যেন ঘরের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। পুরো বাসাটা বৌদ্ধ জেন (zen) আদর্শের আদলে সাজানো।

রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে ফাইযান ঘুমিয়ে পড়লে একটু ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরটায় বসে ওয়াই–ফাইয়ের সিগন্যাল ধরার চেষ্টা করছি। কিন্তু এত দুর্বল সিগন্যাল যে কোনোভাবেই সংযোগ হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে শেষমেশ ক্ষান্তই দিতে হলো।

মজার ব্যাপার হলো, এই কটেজে সামান্য টেলিভিশনটাও নেই। এই যুগে কোথাও টেলিভিশন থাকবে না, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হইনি। এমন সময় লুবনা পাশে এসে বসতে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। গল্প করতে করতেই যখন অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেল, একসময় একটা উপলব্ধি হলো যে আমাদের অনেক দিন এভাবে অবিচ্ছিন্নভাবে গল্প করা হয়ে ওঠে না যান্ত্রিক জীবনের কারণে। প্রযুক্তি থেকে এই বিচ্ছিন্নতাটাই হয়তো আরও অনেক বেশি করে দরকার জীবনে। কথায় বলে ‘Disconnect to Connect’-মনে হলো এই টেলিভিশন ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার মতো এত সুন্দর ষড়যন্ত্র আর কিছু হয় না। এই বাসাটার মূল উদ্দেশ্যটাও বোধ হয় এটাই বুঝিয়ে দেওয়া।

দাবানলের গাঢ় ধোঁয়ায় ঢাকা পাহাড়। ছবি: লেখক
দাবানলের গাঢ় ধোঁয়ায় ঢাকা পাহাড়। ছবি: লেখক

সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা খারাপ খবর পেলাম। নেরোলি এসে বললেন, আশপাশে কিছু জায়গায় আবার বুশফায়ার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বাখান (Buchan) নামে একটা জায়গায় আগুন লেগেছে। সেটা খুব কাছে আমাদের আর ফেরার পথে পড়ে। নেরোলি আমাদের কিছু সাজেস্ট করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু অবস্থা খারাপ হতে পারে। তাই আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে বললেন।

তাঁর ইঙ্গিত স্পষ্ট, খারাপ কিছু হতে পারে। তাই আমরা ঠিক করলাম সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ব। গেস্টহাউসে খুবই সাধারণ নাশতা মানে ব্রেড দেওয়াই ছিল। আর ফ্রিজে খুঁজে পাওয়া গেল জেলি। নাশতা করে ঠিক করলাম আবার লেকস এন্ট্রান্স একবার ঢুঁ মেরে তারপর সোজা চলে যাব বাসায়। আগের সন্ধ্যায় তেমন ছবি তোলা হয়নি। তাই পটাপট কিছু ছবি তুলে বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পথে ক্যাঙারুগুলোর কিছু ছবি তোলার জন্য কিছুক্ষণ থামলাম। লোকালয়ের আশপাশে যেসব ক্যাঙারু থাকে, সেগুলো মানুষ দেখে খুবই অভ্যস্ত। কাছে গেলে দৌড়ে পালায় না। তাই ছবি তোলা যায়। ছবি তোলা শেষে আবার রওনা দিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় উঠে পড়লাম। কিছু দূর যেতেই মনে হচ্ছিল বাতাসটা একটু ধোঁয়া ধোঁয়া।

লুবনা মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসার পর মোবাইলে ভিক্টোরিয়া ইমার্জেন্সি অ্যাপ চেক করে জানাল ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বাখানে বুশফায়ার হচ্ছে। গেস্টহাউস থেকে লেকস এন্ট্রান্স যাওয়ার একটাই পথ। আর সেটা বাখান হয়েই। তাই একটু শঙ্কা মনে নিয়েই যাচ্ছিলাম।

যেতে যেতে দেখি পাশের খাদে ধোঁয়া বেশ গাঢ় হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল যেন গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। প্রায় আধা ঘণ্টা আরও ড্রাইভ করার পরে অনেকটা লেকস এন্ট্রান্সের কাছাকাছি আসার পরে বাতাস একটু করে পরিষ্কার হওয়া শুরু হলো।

লেকস এন্ট্রান্সে থামার ইচ্ছা থাকলেও বাতাসটা একটু ঠান্ডা হওয়াতে মনে হলো এই ঠান্ডায় সাগরে নামা যাবে না। মনে মনে চিন্তা করলাম, থাক এবার বাসায় ফিরে যাই। একটু মন খারাপ করেই ফেরার সিদ্ধান্তও নিলাম। কিন্তু সান্ত্বনা যে সেটাই ঠিক ছিল। কটেজটা খুবই ভালো লেগেছিল আর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ড্রাইভটা। আরও প্রায় চার ঘণ্টা পর একটা সংক্ষিপ্ত সুন্দর ভ্রমণ শেষে বাসায় ফিরলাম।

পুনশ্চ: আমরা ফেরার দুদিন পরেই ভিক্টোরিয়ায় বুশফায়ার খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করে আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। লেকস এন্ট্রান্সের আশপাশের অনেক এলাকা পুড়ে যায়। সেই সময় সেই এলাকা থেকে সব ট্যুরিস্টকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকেই পথে আটকা পড়ে বেশ বিড়ম্বনার সম্মুখীনও হয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা সময়মতো সেই এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলাম।