যুবারা দল হিসেবে খেলেছে বলেই জিতেছে

‘দশে মিলে করি কাজ’—এই মন্ত্র জপেই বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯
‘দশে মিলে করি কাজ’—এই মন্ত্র জপেই বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯

টুর্নামেন্টে এই প্রথম ভারতীয় বোলিং লাইনআপ কোনো দলকে অলআউট করতে পারল না।

১২ ম্যাচ পরে এই প্রথম ভারতকে কোনো দল অলআউট করল।

এই সামান্য তথ্য থেকেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে যুব বিশ্বকাপে ভারত এবার কতটা ব্যালান্সড দল নিয়ে এসেছিল।

সঙ্গে যোগ করুন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নের তকমা।

আরও আছে চারবারের বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতা।

দেড় শ কোটি জনসংখ্যার স্যাম্পলের অর্ধেক থেকে ১১ জন প্রতিভাবান যুবকের দল গঠনের মধুরতম সমস্যা।

তা ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডের বাজেট তো পেছনে আছেই।

এদিকে সেমিফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে দশ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনাল খেলতে আসার আত্মবিশ্বাস।

পরিষ্কারভাবে তারা ছিল ফেবারিট। ধরেই নিয়েছিল পুঁচকে বাংলাদেশকে নাকানিচুবানি দিয়ে জিতবে। খেলাটা কেবলই আনুষ্ঠানিকতা।

টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে সেই পথেই এগোচ্ছিল তারা। ৯ রানে প্রথম উইকেট পড়লেও দলীয় ১০০ পেরোনোর আগে দ্বিতীয় উইকেট পড়ল না। দুর্দান্ত সূচনা।

হঠাৎ করেই ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’। মাত্র একুশ রানে তাদের শেষ সাত উইকেট হাওয়া হয়ে গেল। দলীয় স্কোর দুই শর ঘরও ছুঁতে পারল না।

এরপরও যখন বাংলাদেশ এই সামান্য রানই তাড়া করতে নামে, ভয়তো ছিলই। একে জীবনে এই প্রথম এত বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার চাপ, এর ওপর খেলোয়াড়দের অল্প বয়স। এ ছাড়া মাঠের স্লেজিং তো আছেই। প্রতিপক্ষের ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা দেখেছেন কেউ? যেন এখনই লাঠিসোঁটা নিয়ে মারতে শুরু করবে। গ্যালারিতে দর্শকদের ‘ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া’ চিৎকার! টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে যা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।

বাংলাদেশি ওপেনাররা একনিশ্বাসে বিনা উইকেটে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। মনে হলো কিসের চাপ? তুড়ি মেরেই সব উড়িয়ে দেওয়া যায়।

এরপরই হঠাৎ করেই একটা মিনি ধস নামল। তাতেই দর্শক হিসেবে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের দাপাদাপি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের হৃদরোগের সবচেয়ে বড় দুটি কারণের একটি হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস। দ্বিতীয়টি আমাদের ক্রিকেট দল। এত দিন বড়রা এই কাজ করে আসত। এখন ছোটরাও শুরু করেছে।

দেখতে দেখতেই চার উইকেট নেই। যে জয়টা মনে হচ্ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার। সেটাই এখন মনে হচ্ছে অনতিক্রম্য দূরত্ব। বড়রা এই কাজটা নিয়মিত করে আসছে। জেতা ম্যাচ প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত তারা। এই ভারতের বিরুদ্ধেই ঘটেছে কয়েকবার। এশিয়া কাপ ফাইনালের দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে। স্বপ্নের প্রায় নিশ্বাসসম দূরত্বে পৌঁছেও বারবার এমনভাবে হৃদয় ভেঙেছে যে এবারও মনে হচ্ছিল বুঝিবা খালি হাতে কেবল ‘হৃদয় জয়’ করেই দেশে ফিরবে তারা।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় আমাদের পক্ষে যাওয়া জরুরি ছিল। প্রথমটি হচ্ছে আমাদের ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তা। দ্বিতীয়টি ভারতীয় দলের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত।

আমাদের ভাগ্য ভালো। দুটিই আমাদের পক্ষে ঘটেছে।

আমাদের শিবিরে আতঙ্ক ছড়ানো বোলার বিষ্ণয়কে কোনো এক বিস্ময়কর কারণে আক্রমণ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। যে ছেলেটি ১২ রানে চার উইকেট ফেলে দিয়েছিল এবং আমাদের বুকের ওপর চেপে শ্বাস রোধ করে ফেলেছিল, সেই ছেলেটিকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে ফেলায় আমাদের ব্যাটসম্যানরা দম নেওয়ার সুযোগ পায়। তাতেই ইমনের ওই সাহসী ব্যাটিং দেখার সৌভাগ্য হয়।

খোঁড়া পায়ে সেভাবে ব্যাটিং চালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মুশফিকের মাথায় আঘাত নিয়েও ব্যাট করার কমিটমেন্টের কথা মনে পড়ে। এই হচ্ছে দলের প্রতি, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট। আমাদের মাশরাফি পঙ্গুত্বের ঝুঁকি নিয়েও দিনের পর দিন লাল–সবুজ জার্সি গায়ে মাঠে দৌড়ে। পারভেজ ইমনের মধ্যে ভবিষ্যতের মাশরাফি ঘুমিয়ে আছে।

বিষ্ণয়কে আবারও আক্রমণে ফেরানো হয়। প্রান্ত বদল করে। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের বাদশাহ আকবর দাঁড়িয়ে গেছে। দৃঢ় হাতে বাইশ গজ শাসন করছে। ভারতীয় বোলারদের অমন সাঁড়াশি আক্রমণ বুক চিতিয়ে ঠেকিয়েছে। সে ভালো করেই জানে বাংলাদেশ মোটেই চাপে নেই বরং ওদের প্রতিপক্ষের বুকের ওপর হিমালয় পর্বতমালা চেপে বসেছে। আমাদের কেবল টিকে থাকতে হবে। রান আপনাতেই আসবে। বৃষ্টি এলেও আমরা রানরেটে এগিয়ে আছি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আমাদের ললাটে ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে, ওটা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

চিল্যাক্স! চিল করতে করতে রিলাক্স করো ডুড! এবং এইভাবেই আমরা অতি সহজেই অতি প্রবল প্রতিপক্ষকে নিতান্ত হেসেখেলে হারিয়ে দিতে পেরেছি।

দলের বিপদের মুহূর্তে দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন পারভেজ। ছবি: আইসিসি
দলের বিপদের মুহূর্তে দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন পারভেজ। ছবি: আইসিসি

লাল–সবুজ পতাকা উড়েছে বিশ্বের সর্ব প্রান্তে। রোববার ছিল বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। প্রবাসীদের কাছে দিনটি বিশেষ দিনে পরিণত হয়ে গেল কেবলই কয়েকজন যুবকের হৃদয় নিংড়ানো সাফল্যে। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেল জয়ের আনন্দের পোস্টে। এক ভাইয়ের ভিডিও দেখলাম মিষ্টি হাতে তিনি ঢাকার রাস্তায় নেমে গেছেন। রিকশাওয়ালা, যাত্রী, পথচারী সবার মুখে নিজের হাতে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন আর চিৎকার করে বলছেন, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

মিছিল বেরিয়েছে প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। সবাই চিৎকার করে বলছে, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’

বিদেশিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছে ঘটনা কী? ব্রাউন ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন?

আমরা এমনই পাগল জাতি।

সামান্য খুশিতেই উৎসবে মেতে উঠি। শ্রেণিবৈষম্য ভুলে গিয়ে এককাতারে মিলিত হই।

ব্যাপারটি আবার আমাদের প্রতিপক্ষের ঠিক হজম হয়নি।

মাঠের মধ্যেই খেলা শেষে প্রায় হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। সমর্থকেরাও ঝগড়াঝাঁটি করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে।

তারা মানতেই পারছে না আমাদের মতো তথাকথিত দুর্বল প্রতিপক্ষের হাতে এভাবে হারতে হয়েছে। ইয়ান বিশপের মতো গ্রেট ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান যখন আমাদের প্রশংসা করেন, তখন ফাইনালে হারের জ্বলুনিতে কিছু সমর্থক তার ওপর রাগ ঝাড়ার চেষ্টায় লিপ্ত। একজন লিখলেন, ‘একজন নিরপেক্ষ সমর্থক হিসেবে বলছি, কোনো এক অদ্ভুত কারণে আপনি বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের প্রশংসা করে পার করেছেন। খুবই বাজে লেগেছে শুনতে।’

আরেকজনের ভাষা এমন, ‘ইয়ান, তুমি কি বাংলাদেশে কোচিংয়ের চাকরি খুঁজছ নাকি?’

আহারে, বেচারারা!

একটা সময়ে তারা এই পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বজয় করেছিল। তখন তারা ছিল আন্ডারডগ। এখন নিজেরা শক্তিশালী হয়েছে বলে অতীত ভুলে নিজেদের চেহারাই পাল্টে ফেলেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে যুবারা দল হিসেবে খেলেছে বলেই জিতেছে। ছোটদের থেকে বড়দের এই একটা বিষয় খুবই মনোযোগের সঙ্গে শিখতে হবে।