ভালোবাসার রং

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অনন্তর মনের আকাশে আজকে অনেক রঙের মেঘের আনাগোনা। রোদেলা নীল ঝকঝকে রং। কালো মেঘের ঘনঘটাও। মেডিকেলে চান্স পেয়েছে সে। মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে চলে যেতে হবে খুলনায়। কোথায় কার কাছে গিয়ে থাকবে?

মা চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বিদায় দিলেন। আজন্ম ঢাকায় পড়া অনন্ত মার আঁচলের শেষ গন্ধটুকু নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছাল। যশোরগামী বিমানের বোর্ডিং পাস নিয়ে বসতেই দেখল গিটার বাজিয়ে একদল ছেলেমেয়ে গাইছে, ‘একঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা, একঝাঁক বুনো হাঁস ছিলাম আমরা।’

তাদের সবার বয়স ওর কাছাকাছি বয়সেরই হবে মনে হয়।

প্লেনে উঠে অনন্ত দেখল এরাও যশোর যাচ্ছে। যশোরে নেমে খুলনাগামী বাসে উঠল অনন্ত আর ওর বাবা। অন্য ছেলেমেয়েগুলো দল বেঁধে উঠল।

টুকটাক কথা শুনে অনন্তর মনে হলো, ওরাও খুলনা মেডিকেলে পড়তে চলেছে। ওদের মনেও ভয়, অনিশ্চয়তা।

অনন্তর বাবা বলছিলেন, ‘মামণি কথা বলে পরিচিত হয়ে নেবে ওদের সঙ্গে?’

অনন্ত পরিচিত হলো শমী, রাজ, কঙ্কণ, রুদ্র আর পলাশের সঙ্গে। ওরই ব্যাচমেট ওরা। প্রথম যাচ্ছে খুলনা। সবাই হোস্টেলে থাকবে।

বাস চলতে শুরু করল কালো মসৃণ রাস্তা দিয়ে। দুই পাশে বড় গাছের সারি। দূরে ধানখেত আর আইলে হেঁটে যাচ্ছে ঘোমটাপরা কারও বধূ। ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো এ সময়। রাজ গিটারের ঝংকার তুলে গাইছে— here comes the rain again, ... talk to me like lovers do’.

ক্যাম্পাসে পৌঁছে হোস্টেলের রুমে অনন্ত উঠল সব মেয়ের সঙ্গে। শমী আর কঙ্কণও।

তার পরের কয়েকটা দিন ঝড়ের বেগে চলে গেল। ভর্তি হওয়া, ছোট্ট একাকী জীবন শুরুর টুকিটাকি জিনিস কেনা। বাবা চলে গেলেন হাতে টাকা দিয়ে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও টাকা রেখে গেলেন।

কেমন অসহায় হয়ে গেল অনন্ত। শুরু হয়ে গেল ক্লাস। অ্যানাটমি ফিজিওলজির দুর্বিষহ জীবন।

লেখিকা
লেখিকা

কমন রুমে টেবিল বাজিয়ে তক্ষকের ডাকের সঙ্গে গায় গান। কিছু মেয়ে পরিবারের মতো হয়ে গেল অনন্তের। এর মাঝে কারও কারও বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। কিছু ফুল বা চিঠি বা ফোনে মিষ্টি কিছু আলাপ।

রাজ, রুদ্র আর পলাশ একদিন এল কঙ্কণ, শমী আর ওর কাছে। ক্যাম্পাসে চা খেল ওরা চত্বরে বসে। সেই থেকে সন্ধ্যার পর ওরা খেতে যেত একসঙ্গে। গল্প করত বা লাইব্রেরিতে একসঙ্গে পড়ত।

রাজ কেমন করে যেন রাজনীতিতে জড়িয়ে গেল। একদিন মার খেল খুব অন্য দলের হাতে। রাজের মা-বাবা দেখতে এলেন হাসপাতালে। গম্ভীর হয়ে জানিয়ে গেলেন, এরপর পড়াশোনার আর কোনো খরচ তাঁরা দেবেন না।

প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষার তখন অল্প কিছুদিন বাকি। একদিন রাজের শুকনা মুখ দেখে অনন্ত বাইরে নিয়ে গেল তাকে। জানতে পারল কয়েক দিন শুকনা চিড়া খেয়ে আছে রাজ। মা-বাবা ফাঁকা হুমকি দেননি। হুমকি দেওয়ার পর থেকে একটা টাকাও দিচ্ছেন না তাঁরা।

অনন্ত হিসাব করে নিজের জন্য অর্ধেক রেখে বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে দিল রাজকে। এভাবে প্রতি মাসে দিতে থাকল। বাইরে খাওয়া, ঘোরাঘুরি সব বন্ধ করে দিল অনন্ত। রাজ নিতে চাইত না। অনন্তের স্পষ্ট কথা, ‘বন্ধু যদি বিপদের সময় কাজে না আসে, তাহলে নামমাত্র বন্ধু হয়ে কী লাভ?’

ছুটিছাঁটায় ঢাকায় গেলে অনন্তের মন আনচান করত রাজের জন্য।

প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর স্কলারশিপের কিছু টাকা সবাই পেল। দিনটা কাটল সিনেমা দেখে। বাগেরহাটের খান জাহান আলীর দরগায় গিয়ে, ফিরতি পথে বাসে রাজ বসেছিল অনন্তের ঠিক পাশে। হঠাৎ একটা ফানুস খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল। অনন্ত ভয় পেয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

হঠাৎ একটা পরম মমতাময়ী হাত শক্ত করে ধরল অনন্তর হাত। কানের কাছে বলল, ‘ভয়ে পেয়ো না, আমি তো আছি।’ অনন্ত চোখ খুলে রাজের মুখ দেখে। দেখল দুষ্টুমি ভরা চোখ দুটোতে কোনো এক ভালোবাসার ছায়া।

অনন্ত কি ঠিক দেখেছে, না সবই ওর মনের কল্পনা?

থার্ড ইয়ারে উঠে রোগী সরাসরি দেখতে পেয়ে সবার মনে কী আনন্দ। এর মাঝে নতুন আসা একজন অনন্তের প্রেমে পড়ে গেল। রাজ এটা নিয়ে দুষ্টুমি করলেই কেন যেন সবচেয়ে রাগ লাগত তার।

ফোর্থ ইয়ারে এসে অনন্ত বুঝে গেল রাজ ওর জগৎজুড়ে আছে। আর অনন্তর মনে ভয়, রাজ বুঝে গেলে বন্ধুত্ব যদি ভেঙে যায়?

এর মাঝে পয়লা বৈশাখের মেলায় রাজ অনন্তকে এক গাদা কাচের চুড়ি কিনে দিল। দিয়ে বলল, শাড়ি চুড়ি পরা বঙ্গ ললনা ওর খুব প্রিয়।

রাজের পরিচিত এক মেয়ে আছে যাকে সে ভালোবাসে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ফাইনাল পরীক্ষার পর অনন্তকে পরিচয় করিয়ে দেবে তার সঙ্গে।

এত বছরের কষ্ট হঠাৎ শেষ হতে চলেছে সবার। ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে অনন্ত কেন যেন উদাস হয়ে থাকত। আর কয়েকটা মাস পরে জেনে যাবে রাজ কার। যদি ধরে রাখতে পারত এ দিনগুলো।

পরীক্ষা দিয়ে ভৈরব নদে লঞ্চ ভ্রমণে বের হয়েছে সবাই এক দিনের জন্য। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে।

মেয়েরা সবাই শাড়ি পরল। সঙ্গে লাল চুড়ি। অনন্তও পরল।

সন্ধ্যার আগে আগে লঞ্চের ছাদে সবাই গেল মোম দিয়ে হার্ট বানানো জায়গায়। হাতে সবার ফানুস। অনন্তর কাছে শুধু কোনো ফানুস নেই। হঠাৎ তাকিয়ে দেখল সারা দিন উধাও হওয়া রাজ লাল পাঞ্জাবি পরে চলে এসেছে। ওর সঙ্গে ফানুস। ওড়াবে বলে।

ফানুস ওড়ানোর আগের মুহূর্তে অনন্তের কানের কাছে রাজ বলল, ‘সারা জীবন এই বুকে থাকবে এমন কোনো কমিটমেন্ট করবে বউ? ডাক্তার যদি হতে পারি, সেটা তোমার জন্য, স্বামী যদি হতে পারি সেটাও তোমার জন্য অনন্ত।’

অনন্ত বলল আগে ফানুস তো ওড়াই, দেখি ভালোবেসে এই বুকে মাথা রাখতে কেমন লাগে।

সারা রাত তারা গান গাইল। রাজ ১৪ বার গাইল মাইলসের ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি...তুমি না এলে এই পৃথিবী আমার, হারাবে আপন।’