বরফের দেশে বাংলার কাবাডি

দুই দলের খেলোয়াড়েরা
দুই দলের খেলোয়াড়েরা

বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডিকে (হাডুডু) নতুন করে খেলার জন্য বরফপ্রবণ অঞ্চলগুলো (উত্তর আমেরিকা) হতে পারে বিনোদনের অন্য একটি মাধ্যম। উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে আউটডোর উইন্টার অ্যাকটিভিটিস খুব বেশি দেখা যায় না। সাধারণত স্কি, আইস স্কেটিং, স্নোসোয়িং, ডগ স্লেজিং, স্লাইডিং ইন স্নো—এসবের মতো উইন্টার অ্যাকটিভিটিসগুলো বেশ জনপ্রিয়।

সীমাবদ্ধতাও আছে। এসব করতে যেতে হয় দূরে কোথাও নির্ধারিত কোনো জায়গায়।

উইন্টার ফান গেম অ্যাকটিভিটিস হিসেবে বরফ (স্নো) কাবাডি খেলার জন্য কোনো বিশেষ জায়গা লাগে না। আমরা খেলতে পারি আউটডোরের যেকোনো খালি জায়গার বরফের ওপরে। এমন ভাবনা থেকেই মূলত বাংলাদেশ স্টুডেন্ট সোসাইটি আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডিকে ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইকে (ইউএনবি) খেলার উদ্যোগ নেয়।

খেলার দৃশ্য
খেলার দৃশ্য

তবে আন্তর্জাতিক কাবাডির নিয়মগুলো সম্পূর্ণভাবে বরফ কাবাডিতে প্রয়োগ করা যায় না। ইনজুরির অনেক ঝুঁকি থাকে বিধায় ইউএনবির সম্মতিতে কিছু নতুন নিয়ম বরফ কাবাডিতে আরোপ করা হয়। যেমন রেইডারকে ট্যাকলিংয়ে কোনো হেড কনটাক্ট থাকবে না। রেইডারের পিঠ ছুঁলেই প্রতিপক্ষ ২ পয়েন্ট পাবে।

ইউএনবি অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, এখন একাডেমিক ক্যালেন্ডারের ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। উইন্টারের মধ্যে তেমন কোনো আউটডোর অ্যাকটিভিটিস থাকে না। এর মধ্যে তাদের এমন আয়োজন সবাইকে উদ্দীপ্ত করবে।

তারপর দেখতে দেখতে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই দিন চলে এল—১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০। খেলা শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে জাতীয় পতাকা হাতে ধরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার সময় আমাদের মনের অনুভূতি বুঝিয়ে বলার নয়। বরফ আর হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা বিবেচনায় খেলার কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত নিয়ম বিদেশি বন্ধুদের সামনে ব্যক্ত করা হলো, যাতে তারাও অতি উৎসুক দর্শক হিসেবে আমাদের খেলার অংশীদার হতে পারে। টান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে বরফ কাবাডি খেলার সমাপ্তি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে খেলায় একদল জিতলেও বিদেশ-বিভুঁইয়ের এই খেলায় আসল জয় আমাদের সবার, জয় বাংলাদেশের।

এটি একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল বেঙ্গল টাইগার্স ও কানাডিয়ান বিভারসের মধ্যে। খেলায় বেঙ্গল টাইগার্সের পক্ষে অংশ নেন সোহান কবিরী, নাঈমুর রহমান, মো. আলভী নুর, মনোয়ার, জুলকার নাঈন ভূঁইয়া ও লেখক। আর কানাডিয়ান বিভারসে ছিলেন মেহেদি হাসান, তাহের আহমেদ, আবদুর রহমান, জাহিদ আহমেদ, আরিফ বখতিয়ার ও আবদুল্লাহ। ২০ মিনিটের খেলায় কানাডিয়ান বিভারস ২ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে জয়লাভ করে।

বিজয়ী দলের খেলোয়াড়েরা
বিজয়ী দলের খেলোয়াড়েরা

খেলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আল-রায়হান ও ফারদান। তাঁদের সহযোগিতা করেন ইফাত, মাইশা, শুভ, রাশেদুল প্রমুখ। প্রিয়া ভিকাজি ও সোহান কবিরী ইভেন্টটি প্রচারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। খেলাটিকে প্রচার করার জন্য বাংলাদেশ স্টুডেন্ট সোসাইটি ও ইউএনবির নিউজলেটার, সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকসহ বিভিন্নভাবে প্রচার চালায়।

ইউএনবি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশি-কানাডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব নিউব্রান্সউইকের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ডিরেক্টর ড. তারিক হাসান এখানকার ছাত্রছাত্রীদের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা এখানে একটা পরিবারের মতো। তারা শুধু পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ না থেকে যেমন পরস্পরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তেমনি কমিউনিটির প্রত্যেক ইভেন্টে (পয়লা বৈশাখ, ঈদ উদ্‌যাপন, পিঠা উৎসব প্রভৃতি) তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অবদান উল্লেখযোগ্য।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা প্রমাণ করে আমরা সবাই নিউব্রান্সউইকে একটা বাংলাদেশি পরিবার। তারা এখন নিজেদের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশি ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের (কমিউনিটি) মধ্যে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ইউএনবি তথা কানাডীয় সংস্কৃতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করছে। তাদের এমন নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।’ তিনি বরফ কাবাডি নামে নতুন খেলা চালুর জন্য সংগঠকদের ধন্যবাদ জানান।

খেলার দৃশ্য
খেলার দৃশ্য

বাংলাদেশ স্টুডেন্ট সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আশিকুল হক তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, সত্যি করে বললে শুরুর দিকে বরফ কাবাডির ব্যাপারে খুব আগ্রহ পাইনি। কিন্তু পরে যখন প্রচারে গেলাম, তখন দেখলাম আমার থেকে বরং আমার পরিসংখ্যান বিভাগের বন্ধুদের আগ্রহ অনেক বেশি। সকাল থেকেই অনেক উত্তেজিত ছিলাম। অবশেষে খেলাটি অনেক উপভোগ্য ছিল ভিন্ন ফরম্যাটের কারণে।

কানাডিয়ান বিভারসের খেলোয়াড় আরিফ বখতিয়ারের ভাষায়, বরফ ও ঠান্ডার কারণে শুরুতে কিছুটা জড়তা থাকলেও খেলার উচ্ছ্বাসে তা কেটে যায়। খেলার সময় ও পরে আর ঠান্ডা অনুভূত হয়নি। বরং অনেককে ঘামতে দেখা যায়। সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেওয়ায় খেলাটা অনেক উপভোগ্য ছিল। অনেক দিন পর নিজের দেশের জাতীয় খেলা কানাডার মতো একটি দেশে খেলতে পেরে আমরা সবাই অনেক আনন্দিত ও গর্বিত।

কাবাডির ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে বেঙ্গল টাইগার্সের খেলোয়াড় মো. আলভী নুর বলেন, ‘প্রথম বরফ কাবাডির পরিকল্পনা শোনার সময় কিছুটা আশ্চর্যান্বিত না হয়ে পারিনি। প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে নিজের দেশের খেলার রোমাঞ্চটা একটু বেশিই। তার ওপর যে খেলার শত বছরের ঐতিহ্য গ্রাম-বাংলার মাঠে-কাদায়, সেখানে এক হাঁটু তুষারের মধ্যে সেই খেলা কেমন হবে, সেটাও মহামূল্যবান প্রশ্ন বটে।’
---

নূর আলম: পিএইচডি ক্যানডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।