আমার নক্ষত্র মা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

তোমার নিকোনো উঠোনজুড়ে একটাও সবুজ আগাছা জন্ম নেয়নি সেদিন। যেদিন তোমার নিথর শরীরটা নিয়ে গেলাম তিন বছর পর। কী অদ্ভুত মায়াময় করে আগাম গুছিয়ে চলে গেলে তুমি।

সবুজবীথি গাছগুলো যেন স্পর্শবিহীন কাতরতা প্রকাশ করছে।

আমি আনমনে হেঁটে যাই, তুমিহীন তোমার মহল আজ, শ্রীহীন, আমি প্রতিদিন হেঁটে বেড়াই, অবশ্যই অগোচরে। আর হাহাকারগুলো টের পাই।

নৈবেদ্যের শূন্যতা শুনি জলপাই, পেয়ারা, আমলকী, হরীতকী, বাতাবি লেবু আর ঝাঁজালো মরিচগাছগুলো থেকে।

তোমার মহলে কী যেন নেই। সেই আলোটা, শাসন, খামখেয়ালির হাসিটা, অম্লান বদনে চোখ দিয়ে তোমার কাতর ডাক, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জত নামাজের অজুর শব্দ...বুকের ভেতর কেউ বাজিয়ে যাচ্ছে।

গাছ থেকে সুগন্ধি লেবুটা ছিঁড়ে এনে কেউ আর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে ডাকবে না।

চিনিগুঁড়া চালের তেলের পিঠা, ললিতা আলুর ঝাল ভর্তাটা, পাঁচমিশালি সবজির লাবড়া থেকে শুরু করে কই, মটরশুঁটি মাখা, হাতে মাখানো পাবদা মাছের ঝোল আর...আর সেলাই মেশিনের খটাখট শব্দ। কোথায় গেলে শোনা যাবে?

কুশি কাঁটার বুননে ছোট ছোট প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দেখে এলাম, অযত্নে, অবহেলায়।

আমি তোমার ঘরটায় তোমার ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। অলিভ ওয়েল, শর্ষের তেল আর নিভিয়া ক্রিমের গন্ধটা আমি ব্যাকুল হয়ে খুঁজেছি।

তোমার রুমের পাশেই ছিল শিউলি ফুলের মাদকতা। ভোরবেলায় কুড়িয়ে এনে বৈঠকি ঘরে রেখে দিতে।

একটা ছোট লাইব্রেরি করার ইচ্ছে নিয়ে অসংখ্য বই এখন অনাদরে। দেয়াল আলমিরার তাকে বইগুলোর এখনো তোমার নামের সিলমোহর। অনুরোধের ডালিতে গুছিয়ে রেখে এসেছিলাম।

কী ছিল না, তোমার ভালোবাসার সিন্দুকে? জলপাই আর আমের আচার, কাঁঠালের বিচি শুকানো। কী ছিল না!

আগলে রেখেছ, সন্তানদের জন্য। দুই হাত উজাড় করে পরিপূর্ণ করে শূন্য হাতে চলে গেলে।

কাউকে তো কিছুই বলে গেলে না। শুধু নীরবে নিঃশব্দে নিজের কাজগুলো যত্ন নিয়ে অমূল্য করে গেলে; মমতাময়ী।

আমাদের তো এখন একসঙ্গে বইমেলা, বৃক্ষমেলা, বাণিজ্য মেলায় আর কখনো যাওয়া হবে না।

হয়তো হবে আবার হবেও না।

কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, শুধু তোমার ধুলোমাখা চরণের ধুলো উড়বে না।

তোমার জন্য আর তো অপেক্ষার তীব্র দৃষ্টি থাকবে না, আম্মু।

এখন তো আমাকে কেউ ‘আবু’ বলে ডাকবে না;

আমিও কপট রাগ কারও সঙ্গে দেখাব না।

তোমাকে নিয়ে আর তো পেরে উঠতে পারছি না।

তুমিবিহীন এই জীবনে দগদগে ক্ষত নিয়েই, বেঁচে থাকব।

অজস্র শূন্যতায় ডুবিয়ে এভাবে চলে যেতে নেই মা।

চাকরিজীবী হওয়াতে সন্তানদের সময় দেওয়া নিয়ে ছিল এক অপ্রাপ্তি; অথচ কারও সঙ্গে কথা না বলে, কথা না দিয়ে, সময় না নিয়ে, অভিমানী হয়ে গেলে বেমালুম।

আমাদের কাছে তুমি ছিলে শক্তি, সাহস, স্পৃহার অনবদ্যতা।

অসময়ের কাছে ছিল তোমার অভিমানী সমর্পিত ইচ্ছামৃত্যু।

খেয়ালি হয়ে শিশুসুলভ আচরণগুলো নিয়ে মায়ের মতন তোমাকে শাসন করেছি, কিন্তু কখনোই বুঝতে পারিনি তোমাকে।

নিজেকে কখনোই প্রকাশ করতে চাওনি, নীরবে, নিভৃতে, আড়ালে থাকাটা ছিল নিতান্তই তোমার পছন্দের।

মাথার ওপর মস্ত আকাশে খুঁজে ফিরি; ক্যাসোপিয়া নক্ষত্র থেকে চোখ সরিয়ে আমাদের ধ্রুবতারা নক্ষত্র মা; ভালো থেকো আপন মহিমায়।

বিজন ঘরে নিশীথ রাতে শূন্য হাতে, আপনমনে শোনার ব্যাকুলতাটা ছিল প্রকাশমান।

অথচ তুমি নেই; মিলিয়ে গেলে, একাকিত্বের ভয়ে। ভয়কে জয় করার স্পৃহাটাকে পেছনে ফেলে।

কিন্তু হাজারো সমীকরণের উপস্থিতিতে, নেই বললে ভুল হবে। অস্তিত্বে জুড়ে আছ, বুকের ভেতরটাতে শ্বাস–প্রশ্বাসের মতো আটকে আছ কষ্টের তীব্রতায়।

দম আটকে রেখেও কিচ্ছু করতে পারছি না। তুমি আছ, থাকবে...সবখানে...।

নাড়িছেঁড়া ধন তোমায় আগলে রাখবে খুব গভীরে, গোপনে, স্মৃতিতে, স্মারকে।

তুমি শুধু ভালো থেকো মা। আমাদের নক্ষত্র মা।

এই কথাগুলো আমার বোনমা নুর এ জান্নাতকে উৎসর্গকৃত, যে কিনা প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে।

অনেক ভালোবাসার আপুকে।