নতুন দিনের সিনডারেলা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সে অনেককাল আগের কথা। দূরের নিঝুম বনের পাশেই ছিল বিশাল এক রাজ্য। রাজ্য থাকলেই রাজা থাকতে হয়। সেখানেও আছে। বিশাল এক প্রাসাদে রাজা তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে থাকেন। রানি অনেককাল আগেই গত হয়েছেন।

তবে, এই গল্পটা রাজপুত্র বা রাজার নয়। গল্পটা হচ্ছে দারুণ সাহসী আর হৃদয়বান এক কন্যার।

সেই রাজ্যের এক কোণে থাকতেন একজন সওদাগর। দূর দেশ থেকে সিল্ক আর চমৎকার কারুকার্য করা কাপড় আনতেন তিনি। সৎ ও নিষ্ঠাবান এই সওদাগর উঁচু পাঁচিলঘেরা সুন্দর এক অট্টালিকায় তার ছোট্ট মেয়ে এলাকে নিয়ে থাকতেন।

সওদাগরের স্ত্রী এক কঠিন রোগে কিছুকাল আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সওদাগর সেই দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেন তার আদরের কন্যা এলার দিকে তাকিয়ে। এত অল্প বয়সেই সে বুঝে নিয়েছে বাড়ির দায়িত্ব। লক্ষ্মী, পরিশ্রমী এলা পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমনি দারুণ তার গানের গলা।

প্রতিদিন সকালে বাসার ফালতু হাঁস-মুরগি, ঘোড়া আর প্রিয় কুকুরকে খাবার দিতে দিতে সে আপনমনে গান গাইত। আর সে গান শুনতে আসত বনের পাখি আর ঘরের কোণে থাকা ইঁদুরেরা। এলা তাদেরও আদর করে খাবার দিত। বিনিময়ে পশুপাখিরা দিত তাদের ভালোবাসা।

যদিও তাদের দিন সুখেই কাটছিল, তবু সওদাগরের মন সর্বদা খুঁত খুঁত করত। তার মনে হতো, তিনি তার মেয়ের জন্য যথেষ্ট করতে পারছেন না। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেরিয়ে যান, আর ফেরেন সেই সন্ধ্যায়।

মা ছাড়া বাচ্চাদের যত্নআত্তি কি আর হয়? এসব ভেবে সওদাগর দেখেশুনে ভালো বংশের এক নারীকে বিয়ে করলেন। সেই নারীর রয়েছে আগের ঘরের দুই যমজ মেয়ে অ্যানাস্টেসিয়া ও ড্রেজিলা। সওদাগর সেই নারীর হাতে এলার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। এলাও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করল তার নতুন মা আর বোনদের। সৎমা নিজের মেয়েদের সঙ্গে এলার দেখাশোনাও করতে লাগল।

তবে এলার কপালে সৃষ্টিকর্তা অন্য কিছুই লিখে রেখেছিলেন। একবার অনেক অনেক দূরের দেশে তার বাবা বাণিজ্য করতে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। খবর এল, জাহাজডুবি হয়েছে। এলা কাঁদতে কাঁদতে তার দুই চোখ ফুলিয়ে ফেলল। সান্ত্বনার জন্য সে গেল তার সৎমায়ের কাছে। তখনই বোঝা গেল তার সৎমায়ের আসল চরিত্র।

সৎমা প্রথমেই দেরাজ খুলে বাড়ির দলিল ও সওদাগরের করা উইল বের করে সিন্দুকে লুকিয়ে ফেলল। এরপর পুরো বাড়ি ও ব্যবসা দখল করে নিল। তার নিজের অত খাটাখাটুনির ইচ্ছে নেই। তাই দোকান সে একজনকে ভাড়া দিয়ে দিল।

এলা হতভম্ব হয়ে দেখল, বাবা মারা যাওয়ার দশ দিনের মাথায় তার স্থান হয়েছে বাড়ির চিলেকোঠায়। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে সে আবিষ্কার করল ন্যাকড়া হাতে কয়লার পাত্রের পাশে। অঙ্গার বা সিন্ডারের পাশে বসে সে ঘরের সব কাজ করত বলে তাকে সবাই ডাকা শুরু করল সিনডারেলা।

দিন যায়, ধীরে ধীরে সিনডারেলা কিশোরী থেকে তরুণী হয়। নতুন জীবনে সিনডারেলার দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। বনের পাখিরা কিচিরমিচির করে তার ঘুম ভাঙায়। এরপরে বাড়ির সবার নাশতা, সৎমার বিড়ালের পরিচর্যা, কাপড় ধোয়া, খাবার তৈরি করা, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করা। কত কাজ।

এত করেও সিনডারেলা তার সৎমা আর বোনদের মন জয় করতে পারে না। দুই বোন হিংসা করে তাকে বেশি বেশি কাজ দিত। তবে সিনডারেলা তার ভাগ্য মেনে নিয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও তার গলায় মিষ্টি গান, মুখে হাসি।

সেদিনও সে প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী ঘরের কাজ করছিল। হঠাৎ দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। সিনডারেলা দরজা খুলে দেখতে পেল রাজপ্রাসাদ থেকে লোক চিঠি নিয়ে এসেছে। চিঠি পড়ে সৎমা আর তার মেয়েরা দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

রাজপুত্রের জন্য রাজা আয়োজন করেছেন দারুণ এক বলনাচের আসর। তাতে রাজ্যের সব বিবাহযোগ্যা মেয়েরা আমন্ত্রিত। রাজার উদ্দেশ্য তার পুত্রের জন্য কনে খোঁজা।

সিনডারেলাও উত্তেজনায় ভেসে গেল। সে কল্পনায় দেখল চমৎকার হালকা নীল আলোর মাঝে সুসজ্জিত মেয়েরা নাচছে। এক পাশে মুখরোচক সব খাবার, আরেক পাশে কৃত্রিম সরোবরে হাঁসের দল ভেসে চলেছে। চটপট ঘরের কাজ সেরে ফেলল সিনডারেলা। তার মায়ের পুরোনো একটি গাউনে চমৎকার ফ্রিল আর লেস বসাল সে। তাকে সাহায্য করল পাখি আর ইঁদুরের দল।

সন্ধ্যায় সেজেগুজে সে নিচে নেমে এল। পরির মতো ফুটফুটে সিনডারেলাকে দেখে তার সৎমায়ের মুখ হা হয়ে গেল। অ্যানাস্টেসিয়া আর ড্রিজেলা প্রচণ্ড রেগে গেল। তাদের কোনোই ইচ্ছে নেই সিনডারেলাকে সঙ্গে নেওয়ার। সৎমায়ের ইশারায় হঠাৎ দুই বোন ঝাঁপিয়ে পড়ল সিনডারেলার ওপরে। ছিঁড়ে ফেলল তার সুন্দর গাউন। বেচারি সিনডারেলা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল তাদের বাগানে। সৎমা আর বোনেরা জুড়িগাড়ি চেপে রাজপ্রাসাদে চলে গেল।

সিনডারেলাকে কাঁদতে দেখে পোষা কুকুর এসে আদর করে, পাখিরা ভালোবাসা দিয়ে যায়। কিন্তু সিনডারেলার দুঃখ প্রশমিত হলো না একবিন্দু। অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। একসময় চোখের পানিও গেল ফুরিয়ে। হঠাৎ সিনডারেলা চোখের পানি মুছে উঠে বসল। আর না, যথেষ্ট হয়েছে। সবকিছুর একটা সীমা আছে। কিন্তু কী করতে পারে সে? আচ্ছা, তার বাবা এত বুদ্ধিমান ও বৈষয়িক মানুষ ছিলেন। তিনি কী করে সিনডারেলার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে সৎমার ওপরে ছেড়ে দিতে পারলেন? আসলেই কি তাই করেছেন?

সিনডারেলা মুখ ধুয়ে কাপড় পালটে নিল। এরপর বাসা থেকে বের হয়ে রওনা দিল শহরের দিকে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের পাশের এক বেঞ্চিতে। আর তখনই সে দেখতে পেল বেশ দামি কাপড় পরা মোটাসোটা ভালো মানুষ চেহারার এক নারী রাস্তার অপর পাশের বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

সিনডারেলা চোখ খুলে কষ্ট করে বাড়ির ওপরে বসানো সাইনবোর্ডটা পড়ল। ফেয়ারি গডমাদার্স অ্যাডভাইজারি সেন্টার। সিনডারেলার চোখে চোখ পড়াতে সেই নারী আন্তরিক হাসি দিলেন। সিনডারেলা পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে।

: আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনি কি ফেয়ারি গডমাদার?

: ঠিক ধরেছ বাছা।

হাসিমুখে উত্তর দিলেন গডমাদার। আমিই সেই ব্যক্তি। কেন বলো তো! আমি কি তোমাকে চিনি?

: আমার নাম সিনডারেলা। আমার বাবার নাম অ্যালেক্স বেকার।

: বটে! তুমিই অ্যালেক্সের মেয়ে? তাই বলি, চেনা চেনা কেন লাগে। তোমার সঙ্গে অ্যালেক্সের চেহারার অনেক মিল। তা বাছা কী করতে পারি তোমার জন্য?

কিছুটা ইতস্তত করে সিনডারেলা বলল, আমি শুনেছিলাম ফেয়ারি গডমাদার অনেক জাদু জানেন। আপনি কি জাদুর কাঠি দিয়ে আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারেন?

জোরে হেসে উঠলেন ফেয়ারি গডমাদার, যেন সিনডারেলা ভারী মজার একটা কথা বলেছে।

: জাদু? জাদুর কী প্রয়োজন পড়ল তোমার বলো দেখি!

সিনডারেলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুঁপিয়ে উঠল, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার অনেক কষ্ট। আমার সৎমা আর বোনেরা আমাকে তাদের দাসীর মতো বন্দী করে রাখে। আজকে বলনাচের আসরে যাওয়ার পোশাকও তারা ছিঁড়ে দিয়েছে।

ফেয়ারি গডমাদার মাথা নাড়লেন, আর তোমার মনে হচ্ছে চোখের পানি এবং জাদু হচ্ছে তার সমাধান?

সিনডারেলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ফেয়ারি গডমাদার হাসিমুখে বললেন, যদি জাদুর খোঁজে তুমি এসে থাক, তবে বলতেই হবে, আমি তোমার কোনো কাজে আসব না। তবে হ্যাঁ, যদি পরিশ্রমী হও, সৎ হও এবং বিপদকে ভয় না পেয় ভাগ্যকে বদলানোর ইচ্ছে থাকে, তবে হয়তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমি একজন পরামর্শদাতা ও আইনজীবী।

সিনডারেলার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, আমি বিপদকে ভয় পাই না। আমি আমার ভাগ্য বদলাতে চাই, আমার প্রাপ্য আদায় করতে চাই।

ফেয়ারি গডমাদার ঘরের দরজা খুললেন, তবে এসো, এক কাপ চা খেতে খেতে আমি শুনি তোমার সমস্যাটা কী।

সে রাতে দৃঢ় মন নিয়ে সিনডারেলা বাসায় ফিরে এল। তাকে দেখে ইঁদুরের দল মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। তাদের ভালোবাসার সিনডারেলার মাঝে কোনো একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কী সেই পরিবর্তন, তারা সেটা ধরতে পারল না।

পরদিন থেকেই সিনডারেলা কাজের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়িতে তার বাবার দলিলপত্র খুঁজতে শুরু করল। সঙ্গে তার বার্থ-সার্টিফিকেট আর অন্য দরকারি কাগজপত্র। সৎমা কোনো কাগজই তাকে কখনো ধরতে দেয়নি। কিন্তু পুরো বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজেও কোনো কাগজ সে খুঁজে পেল না। তখন সে এক বুদ্ধি আঁটল। শহরের এক দোকান থেকে সে সস্তায় কিনে আনল এক আংটি। আংটি নকল হলেও একনজরে চট করে বোঝা যায় না যে তাতে হিরের পরিবর্তে কাচের টুকরো বসানো।

বাসায় ফিরে সে সৎমাকে সেই আংটি দিয়ে বলল, ঘরের কোণে এটা সে খুঁজে পেয়েছে। সৎমা ঝংকার দিয়ে উঠল দুই মেয়ের ওপর। সিনডারেলা চোখ বড় বড় করে সৎমাকে বলল, এটা কী আসল হীরা? বাবা বলেছিল, মায়ের নাকি এ রকম একটা আংটি ছিল।

সৎমার চোখ লোভে জ্বলে উঠল। তবে তাচ্ছিল্যভরে বলল, কে বলেছে আসল হীরা? বাজে নকল পাথর। থাক এটা আমার কাছে। এটা কোনোভাবেই তোমার মায়ের নয়।

সিনডারেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র সৎমা লুকোনো জায়গা থেকে চাবি বের করে সিন্দুক খুলল। আসল নাকি নকল হীরা সে পরে পরখ করা যাবে। যদি সত্যি আসল হীরা হয়? তবে সে টেরও পেল না, সিনডারেলা দরজার কোণেয় দাঁড়িয়ে সবই দেখছে।

পরদিন সৎমা তার দুই মেয়েকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়া মাত্র সিনডারেলা লুকোনো স্থান থেকে চাবি বের করে সিন্দুক খুলে ফেলল। সিন্দুকভর্তি গয়না আর কাগজপত্র। কিছু গয়না দেখামাত্র সিনডারেলা চিনতে পারল। এগুলো তার মায়ের গয়না। সিনডারেলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাগজগুলো পরীক্ষা করে। একদম নিচের দিকে লাল কাপড়ে মোড়া কিছু কাগজ খোলামাত্র সে বুঝতে পারে, এগুলোই তাদের বাড়ির দলিল। তবে সে জানত না, তার বাবার উইলও এখানে। কাগজগুলো নিয়ে সিনডারেলা দিল ছুট। দোতলার জানালা থেকেই ফেয়ারি গডমাদার দেখলেন সিনডারেলা ছুটতে ছুটতে আসছে। চায়ের কেটলিটা উনুনে দিয়ে তিনি হাসিমুখে দরজা খোলেন। সিনডারেলাকে বলেন, মনে হচ্ছে সুসংবাদ?

দরজায় অনেকক্ষণ ধরে কেউ কড়া নাড়ছে। সৎমা সিনডারেলার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে গলা প্রায় ভেঙে যাওয়ার দশা। তা–ও কেউ উত্তর দিচ্ছে না। প্রচণ্ড রেগে গেল সৎমা। হতচ্ছাড়া মেয়ে হাতে আসুক আগে, তিন দিন তাকে খেতে দেবে না। রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে দেখল একজন লোক একটা চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

চিঠি নিয়ে লোকটির মুখের ওপরে দরজা আটকে দিল। এমনিতেই তার মেজাজ খারাপ। তার গাধা দুই মেয়ের এক মেয়েও রাজপুত্রকে পটাতে পারেনি। তার কত স্বপ্ন ছিল রাজপুত্রের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিয়ে প্রাসাদে থাকার। ধীরে ধীরে পলিটিকস করে পুরো রাজ্যই হাতের মুঠোয় নিয়ে নিত সে।

যা হোক, চিঠি খুলে পুরোটা পড়ল সিনডারেলার সৎমা। ঠিক কী লিখেছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকবার পড়ল, তারপরে আরেকবার। ধীরে ধীরে মুখের রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চিঠিটি আইনের চিঠি। অন্যায়ভাবে অ্যালেক্স বেকারের সম্পত্তি দখল করার জন্য কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে না, তার কারণ অতিসত্বর দর্শানোর নোটিশ।

ছুটে গিয়ে কাঁপা হাতে সিন্দুক খুলল সে। একনজর দেখেই বুঝল, উইল আর দলিল সেখানে নেই। সিনডারেলার অনুপস্থিতির কারণও এখন বোঝা গেল। অক্ষম আক্রোশে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সিনডারেলার সৎমা।

এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ফেয়ারি গডমাদারের সহায়তায় নিজের বাবার সম্পত্তি উদ্ধার করল সিনডারেলা। দোকানটিও সে আবার খুলে দিল। তার বাবার পুরোনো ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করল সে। সৎ ও নিষ্ঠাবান অ্যালেক্সের কন্যাকে সাহায্য করল সবাই।

এরপর এক সুন্দর সকালে ফেয়ারি গডমাদারকে দিয়ে সে উদ্বোধন করাল তার তিন-তিনটি জাহাজ। দূরদেশ থেকে আনা হবে সিল্ক আর হাতের কাজের নরম কাপড়। নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে সিনডারেলা তার বাবার ব্যবসা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার কাজে মন দিল। সফলতা মিলল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই।

ডাকাবুকো, বুদ্ধিমান ও বিনয়ী এই ব্যবসায়ী মেয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ল শহরে। একবার রাজপুত্র নিজেও এল সিনডারেলার দোকানে। পাশের রাজ্যের রানি আর রাজকন্যাদের উপহার পাঠাবে এই রাজ্যের তরফ থেকে। সিনডারেলাকে দেখে রাজপুত্র মুগ্ধ হয়ে গেল। কী দারুণ স্বাধীনচেতা নারী। মিষ্টি হেসে সে অভ্যর্থনা করছে আগত ক্রেতাদের আবার একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে খেয়াল রাখছে তার কর্মচারীদের কার্যক্রম। সিনডারেলা নিজেও রাজপুত্রকে দেখে লাজুক হাসি দিল।

এক বিকেলে রাজপুত্রকে দেখা গেল সিনডারেলার দরজায়, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সিনড্রেলা হাসিমুখে বলল, রাজকন্যারা কি চীনে যায় বাণিজ্য করতে?

রাজপুত্র মাথা চুলকাল, তা কী করে হবে! রাজকন্যারা থাকবে প্রাসাদে। বাবা মোটেই পছন্দ করবেন না। চীনের বাণিজ্য এত ভালো লাগলে আমরা নাহয় কয়েকটা জাহাজ পাঠাব ওখানে?

সিনডারেলা মাথা নাড়ে, তাহলে যে হবে না রাজপুত্র। এটা আমার নিজের ব্যবসা। অন্যের ওপরে দায়িত্ব দিয়ে বাসায় বসে থাকার মানুষ তো আমি নই। আসলে তোমার জন্য দরকার একজন রাজকন্যা, যে তোমার মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। কাজ না করে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়েই মারা যাব।

রাজপুত্র সেদিন বিদায় নেয়।

কিন্তু কিছুদিন পরে তাকে আবার দেখা যায় সিনডারেলার দোকানে।

: আচ্ছা, চীনে তো শুনতে পাই তুমি আগামী বছর যাবে। এখন সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করার পর এক কাপ কফি চলবে কী?

সিনডারেলা মিষ্টি হাসি দেয়।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, সিনডারেলা আর রাজপুত্র কফির পর্ব শেষ করে এখন ডিনার-পর্বে আছে। শোনা যাচ্ছে, বাণিজ্যে রাজ্যে এতই লাভ হয়েছে যে রাজাও এখন রাজকন্যাদের কাজকর্ম করানোর ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। তারা বিয়ে করবে কি না, এখনো ঠিক করেনি। তবে রাজ্যের কাজে-কর্মে রাজপুত্রের যত উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সিনডারেলাকে রাজি হতেই হবে।

আমার গল্পটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল।

পুনশ্চ: সিনডারেলা আমার সবচেয়ে প্রিয় রূপকথার একটি। এত দিন আসল গল্পেই সন্তুষ্ট ছিলাম। তবে সম্প্রতি নিকিতা গিলের ‘সিনডারেলা’ কবিতাটি পড়ে নড়েচড়ে বসেছি। একটি রূপকথাও যে আমাদের চিন্তাধারায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নতুন করে ভাবিয়েছে। এই নতুন দিনের সিনডারেলা গল্পটি নিকিতা গিলের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত।