লন্ডনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন

আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে হাইকমিশনার অনুষ্ঠানস্থলে স্থাপিত প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে হাইকমিশনার অনুষ্ঠানস্থলে স্থাপিত প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

যুক্তরাজ্যের জাতীয় ইউনেসকো কমিশন ও কমনওয়েলথের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে লন্ডনে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। যথাযোগ্য মর্যাদা, বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বিস্তারিত কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিব শতবর্ষ উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে ইউনেসকো নির্ধারিত ‘ল্যাংগুয়েজ উইদাউট বর্ডারস’ মূল প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে আয়োজিত দিবসের প্রধান কর্মসূচি আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বাগতিক দেশ বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের কূটনীতিক ও শিল্পী এবং বাংলাদেশি-ব্রিটিশ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।

লন্ডনের একটি হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে প্রথম বাঙালি হিসেবে বাংলায় ভাষণ দিয়ে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে সমুন্নত করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে।

কমিশনার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই ১৯৯৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রতিটি সভায় বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার অব্যাহত দাবি জানিয়ে চলেছেন। এ ছাড়া বিশ্বের ৮ হাজার মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন।

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল স্লোভাকিয়া, মেসেডোনিয়া, জর্জিয়া ও সার্বিয়ার রাষ্ট্রদূতদের তাঁদের ভাষায় কবিতা আবৃত্তি ও বক্তব্য। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল স্লোভাকিয়া, মেসেডোনিয়া, জর্জিয়া ও সার্বিয়ার রাষ্ট্রদূতদের তাঁদের ভাষায় কবিতা আবৃত্তি ও বক্তব্য। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষাশহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর হাইকমিশনার আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে স্থাপিত প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।

আলোচনায় অংশ নেন কমনওয়েলথের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল অর্জুন সোদ্ধু, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ, বাংলাদেশি-ব্রিটিশ কমিউনিটির প্রতিনিধি ও যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ, বাংলাদেশের রাজনীতিক ও বিশিষ্ট চক্ষুবিশেষজ্ঞ সৈয়দ মোদাসসের আলী, সোয়াসের অধ্যাপক সানজোকা ঘোষ, আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ও ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের প্রতিনিধি ড্যানিয়েল পাশা।

এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ইউকে কমিশন ফর ইউনেসকোর প্রধান নির্বাহী ও সেক্রেটারি জেনারেল জেমস ব্রিজের একটি শুভেচ্ছা বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়।

অনুষ্ঠানে রাশিয়ার শিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
অনুষ্ঠানে রাশিয়ার শিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল স্লোভাকিয়া, মেসেডোনিয়া, জর্জিয়া ও সার্বিয়ার রাষ্ট্রদূতদের তাঁদের ভাষায় কবিতা আবৃত্তি ও বক্তব্য এবং ভারত, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া ও স্বাগতিক দেশ বাংলাদেশের শিল্পীদের নিজ নিজ ভাষায় সংগীত, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশনা। প্রায় চার শ আমন্ত্রিত অতিথি অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি শিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি শিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

এর আগে অমর একুশের দিনের শুরুতে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম হাইকমিশন ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়। ভাষাশহীদ এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও সাফল্য কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

এ ছাড়া লন্ডনে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে হাইকমিশনার টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার ভিক্টোরিয়া ওবাজ ও মেয়র জন বিগসসহ পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সম্মাননা প্রদান 

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে বাংলাদেশ হাইকমিশন একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে গত বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) মুজিব শতবর্ষ বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছে। বাংলাদেশে অমর একুশের সূচনালগ্নে ফুলেল শুভেচ্ছাসহ আবদুল গাফফার চৌধুরীর হাতে এই বিশেষ সম্মাননার ক্রেস্ট তুলে দেন হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম।

বাংলাদেশ হাইকমিশন একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
বাংলাদেশ হাইকমিশন একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পক্ষ থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন মিশনে হাইকমিশনার, বাংলাদেশি-ব্রিটিশ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মিশনের কর্মকর্তারা আবদুল গাফফার চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ‘গানটিতে কণ্ঠ মিলিয়ে অমর একুশের মহান ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনের এই আয়োজন ছিল অভূতপূর্ব ও ব্যতিক্রমধর্মী।

সম্মাননা দেওয়ার পর আবদুল গাফফার চৌধুরী আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে এ ধরনের আয়োজনের জন্য হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীমসহ লন্ডন মিশনের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন যে সম্মান দিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। আমি এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ জানাই। কারণ, তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে আজ মহান একুশে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

বক্তব্য দেন হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
বক্তব্য দেন হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম। ছবি: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন

গাফফার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে সুকৌশলে ভুল পথে পরিচালিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। সেই বিভ্রান্তির কবল থেকে দেশ ও জাতি আজ মুক্ত। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির উন্নয়নে যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, সেই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরই কন্যা বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের দরবারে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। আমি আশা করি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর “সোনার বাংলায়” পরিণত হবে।’

স্বাগত বক্তব্যে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি বাংলা ভাষা ও মহান একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে মুজিব শতবর্ষে বিশেষ সম্মাননা দিতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।’
সাইদা মুনা বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী শুধু বাঙালি জাতির নয়, বিশ্বের সব বাংলাভাষীর গর্ব। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশিদের তিনি বাতিঘর। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের বাংলা সাংবাদিকতায়, সাহিত্যে এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সুচিন্তিত ও গবেষণামূলক লেখায় তাঁর অবদান অপরিসীম।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি-ব্রিটিশ কমিউনিটির প্রতিনিধি সুলতান মাহমুদ শরীফসহ আবদুল গাফফার চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বরা স্মৃতিচারণামূলক বক্তব্য দেন। বিজ্ঞপ্তি