ভাষা নিয়ে একটু ভিন্ন চিন্তা

সচিত্রকরণ: তুলি
সচিত্রকরণ: তুলি

ভাষার মাসে অনেকের ফেসবুক ওয়ালে নানা কিছু শেয়ার হতে দেখি। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বরে ফেসবুকের বাঙালির দেশপ্রেমের চেতনাবোধ বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কাজেই গা করার কিছু নেই। বিপদসীমা এ কারণেই বলছি, এই সময় অনেকেই উগ্র জাতীয়বাদীর মতো আচরণ শুরু করে দেন।

‘বাংলা ছাড়া এই মাসে একটি ইংলিশ ওয়ার্ডও উচ্চারণ করব না। মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!’ এমন কথা বলেন কেউ কেউ। তাঁদের সামনে যদি কেউ ভুল করেও ইংরেজিতে কথা বলে বসেন, তাহলে কথাই নেই। দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট হাতছাড়া হয়ে যাবে। যেকোনো বিষয়ে উগ্রবাদ মানুষকে কেবল মূর্খই প্রমাণ করে। এর বেশি কিছু নয়।

যাহোক, ফেসবুক ওয়ালের একটি পোস্টের ভুল ব্যাখ্যা বা মিস ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। সেটা হচ্ছে, ‘আমি বাংলা ছাড়া আর কিছুই পড়ব না। এর জন্য যদি কামলাগিরিও করে খেতে হয়, তাহলেও সমস্যা নেই।’

খুবই ইমোশনাল কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন। সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। নিলেই বরং বিপদে পড়বেন।

ভাষার মাসে আমরা বেশির ভাগই লিখি আমাদের dude generation যেভাবে নিজেদের বাংলা ভাষাকে খ্যাত, অশিক্ষিত শ্রেণির মানুষের ভাষা গণ্য করছে, ইংরেজিতে কথা বলতে না পারাকে unsmart জ্ঞান করছে, সেটা কেবল ভুলই নয়, রীতিমতো অপরাধের মতো। কিন্তু তাই বলে ইংরেজি ভাষা জানাটাকে কি তিরস্কার করা ঠিক? অবশ্যই না।

বরং আমার মতে, প্রতিটি বাঙালির অবশ্যই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় সমান দক্ষ হওয়াটা জরুরি। সঙ্গে ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষায় দক্ষ হলে তো কথাই নেই। না হলে বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় কখনোই সামনে এগোতে পারব না।

আমেরিকানদের অনেকে আমাদের মুখে ইংরেজি শুনে খুব অবাক হন। জিজ্ঞেস করেন, তুমি মাত্র এই কয় বছরে ইংরেজি শিখে ফেলেছ?

যখন বলি আমরা আমাদের দেশে শৈশব থেকেই ইংরেজি শিখি, হেমিংওয়ে, এডগার অ্যালেন পো প্রমুখের লেখা আমরাও পড়ি; তখন তারা মোটামুটি একটা খটকা খায়। কারণ, তারা খুব দরকার না হলে নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য বিদেশি ভাষা শেখে না। আমাদের সমস্যাটা কী? বিশেষ করে চীনা, জাপানি কিংবা ইউরোপিয়ানরা নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া ইংরেজি তেমন শেখেই না।

তাদের যখন আরও বলি, আমরা কেবল বাংলা ও ইংরেজিই নয়, হিন্দি-উর্দু ভাষায়ও কিছুটা পারদর্শী এবং আরবি ভাষাটা দেখে দেখে পড়তে পারি, তখন তাদের চোখ কপালে উঠে যায়। কেউ কেউ বিস্ময়ে বলেও ফেলেন, তোমরা কত সৌভাগ্যবান! আমরা ইংরেজি আর কালেভদ্রে স্প্যানিশ (মেক্সিকানদের অবদান) ছাড়া আর কোনো ভাষাই পারি না।

দেশের অনেককেই দেখি হিন্দি ভাষা জানা লোকজনকে তিরস্কার করেন। কেউ উর্দুতে কথা বললে তো কথাই নেই। সরাসরি রাজাকার ট্যাগ পেয়ে যাবে। কিন্তু ভাষার কি কোনো জাত-ধর্ম আছে? যে দোষে আমরা পাকিস্তানিদের দুষ্ট বলি, সেই একই অপরাধ আমরা করি কোন লজিকে? বাংলাকে ‘হিন্দুদের’ ভাষা বলেছিল কারা?

মাল্টি লিঙ্গুয়াল হওয়া কোনো লজ্জার বা সম্মানহানির বিষয় কেন হবে? এটা তো অবশ্যই একটি গুণ। আমি হিন্দি, উর্দু, ফারসি, জার্মান যত ভাষা জানব, আমার মনের জানালা ততই খুলবে। কর্মক্ষেত্রেও এর সুফল পাব।

যেমন স্রেফ ইংরেজি জানেন না বলেই বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় আসা অনেককে আমি দেখি, বাংলাদেশি মালিকানাধীন দোকানে টুটাফুটা কাজ করে কিংবা আমেরিকান প্রতিষ্ঠানেই অত্যন্ত নিচু পর্যায়ের কাজ করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। ম্যানেজার হওয়ার সব যোগ্যতা থাকার পরও কেবল ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না বলেই ক্যারিয়ারে এগোতে পারছেন না।

আবার ভালো ইংরেজি জানা লোকজনও স্প্যানিশ না জানার কারণে ক্যারিয়ারে এগোতে হিমশিম খান, যেখানে তাঁর চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে থাকা লোকজনও কেবল ভিনদেশি ওই ভাষা জানার কারণে ক্যারিয়ারে সাকসেসফুল হয়ে যায়। রিটেইল ব্যাংকিংয়ে এ উদাহরণ পাবেন হাজারে হাজার।

সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে, নিজের ভাষাকে সম্মান করার মানে কিন্তু এই নয় যে বিদেশি কোনো ভাষাকে অপমান করতে হবে। আমাদের একটি বিরাট অংশের জনতা এখানেই তালগোল, মানে গোলমাল পাকিয়ে বসেন। স্মার্টনেস মানুষের চালচলন, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা আচার–আচরণের ওপর নির্ভরশীল। একটি সম্পূর্ণ বাক্যে কয়টি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করল সেটার ওপর বিচার করা শুরু করলেই সমস্যা।

যিনি মনে করেন নিজের বাপ–দাদার ভাষায় কথা বলা খ্যাত, সেই নির্বোধের বোঝা উচিত, নিজের মাতৃভাষা না জানাটাই বরং আহাম্মকিপনা। খুব অবাক লাগে যখন দেখি, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দেশি অনুষ্ঠানে দেশি দর্শকের উপস্থিতিতে বাঙালি বক্তা ইংরেজিতে বক্তব্য দেন। বুদ্ধিশুদ্ধি কোনো আস্তাকুঁড়ে ফেলে এলে এই কাণ্ড ঘটানো সম্ভব? তারা কী প্রমাণ করতে চান?

কথাগুলো যদি কারও মনে আঘাত দিয়ে থাকে, তাহলে বলছি, এমন আচরণ আমার মতো হাজারো মানুষের মনকে শেলবিদ্ধ করে। আমরাই একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমরাই কিনা ‘শিক্ষিত’ হয়ে সেই ভাষাকে অপমান করি?

ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে ভারতীয়দের একটি গুণের কথা বলি। তার আগে বলে নিই, এটা নিশ্চয়ই সবাই জানেন, ভারতীয়দের জাতীয় ভাষা হিন্দি, কিন্তু তারপরও তারা এক রাজ্যের লোক অন্য রাজ্যের লোকের সঙ্গে যোগাযোগে ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করেন। বিশেষত শিক্ষিতরা। ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে (দক্ষিণ ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণ) পশ্চিমা দেশে যতই হাসাহাসি হোক না কেন, তাদের ইংরেজিবিদ্যা নিয়ে কিন্তু কারওই কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই মোটামুটি শিক্ষিত ভারতীয়মাত্রই ইংরেজিতে দক্ষ। তা তার উচ্চারণ পশ্চিমাদের কাছে যতই হাস্যকর শোনাক না কেন।

এখন প্রসঙ্গে আসা যাক। আমেরিকায় একটি বিশেষ ধরনের ভিসা আছে। সহজ বাংলায় যাকে কর্মী ভিসা বলা চলে। মানে এ দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে কর্মী আনার জন্য যে ভিসা দেওয়া হয়। এ ভিসায় লোকজন আসেন আমেরিকান প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে। তারপর এ ভিসাই বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে একসময়ে গ্রিন কার্ড ও নাগরিকত্ব এনে দেয়।

এখন জানা যাক, এই কর্মী ভিসা কী শর্তে দেওয়া হয়। যে কোম্পানি একজন বিদেশিকে এ ভিসা দেবে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে বিশেষ স্কিলের জন্য লোকটিকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে, স্থানীয়দের মধ্যে সেই স্কিল নেই।

সহজ উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমি একটি রেস্টুরেন্টের মালিক। আমার একটি মেনু হচ্ছে হায়দরাবাদি জাফরানি পোলাও। এ জন্য আমার একজন বাবুর্চি লাগবে। আমাকে প্রথমে বিজ্ঞাপন দিতে হবে হায়দরাবাদি জাফরানি পোলাও রেসিপি জানা এমন বাবুর্চি আমার চাই। কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে তবেই আমি হায়দরাবাদ বা বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্ত থেকে এই বিশেষ রান্নায় পারদর্শী বাবুর্চি আনতে পারব। যদি আমেরিকায় আমি বাবুর্চি পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু আনতে পারব না।

সমান শর্ত যেকোনো কাজের জন্য প্রযোজ্য। হোক সে প্রকৌশলী বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

ভারতীয়রা এ বিষয়ে যথেষ্ট স্মার্ট। তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, বিশেষ করে আইটি সেক্টরকে এমনভাবে ডিজাইন করে যে তারা পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলো বুভুক্ষুর মতো তাদের খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে আসে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আমেরিকায় কি আইটি পড়ানো হয় না? তাহলে সেই ভারত থেকে আনা হয় কেন?

উত্তর হচ্ছে, গুগল, মাইক্রোসফট বা এসব প্রতিষ্ঠান যে স্কিলের কর্মী চায়, তা আসলেই আমেরিকায় পাওয়া কঠিন। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কোর্সও করায়, যেগুলোর সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন আমাকে ড্রামা/ ড্যান্স/ আর্ট/ মিউজিক থেকে যেকোনো সাবজেক্ট ইলেকটিভ হিসেবে নিতে হয়েছিল। আমি ড্রামা নিয়েছিলাম ইন্টারেস্ট ছিল বলেই। ভারতে যত দূর জানি, এর বদলে আরও কঠিন কোনো কোডিং ক্লাস ধরিয়ে দেবে। আমার ড্রামায় বিল গেটস ভাইয়ের কী যায়–আসে? তাঁর দরকার ওই কোডিং জানা ছেলে।

তা ছাড়া আমেরিকান লোকজনের আহ্লাদীপনারও শেষ নেই। ‘আমাকে এই ওই সেই বেনিফিট দিতেই হবে। এত বেতনের নিচে দিলে কাজ করার প্রশ্নই ওঠে না।’ আর কোথাও ভালো অপরচুনিটি পেলে পায়ে ধরেও তাদের আটকে রাখা সম্ভব নয়। বর্তমান জেনারেশনে আমেরিকানরা চল্লিশ ছোঁয়ার আগেই পাঁচ–ছয়টা (আরও বেশি হতে পারে) প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মেরে আসে।

আর ভারতীয়রা আমেরিকায় কাজ পাচ্ছে এতেই আলহামদুলিল্লাহ। অর্ধেক বেতনে করে দিচ্ছে। মোটামুটি এক–দুই প্রতিষ্ঠানেই রিটায়ারমেন্টের প্ল্যান নিয়ে এগোয়।

শুনেছি, গুগল নিজেরাই নাকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য। তারা যা যা চায়, যেমন কর্মী চায়, সে রকম তৈরি করে নেবে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে ঘোষণা দিয়েছেন, এসব কর্মী ভিসা বন্ধ করে আমেরিকানদের হায়ার করতে। দক্ষ কর্মীসংকটে পড়লে এর দায়ভার ট্রাম্প কি নেবেন?

যে কারণে উদাহরণটা দিলাম, দেখুন, আমরাও কিন্তু লেবার পাঠাই। মধ্যপ্রাচ্যে। মিস্ত্রি, ঝাড়ুদার, খানসামা—এসব। আমাদের দেশ থেকে খুব কমই শিক্ষিত লেবার বাইরে কাজ নিয়ে আসেন। বেশির ভাগ পড়াশোনা করতে এসে থেকে যান। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বুঝতেই পারছেন। অথচ আমরা যদি অন্য কাজের সঙ্গে ইংরেজি শিখিয়ে শিখিয়ে লোকজন পাঠানো শুরু করতাম, তাহলে আমাদের ইকোনমি আরও বহু আগেই বদলে যেত।

যেমন আমাদের নাপিত সম্প্রদায়। হাতে হাতে যেভাবে যে ডিজাইন দেখিয়ে দিই, সেই ডিজাইনে চুল কাটেন। এমন কাস্টম বারবার সার্ভিস এখানে ১০০ ডলার দিয়েও পাওয়া কঠিন। আমাদের বাবুর্চিরা বিশ্বসেরা। এ বিষয়ে আমার কোনো তর্ক নেই। আমাদের মুচি, দরজি কিংবা আমাদের কাঠমিস্ত্রি।

কিছুদিন আগেই দেখলাম, মিরপুরে চিপা গলির ভেতরে এক ভাঙা দোকানে ফার্নিচার তৈরি হচ্ছে। কী নিখুঁত ডিজাইন লোকগুলো ফুটিয়ে তুলছেন। এই দেশে এ রকম কাস্টম ডিজাইন হ্যান্ডমেড ফার্নিচার হাজার দশেক ডলারের নিচে পেলে নিজেকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। ওই লোকগুলো যদি ইংরেজি জেনে বাইরের দেশে গিয়ে ব্যবসা বা কাজ করতেন, তাঁদের কোটিপতি হতে বেশি দিন লাগত না। স্রেফ ইংরেজি না জানার জন্য এবং ভাগ্যবিড়ম্বনায় তাঁদের জীবন রাস্তার ধারে ফুটপাতে কেটে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সেগুনকাঠের অর্ডার নিয়ে কেরোসিন কাঠ গছিয়ে দেওয়ার অভ্যাস ধরে রাখলে তাঁদের অবস্থান গলির চিপাতে থাকাই ভালো।

মোদ্দাকথা, বাংলা শিখুন, বাংলা জানুন, নিজের মাতৃভাষাকে নিয়ে গর্বিত হোন। কিন্তু অন্য কোনো ভাষাকে কটাক্ষ করলে, অসম্মান দেখালে লোকসানটা নিজেরই হবে। শিক্ষিত হয়ে কামলা হবেন কেন? কর্মকর্তা হোন।