অসম ভালোবাসা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এফ রহমান হল থেকে বের হয়ে কলাভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসা দুটি মেয়ের দিকে হঠাৎ করেই চোখ গেল।

দুজনের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হলো, মেয়েটি এই পৃথিবীর কেউ নয়, এ অবশ্যই পরিস্থান থেকে আসা কোনো পরি। একটু পর আবিষ্কার করলাম, আমি তাদের সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছি।

পরিটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল, কী সমস্যা?

: জি না, কোনো সমস্যা নাই।

: তাহলে এভাবে সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?

: সরি, আসলে আপনার কাছে একটা আবদার ছিল।

: বলে ফেলেন।

: আপনি কি একটু আকাশে উড়ে দেখাবেন?

আমার আবদার শুনে দুজনেই থতমত খেয়ে গেলেন।

: মানে কী?

: না আসলে ছোটবেলায় মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, পরিরা নাকি আকাশে উড়তে পারে। কিন্তু কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। যেহেতু আপনি একজন পরি। তাই বলছিলাম যদি একটু উড়ে দেখাতেন।

পরিটি একটু মুচকি হেসে বলল, সরি, এই মুহূর্তে উড়তে ইচ্ছে করছে না।

: কোনো সমস্যা নাই। আবার কখন উড়তে ইচ্ছে করবে সেই সময়টা বলেন। আমি তখন দেখতে চলে আসব।

: ভাই, মেয়েদের পটানোর এই পদ্ধতিটা কিন্তু অনেক পুরাতন। তবে গুড ট্রাই।

বলেই পরিটি হাসতে লাগল।

আমি আমার ডান হাত দিয়ে বুকের বাম পাশটা চেপে ধরলাম। তারপর ধীরে ধীরে বললাম, প্লিজ, এভাবে হাসবেন না। আপনার হাসি দেখে আমার বুকের বাম পাশে একটু একটু ব্যথা করছে। বলা যায় না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।

: কী ব্যাপার, আপনি কি সকাল সকাল নেশা করে বের হয়েছেন?

: নাউজুবিল্লা, আমি নেশা করি না। তবে আপনাকে দেখার পর থেকে কেমন জানি নেশা নেশা লাগছে।

: তাই। কী নাম আপনার? কোন হলে থাকেন?

: আমি ইমু। এফ রহমানে থাকি।

: কোন ইয়ারে, কোন সাবজেক্টে?

: আমি বাংলায়। এইবার ফার্স্ট ইয়ারে।

: এই ছেলে, তুমি তো তাহলে ক্যাম্পাসে একেবারে নতুন। শোনো, বড় বোনদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা বোধ হয় তুমি জানো না। সেটা তোমাকে আগে শিখতে হবে, বুঝলে। শোনো, আমি তোমার দুই ইয়ার সিনিয়র।

: সরি।

: শুধু সরি বললে হবে না, বলো সরি তমা আপা।

: সরি তমা আপা। সিনিয়রদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, আপনি কি আমাকে একটু শেখাবেন? এ বিষয়ে আমার একজন শিক্ষক দরকার।

: আচ্ছা, এখন ক্লাসে যাও। পরে যোগাযোগ করো।

: তাহলে ঠিকানাটা দেন।

: কিসের ঠিকানা?

: আপনি না বললেন পরে যোগাযোগ করতে। তা ঠিকানা ছাড়া কীভাবে যোগাযোগ করব।

: আচ্ছা, তোমার ফোন নম্বরটা দাও। আমি পরে কল করে ঠিকানা জানিয়ে দেব।

: আমি তো ফোন ব্যবহার করি না।

: মাই গড, এ যুগে কেউ ফোন ছাড়া থাকে নাকি?

: থাকে, হিমুরা সাধারণত ফোন ব্যবহার করে না।

: তুমি কি হিমু?

: জি, আমিই হিমু। হ‌ুমায়ূন স্যার আমাকে নিয়েই বইটি লিখেছেন।

: তাই নাকি? তা তোমার হলুদ পাঞ্জাবি কোথায়?

: আমি হলুদ পাঞ্জাবি ছাড়া হিমু।

: ওকে, অনেক ফাজলামি করেছ। এখন ক্লাসে যাও। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, তুমি কথা বলতে বলতে আমাদের সাথে নীলক্ষেতে চলে এসেছ।

: ভাবছি, আজ আর ক্লাসে যাব না।

: কেন?

: আসলে পরির সাথে সাথে হাঁটার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না। অবশ্য আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে।

: আমরা তো এখন শপিং করব। তুমি আমদের সাথে গিয়ে কী করবে? অবশ্য তুমি থাকলে ভালোই হয়। আমাদের শপিং ব্যাগগুলো বহন করার জন্য একজন লোক দরকার। তুমি কি পারবে?

: অবশ্যই পারব। আপনি জানেন না, আমি কিন্তু একজন পেশাদার কুলি। অবসর টাইমে আমি কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলির কাজ করি।

: হয়েছে, আর ফান করতে হবে না। তা মেয়েদের সাথে কখনো শপিংয়ে গিয়েছ? ঘুরতে ঘুরতে তোমার মাথা কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

: আপনাকে দেখে এমনিতেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আর কী খারাপ হবে।

: খবরদার, ফ্লাট করবা না। জুনিয়র জুনিয়রের মতো থাকবা, বুঝেছ।

: সরি, তমা।

: তোমাকে না বলেছি, তমা আপা বলবা।

: জি, তমা আপা।

ওই দিন সারাটা সময়ই তমা আপা আর তার বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরলাম। কখন যে তমা আপা তুমি থেকে তুইয়ে নেমে এলেন বুঝতেই পারিনি। বিদায়বেলায় তমা আপা ঠিকানা দিলেন। উনি রোকেয়া হলে থাকেন। রুম নম্বর ৫০৩। অর্থনীতিতে পড়েন।

ওই দিনের পর থেকে গত তিন মাস একটি দিনও এমন হয়নি যেদিন আমাদের দেখা হয়নি। ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া সকাল থেকে হলে ঢোকার আগ পর্যন্ত সারা দিন আমরা একসঙ্গেই থাকি। কিন্তু এই তিন মাসে একবারও বলিনি, তমা আপা, আমি আপনাকে ভালোবাসি। তবে এই স্বল্প সময়ে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, তমা আপাকে ছাড়া আমার চলবে না।

অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা হওয়ার হবে, এবার ভ্যালেন্টাইনস ডেতে তমা আপাকে সরাসরি আমার ভালোবাসার কথা বলব।

দুদিন আগে রিকশায় ঘোরার সময় তমা আপাকে বললাম, তমা আপা, এবার ভ্যালেন্টাইনস ডেতে আপনার পরিকল্পনা কী?

: নারে, তেমন কোনো পরিকল্পনা নাই। কেন বল তো?

: যদি অনুমতি দেন, তো এবার ভ্যালেন্টাইনস ডেটা আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।

: মানে কী! তুই তো প্রতিদিনই আমার সাথেই থাকিস।

: তা থাকি। কিন্তু সাথে তো আপনার বান্ধবীরাও থাকে। আমি চাই ওই দিন আমাদের সাথে আর কেউ থাকবে না।

: আচ্ছা, যা দিলাম। ওই দিনটা তোর।

: আর শোনেন, ওই দিন আপনাকে আমার জীবনের একটা সিরিয়াস কথা বলব।

: তুই বলবি সিরিয়াস কথা! তুই!

: আপনি অবাক হচ্ছেন কেন? আমি কি সিরিয়াস কথা বলতে পারি না? আপনার কি ধারণা, আমি সিরিয়াস পারসন না?

: আমার তো ধারণা সেই রকমই।

: আফসোস, আপনি আমাকে আজও চিনলেন না।

: থাক, আর ঢং করিস না। যা, আমি তোর সিরিয়াস কথা মন দিয়ে শুনব।

তারপর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস ডে। পুরোটা টিএসসি এলাকা যেন মানুষের সমুদ্র। তমা আপা আজ শাড়ি পরেছেন। কোনো মেকআপ নেননি, শুধু হালকা করে একটু লিপস্টিক নিয়েছেন। তবু তাকে পরির মতোই লাগছে। টিএসসির ভেতর ঢুকে দেখলাম, তমা আপা ঘাসের ওপর বসে আছেন। ওনার মুখ ভার। বুঝলাম দেরি করে আসায় উনি আমার ওপর রেগে আছেন।

ওনার সামনে গিয়ে লম্বা করে একটা সালাম দিলাম, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। তা আপা কেমন আছেন?

: খবরদার ফালতু, তুই আমার সাথে কথা বলবি না।

: আপা, আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন। আমার নাম ইমু, ফালতু না।

: অবশ্যই ফালতু। ফালতু না হলে কেউ কি ভ্যালেন্টাইনস ডের মতো এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে দেরি করে আসে?

: সরি তমা আপা। আসলে এটা আমার জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভ্যালেন্টাইনস ডে। বিশ্বাস করেন, এই আনন্দে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু ভোররাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারব না। পরের বছর আর এই ভুল হবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরের বছর আগের রাতেই কম্বল আর বালিশ নিয়ে টিএসসিতে এসে শুয়ে থাকব।

: ফাজলামি করবি না। আমি সেই সকালে এসে তোর জন্য বসে আছি। আর একটা কথা, তুই খালি হাতে আসছিস কেন?

: কেন, হাতে কী থাকার কথা? দা, বঁটি বা লাঠিজাতীয় কিছু?

: আশপাশে তাকিয়ে দেখ, সবাই গিফট নিয়ে এসেছে। আর তুই এসেছিস খালি হাতে। গিফট না আনিস অন্তত চকলেট তো আনতে পারতি।

: আপা শোনেন, আমার জানামতে সাধারণত বড়রা ছোটদের চকলেট দেয়। আর আপনি আমার থেকে দুই বছরের বড়। তাই আমি ভাবলাম, আপনিই হয়তো আমাকে চকলেট দেবেন।

: তুই কিন্তু কৌশলে আমাকে বড় বলে খোঁচা দিলি। আচ্ছা, তুই তো জানিস আমি তোর থেকে বড়। তাহলে আমার পিছে পিছে ঘুরিস কেন?

: না ঘুরে কি উপায় আছে? আপনাকে পরি হতে কে বলেছে? আপনি পরি না হলে তো আপনার পেছন পেছন ঘুরতাম না।

তমা আপা আর রাগ করে থাকতে পারলেন না। মিষ্টি করে হাসলেন। তমা আপা যখনই হাসেন, তখনই আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে। বুঝি না এই মেয়েটা এত মিষ্টি করে হাসে কীভাবে?

: ঠিক আছে, চকলেট না আনার কারণ বুঝলাম। কিন্তু একটা ফুলও তো আনতে পারতি। আমি খোঁপায় গুঁজে রাখতাম।

: খোঁপা কোথায়? আপনার তো বব কাট চুল।

: অ্যাটলিস্ট কানে গুঁজে রাখতাম।

: তা পারতেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফুলে অনেক সময় পোকামাকড় থাকে। ধরেন, একটা পোকা আপনার কানের ভেতর...।

বাক্যটা শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই তমা আপা ধমক দিয়ে উঠলেন।

: শোন, ফুল-চকলেট আনিসনি ঠিক আছে। কিন্তু উল্টা-পাল্টা যুক্তি দিবি না।

: ঠিক আছে দেব না।

: তুই না বলেছিলি, আজ একটা সিরিয়াস কথা বলবি। নে, শুরু কর।

: এখনই বলতে হবে? একটু পরে বলি?

: না এখনই বল। আগে তোর কথা শুনি, তারপর সিদ্ধান্ত নেব তোর সাথে আজ সারা দিন থাকব কি না।

আমি তমা আপার একটি হাত আমার দুই হাতে তুলে নিলাম। নরম করে ধরলাম। তারপর ওনার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকালাম।

: মাই গড, তুই কি এখন বাংলা নাটকের নায়কদের মতো ঢং করবি? প্লিজ, আর যা–ই করিস ঢং করিস না। যা বলার সরাসরি বল।

: তমা আপা, আমি আপনাকে ভালোবাসি।

: এটা তোর গুরুত্বপূর্ণ কথা! আরে বোকা, আমিও তো তোকে ভালোবাসি।

: তমা আপা, আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন, এটা সে ভালোবাসা না। এটা অন্য রকম ভালোবাসা।

: তুই কি ফাজলামি করস আমার সাথে।

: তমা আপা আমি সিরিয়াস। আমি আসলেই আপনাকে ভালোবাসি।

: শোন, তুই যেটাকে ভালোবাসা বলছিস, সেটা আসলে ভালোবাসা না। এটা তোর মোহ?

: না, এটা মোহ না। এটা আমার প্রকৃত ভালোবাসা।

: তাই!

: আপনি বিশ্বাস করছেন না, না? ঠিক আছে বলেন কী করলে আপনি বিশ্বাস করবেন। আপনি যা বলবেন আমি তা–ই করব। আপনি যদি চান, তবে আমি এখন এই হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে আপনার জন্য দৌড় দিতে পারব। দেব?

: তোর ইচ্ছে হলে তুই দে।

: আমি কিন্তু সিরিয়াস। এক কাজ করি, আপনার তো খিদে পেয়েছে তাই না? আপনি বসেন, আমি বরং শুধু আন্ডারওয়্যার পরে এক দৌড় দিয়ে নীলক্ষেত থেকে তেহারি নিয়ে আসি। তারপর দুজনে মিলে আরাম করে তেহারি খাব।

বলেই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর প্যান্ট খোলার জন্য প্যান্টের বেল্টে হাত দিলাম। তমা আপা দ্রুত আমার হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে দিলেন।

: ছি, এটা তুই কী করছিস? তুই এখন সবার সামনে প্যান্ট খুলবি? মাই গড, তোর মাথায় তো আসলেই সমস্যা আছে। মানুষ ভালোবাসার জন্য কত কী না করে। আর এই ব্যাটা নাকি জাঙ্গিয়া পরে দৌড় দেবে।

: সমস্যা কী? এটা তো খুবই অস্থির একটা ঘটনা হবে। শোনেন, জাতি হয়তো এর জন্য ইতিহাসে আমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে। শাহজাহান, মজনু, ফরহাদের পাশে লেখা থাকবে জাঙ্গিয়া বাবা।

: জাঙ্গিয়া বাবা না? থাবড়ায়া তোর পাগলামি ছুটায় দেব। ফাজিল পোলা, তুই এখন দিগম্বর হয়ে ইতিহাস রচনা করবি, না?

: আচ্ছা, তমা আপা, আপনি সব সময় আমাকে ঝাড়ি মারেন কেন? আপনি যেভাবে আমাকে সব সময় ঝাড়ি মারেন, তাতে তো আমার ভয় হয়। আমার কেন জানি মনে হয়, বিয়ের পর আপনি আমারে মাইরের ওপর রাখবেন।

: এই, তোরে বিয়ে করবে কে? আমি? শোন, আমার মাথা এখনো এতটা খারাপ হয়নি, যে তোর মতো পিচ্চি পোলারে বিয়ে করব।

: আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না? আসলে কি জানেন, আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না।

অভিমানের সুরে কথাটি বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম।

: মাই গড, আমার বাবুটা রাগ করেছে। আরে বোকা, আমি তোকে ভালোবাসি কিন্তু প্রেম বিয়ে সেটা কী করে সম্ভব? তুই আমার থেকে অনেক ছোট। তোর সাথে আমি কীভাবে রোমান্স করব? এটা তো জমবে না।

: অবশ্যই জমবে। তমা আপা, শোনেন, আমি কিন্তু ফাটাফাটি রকমের রোমান্টিক।

: তাই নাকি?

: বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, আমি কতটা রোমান্টিক, তা এখনই আপনাকে দেখাচ্ছি।

বলেই আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর তমা আপাকে বললাম উঠে দাঁড়াতে।

: কেন, আমি উঠে দাঁড়াব কেন?

: কারণ, এখন বাংলা সিনেমার একটা রোমান্টিক গান গাইতে গাইতে আমরা দুজনে মিলে একটা নাচ দেব। আমি গানও এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আসেন এই গানটা দুজনে মিলে গাই।

: এই ছাগল, আমার সোনার বাংলা রোমান্টিক গান!

: রোমান্টিক না? কিন্তু এখানে তো ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। আচ্ছা বাদ দেন, গান চেঞ্জ। দাঁড়ান আরেকটা গান মনে পড়েছে।

বলেই গাইতে লাগলাম, ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার, শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে তিনি আমায় করবেন পার, আমি পাপী তিনি জামিনদার...।’

: ওই, তুই থামবি। মাই গড, তুই তো রোমান্টিক গান কাকে বলে, সেটাই জানিস না। আর তুই আসছিস প্রেম করতে?

: তাহলে আপনিই একটা গানের কথা বলেন। তারপর আসেন সেই গান গেয়ে আমরা নাচ দিই।

: শোন, আমার মাথা এখনো এত খারাপ হয়নি যে তোর সাথে বাংলা সিনেমার গান গেয়ে নাচতে হবে।

বলেই তমা আপা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তমা আপার হাসি দেখেই বুকের ভেতরটা আবারও কেমন জানি করে উঠল। আমি অবাক হয়ে তমা আপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক সে মুহূর্তে তমা আপার ফোন বেজে উঠল। উনি মুখে আঙুল রেখে ইশারা করলেন কথা না বলতে। তারপর ফোন রিসিভ করলেন। প্রায় মিনিট দুই কথা বললেন।

কথা শেষ করেই বললেন, শোন, আমাকে এখন উঠতে হবে। বাবা এসেছেন। উনি হলের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

: আচ্ছা, এই ভদ্রলোক আর আসার সময় পাইল না। আজ এমন একটা দিনে কেউ আসে?

: খবরদার, আমার বাবাকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবি না। আমি এখন যাচ্ছি।

: তাহলে আমি এখন কী করব?

: তুই আপাতত এখানে বসে থাক। আগে দেখি বাবা কেন এসেছে। আমি ওনাকে বিদায় দিয়েই চলে আসব।

: কিন্তু উনি যদি না যান বা আপনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন, তাহলে? তাহলে আমি কীভাবে জানব? আমার কাছে তো ফোন নাই।

: দাঁড়া, এর সমাধান আমার কাছে আছে। এই প্যাকেটটা ধর। এটা তোর জন্য আমার ভ্যালেন্টাইন গিফট।

বলেই তমা আপা তার ব্যাগ থেকে একটি প্যাকেট বের করে দিলেন। প্যাকেট খুলে দেখলাম, ভেতরে নতুন চকচকে একটা ফোন।

: শোন, ভেতরে সিম কার্ড ঢোকানো আছে। আজ থেকে তোর হিমুগিরি শেষ। এখন থেকে সব সময় আমি তোর খোঁজ নিতে পারব। শোন, বাবা যদি আমাকে নিয়ে কোথাও যায়, তবে আমি তোকে মেসেজ দিয়ে জানাব। খবরদার বাবা থাকা অবস্থায় ফোন দিবি না। আমি গেলাম।

কথাগুলো বলে তমা আপা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমাকে পেছনে রেখে টিএসসির গেটের দিকে রওনা দিলেন। কয়েক কদম গিয়ে কী মনে করে উনি ফিরে এলেন।

: এক কাজ কর তো, তুই চোখ বন্ধ কর।

: চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?

: কারণ, এখন আমি তোকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেব। চোখ বন্ধ না করলে তুই সেই গিফট পাবি না।

: ঠিক আছে, বন্ধ করছি।

: ও আরেকটা কথা, গিফট পাওয়ার সাথে সাথেই চোখ খুলবি না। মনে মনে এক থেকে এক শ পর্যন্ত গুনবি। তারপর চোখ খুলবি। ঠিক আছে?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তমা আপা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমি চোখ বন্ধ করলাম। অনুভব করলাম উনি ওনার কোমল হাত দিয়ে আমার কপাল থেকে চুলগুলো সরালেন। তারপর আমার কপালে ওনার গোলাপি ঠোঁট ছোঁয়ালেন।

তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, আই লাভ ইউ জাঙ্গিয়া বাবা।

মেয়েদের আদর এত কিউট হয়, আমার জানা ছিল না। ওনার কোমল ছোঁয়ায় আমার সারা শরীরে একটা কম্পন শুরু হলো। আমি বসা থেকেই চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘাসের ওপর চার হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর মনে মনে গুনতে লাগলাম ১, ২, ৩,...৯৯, ১০০। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। দেখলাম আশপাশে কোথাও তমা আপা নেই। আমি সুখের আবেশে আবার ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলাম।

তমা আপা চলে যাওয়ার ত্রিশ মিনিট পর একটা টেক্সট মেসেজ পেলাম—‘শোন, মা অসুস্থ। সে কারণেই বাবা আমাকে নিতে এসেছেন। আমি এখন বাবার সাথে গ্রামে চলে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দিস না। সময় পেলে আমিই কল দেব। ভালো থাকিস।’

তমা আপা আমাকে একা করে চলে গেলেন।

সেই দিন রাত এগারোটা পনেরো মিনিটে তমা আপার দ্বিতীয় মেসেজ পেলাম, ‘জানিস, আজ বাবা আমাকে মিথ্যে বলে বাড়ি নিয়ে এসেছেন। মায়ের আসলে কিছুই হয়নি। উনি সুস্থ আছেন। বাসায় সবার সাথে আমার একটা যুদ্ধ চলছে। তাই তোর সাথে এখন কথা বলতে পারছি না। পরে তোকে সব জানাব।’

সারা রাত তমা আপার পরবর্তী মেসেজের অপেক্ষায় জেগে ছিলাম। কিন্তু রাতে আর কোনো মেসেজ আসেনি।

১৫ ফেব্রুয়ারি, সকালে হলের সামনের ফুটপাতে একাকী বসে আসি। খুবই অস্থির লাগছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। কেন জানি মনে হলো, টিএসসিতে গেলে ভালো লাগবে। ধীরে ধীরে টিএসসির দিকে হাঁটা দিলাম। টিএসসিতে এসে গতকাল তমা আপা আর আমি যেখানে বসে ছিলাম, সেখানে গিয়ে বসলাম।

ঠিক সকাল দশটা চল্লিশ মিনিটে তমা আপার আর একটা মেসেজ পেলাম, ‘তুই সব সময় আমার সাথে সাথে থাকিস, বিষয়টা কীভাবে জানি বাসায় জেনে গেছে। তাদের ধারণা, আমরা প্রেম করছি। সে কারণে কৌশলে বাবা আমাকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। কাল সারা রাত বাসায় তোকে নিয়ে সবার সাথে যুদ্ধ করেছি। সবাই জানতে চাইল আমাদের কী সম্পর্ক। আমি সবার সামনেই বললাম, আমি তোকে ভালোবাসি। তারপর যখন বললাম, তুই এখনো স্টুডেন্ট, তখন দেখলাম বাসার সবাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। শুধু মাকে আমার পাশে পেলাম। কিন্তু যখন বললাম তুই আমার জুনিয়র, তখন দেখলাম, মাও আর আমার সাথে নেই। আমি এখন বাসায় এক প্রকার বন্দী।

তোকে কত বললাম, জুনিয়র জুনিয়রের মতো থাক। প্রেম করার দরকার নেই। তুই তো আমার কথা শুনলি না। ঠিকই আমাকে দুর্বল করে দিলি। তোকে ভালোবাসতে বাধ্য করলি। তোকে ঢাকায় রেখে চলে আসার পর অনুভব করলাম, তুই ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। জানিস, কাল রাত থেকে আমি শুধুই কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিস? কারণ, আজ তোর পরির বিয়ে। আজ তোর তমা আপাকে অন্য একটা মানুষ নিয়ে যাবে। আমি অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু বাবা-মা কিছুতেই আমার কথা শুনছে না। ওরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। বলতে পারিস, আমি এখন কী করব?’

মেসেজটি পড়ে পাথর হয়ে বসে রইলাম। অনুভব করলাম, চোখ থেকে গরম একটা পানির ধারা নেমে আসছে। কী করব বুঝতে পারছি না। মনে হলো পুরো টিএসসিটা ধীরে ধীরে আমার চারদিকে ঘুরছে। আর বসে থাকতে পারলাম না। ঘাসের ওপর চার হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর অশ্রুভরা ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকালাম। দেখলাম, নীল আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একটি পরি পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি—পরি, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ বলার জন্য মুখ খুললাম। চিৎকার করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। হঠাৎ করেই দেখলাম চারদিকটা কেমন জানি ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।

বি. দ্রষ্টব্য: ভালোবাসা এক মায়ার চাদর। আপনি চান বা না চান, এ চাদর আপনাকে জড়িয়ে ধরবেই। কখন? কীভাবে? তা আপনি বুঝতেও পারবেন না।

বি. দ্রষ্টব্যের বি. দ্রষ্টব্য: সব সময় যে সমবয়সী বা বয়সে ছোট মেয়ের প্রেমে পড়তে হবে, এর তো কোনো মানে নেই, তাই না? ভালোবাসা তো এমনই। ভালোবাসা কি আর সব সময় নিয়ম মেনে হয়? হয় না।