একুশে প্রবাসে

বাংলাদেশি আমেরিকান সোসাইটি অব গ্রেটার হিউস্টনের সদস্যরা এই স্থায়ী শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছেন তাঁদের নিজেদের জমিতে। পরবর্তী বছর থেকে তাঁরা এখানেই একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করবেন
বাংলাদেশি আমেরিকান সোসাইটি অব গ্রেটার হিউস্টনের সদস্যরা এই স্থায়ী শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছেন তাঁদের নিজেদের জমিতে। পরবর্তী বছর থেকে তাঁরা এখানেই একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করবেন

পাশের ঘরে মেয়েরা একুশের প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রস্তুতি বলতে গানের টানে, নাচের নূপুরে, নাটকের সংলাপে আর বাঁশরীর বাহারি সুরে একটি অজর, অমর দিনকে বছরান্তে মনে করা।

আর এদিকে পাভেল ভাই তাঁর স্প্যানিশ কনট্রাক্টরকে তুলাধোনা করছেন—‘solo quedan dos días’ (আর মাত্র দুই দিন বাকি), ‘cuando vas a preparar el scenario’ (স্টেজের কাজ কবে শেষ হবে?)।

একপাশে রিয়াজ ভাইয়ের কপালে কয়েক প্রস্থ ভাঁজ—আবহাওয়া খুব একটা সুবিধার হবে বলে মনে হচ্ছে না। বৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক। কিরণ ভাই বারবার তাগাদা দিচ্ছেন শেখ আরিফকে। এখন শুরু না করলে সময়মতো শহীদ মিনারটা বসানো যাবে না।

সব মিলিয়ে শব্দ আর শিঞ্জনে, উৎসাহ আর আশঙ্কায় বেশ জোরেশোরেই চলছে সব প্রস্তুতি। মাত্রতো আর কয়েকটা দিন বাকি। সোসাইটির নিজের জমিতে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হবে প্রথমবারের মতো। প্রভাতফেরি, শহীদ মিনার, শিশিরে ভেজানো সকালের ঘাস, নরম মৃদু রোদ—একখণ্ড বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার কী আপ্রাণ চেষ্টা।

ঠিক তখনই হঠাৎ ওপাশ থেকে কানে এল সেই গানটা। আমাদের কথা থেমে যায়। কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এক নির্মম মন খারাপ করে দেওয়া অনুভূতি এসে ভর করে সবার ওপর। বাচ্চারা এখানে ফেব্রুয়ারি আমাদের মতো করে বলতে পারে না। বলে ওদের মতো করে, ‘ফ্যাব্রুয়ারি’, কিন্তু তাতে কী? সুরটা তো ঠিক আছে আর সুরের সারাংশটা।

অবশ্য ওরা জানবে কেমন করে, কোন মহান দুঃখে মহিমান্বিত এই মাস এখন কেবল আমাদের, ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন “আরশ” ছেদিয়া’-এই মাস এখন রফিকের, সালামের, জব্বারের আর সব মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের, ওরা জানবে কেমন করে কোন সুরে বাজে বাংলার বেহাগ এই মাসে, শিশিরে পা ভেজানো প্রভাতফেরির গানে ফেব্রুয়ারি এখন শুধুই বাংলার, বাঙালির, এর সব কৃষকের, সব শ্রমিকের, সব বারোয়ারি মানুষের।

আমাদের এখনো এই গান শুনলে বুকের কোথাও একটা হাহাকার করে ওঠে, প্রাণের গহিনে কোথাও একটা বেদনার বলিরেখা জেগে ওঠে … ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।

প্রভাতফেরি
প্রভাতফেরি

আমি কি ভুলিতে পারি? ঘর কোন সুদূরে। বাড়ি ছিল করতোয়ার পারে। একুশের প্রথম প্রহরে আধো শীতে খালি পায়ে রেললাইন পার হয়ে যেতে হতো শহীদ মিনারে। সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি আর একটা হালকা চাদর গায়ে। পুরো শহরে ওই একখানাই শহীদ মিনার। লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকত। যাওয়া হতো কারও না কারও সঙ্গে। সেই কেউ বা কারোর সাথ ধরে রাখতেই হিমশিম খেতে হতো। গাঁদা ফুলের গন্ধে আর চাপা রঙে ভরে থাকত পুরো শহর প্রায়। দিনভর শিশু একাডেমি আর জিলা স্কুলে চলত কবিতা আবৃত্তি আর গান। আহা, আমি কি ভুলিতে পারি?

ভাষার সঙ্গে এই নিগূঢ় সম্পর্ক বোধ করি পৃথিবীর আর কোনো জাতির, কোনো দেশের নেই। অবশ্য থাকার কথাও তো না। ভাষা তো জন্মের অধিকার। কে কবে কোথায় শুনেছে, সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়। কে শুনেছে শব্দের সঙ্গে এই প্রগাঢ় সংলাপ থেকে কোনো মানুষকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায়। কে কোথায় শুনেছে নিজের ভাষায় কথা বলতে ভাই, সন্তান অথবা পিতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কে কোথায় শুনেছে ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম একদিন স্বাধিকারের যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা আর স্বকীয়তার সিংহভাগ প্রেরণা কি আসেনি এই একটি দিনের ঘটনাবলি থেকে। কে কোথায় শুনেছে?

এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল শুক্রবার। সেদিন এখানে স্কুল, অফিস আদালত সব খোলা। তাই সবাই ব্যস্ত থাকবেন তাঁদের কাজ নিয়ে। এ কারণেই এখানে একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় শনিবার অর্থাৎ ২২ তারিখে, যাতে সবাই আসতে পারেন। কোনো ছুটিছাটা নেওয়া বা বাচ্চাদের স্কুলে অনুপস্থিত থাকার দরকার পড়ে না।

শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের মুহূর্তে
শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের মুহূর্তে

যা হোক, সব শঙ্কার পরও রাত দিন পরিশ্রম করে পাভেল ভাই, আরিফ ভাই, রিয়াজ ভাই, মামুন ভাই আর সোসাইটির সবাই মিলে মাঠ পরিষ্কার করে ফেললেন। শহীদ মিনার যথাস্থানে বসিয়ে ফেললেন। আমাদের স্প্যানিশ কন্ট্রাক্টর অনেক বকাঝকা খেয়ে সময়মতো স্টেজটাও বানিয়ে ফেললেন। তারপর যা হলো, তার জন্য আমি, আপনি আমরা সবাই একধারে আনন্দিত এবং গর্বিত হতে পারি।

একটা উজ্জ্বল ঝলমলে দিনে, একটা মৃদু মিষ্টি বাতাসে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ল দিনভর। এক ঝাঁক নারী আর পুরুষ মাথা উঁচু করে তাদের বাঙালিয়ানা জাহির করলেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সাদা আর কালোতে একটি আলোকিত দিন আমাদের শোকে হয়ে উঠল নীলকণ্ঠ। গানে, নাচে, কবিতায় আমরা আমাদের মহান সন্তানদের আত্মদান আর আত্মত্যাগকে স্মরণ করলাম সেই একই ভাবে, যেভাবে করতাম অনেক বছর আগে আমাদের সবার প্রিয় শৈশবে।

দিনের শুরু হয় প্রভাতফেরি দিয়ে। অবশ্য প্রভাতফেরির আগে বাংলাদেশ আমেরিকান সোসাইটির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে আসা সবাইকে আপ্যায়ন করা হয় সকালের নাশতা আর চা দিয়ে। দিনটা শুরু হয়েছিল কিছুটা মেঘ আর ঘোলাটে আকাশ দিয়ে। কিন্তু বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সূর্য। চারদিকে ভরে যায় ঝলমলে নরম ফাগুনের আলোতে। সবাই হেঁটে কিছুটা দূরত্ব ঘুরে আসেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে। তারপর একে একে ফুল দেন শহীদ মিনারে। এক অদ্ভুত অপূর্ব দৃশ্য।

দুই কিশোর যারা প্রভাতফেরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে
দুই কিশোর যারা প্রভাতফেরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে

বাংলাদেশ-আমেরিকান সোসাইটির পক্ষ থেকে সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ (পাভেল) একুশের মহান শহীদের শ্রদ্ধা জানান তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায়, একই সঙ্গে সবাইকে তিনি ধন্যবাদ জানান এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য। ফোর্ড বেন্ড কাউন্টির কাউন্টি জাজ কে পি জর্জ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ফোর্ড বেন্ড কাউন্টির জন্য ‘বাংলাদেশ-আমেরিকান’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

তিনি তাঁর বক্তৃতায় ফোর্ড বেন্ড কাউন্টিতে বাস করা সব বাংলাদেশি-আমেরিকান অভিবাসীকে ধন্যবাদ জানান তাঁকে সমর্থন দেওয়ার জন্য এবং অঙ্গীকার করেন যে তিনি ও তাঁর অফিস সব সময় বাংলাদেশি আমেরিকানদের পাশেই থাকবেন।

এখানে এখন বিভিন্ন লোকাল গভর্নমেন্টের ভোট আসন্ন। তাই অনেক স্থানীয় প্রার্থীও এসেছিলেন বাংলাদেশি-আমেরিকানদের কাছে ভোট চাইতে।

সমবেত সংগীত পরিবেশনা
সমবেত সংগীত পরিবেশনা

মূল অনুষ্ঠানে আমাদের শিল্পীরা নাচ, গান আর কবিতায় একুশ এবং একুশের সব মহান শহীদকে স্মরণ করেন যথাযোগ্য মর্যাদা আর মাহাত্ম্যের সঙ্গে। অনুষ্ঠান শেষ হয় স্থানীয় ব্যান্ড গোষ্ঠী ‘কারমিক অ্যানথেম’-এর একটা মনোজ্ঞ পরিবেশনা দিয়ে।

সোসাইটির সদস্যরা অনুষ্ঠানে আসা সবাইকে দুপুরের খাবারেও আপ্যায়ন করেন।

সুর আর সংগীতে, শিশু-কিশোরদের দৌড়াদৌড়ি আর চেঁচামেচিতে, কিশোরী আর নারীদের মনোরম সাজ আর সজ্জায়, সব প্রত্যয় আর প্রতিজ্ঞায়—এ রকম করেই একটা সাধারণ দিন হয়ে উঠেছিল কী অসাধারণ একটা দিনে। দেশ থেকে এত দূরে, বায়ান্ন থেকে এত দিন পরও আমরা সবাই অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমরা সবাই মনেপ্রাণে এখনো কী সাংঘাতিক রকম মাছে-ভাতে বাঙালি, আমাদের সবার ভেতরেই কী অপ্রতিরোধ্য আনন্দে বাস করে বাংলার ছবি।

নাচের পরে শিল্পীরা
নাচের পরে শিল্পীরা

এ রকম একটা দিনে আমরা আশাবাদী হতে শিখি। আমরা যারা দেশ ছেড়ে এসেছি এই নতুন দেশে, আমাদের কাছে দেশ শুধু দেশই নয়, এটিই আমাদের পরিচয়, এটিই আমাদের গর্বের জায়গা, আনন্দের আঁধার, স্বপ্নের সারমর্ম। কিন্তু আমরা আমাদের এই পরিচয়টাকে কি প্রজন্মান্তরে এগিয়ে নিতে পারছি? বাংলাদেশের পতাকা এই সজ্জা আর স্বচ্ছন্দে কি উড়বে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আকাশে? স্বপ্নের সঙ্গে কিঞ্চিৎ সাধনা মিশিয়ে আমরা সহজেই এই প্রশ্নের একটা সময়োপযোগী ও একটা আনন্দদায়ক উত্তর খুঁজে পেতে পারি।


মোহাম্মাদ সাকলায়েন: কেটি, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>