ভ্রমণ: অরূণরাঙা প্রভাতের টানে

রাত শেষে ভোরের সূর্যের দেখা জীবনে সুন্দরতম স্মৃতি। ছবি: লেখক
রাত শেষে ভোরের সূর্যের দেখা জীবনে সুন্দরতম স্মৃতি। ছবি: লেখক

একটা জীবনে কিছু স্বপ্ন থাকতে হবে, যার কিছু পূর্ণ হবে, কিছু হবে না। পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলোর মধ্যে কয়েকটা নির্দিষ্ট বিরতিতে খোঁচাতে থাকবে, যাতে তাদের সত্য করা হয়। আর কিছু স্বপ্ন ধরেই নেয়, তারা কখনো দৃশ্যমান হওয়ার নয়।

মেজ মেয়েটা পেটের মধ্যে গুটুর গুটুর করত তখন। বেশির ভাগ নির্ঘুম রাত কখন যে ভোর হয়ে যেত। তেমন একটা নির্ঘুম ভোরে আমি কেমন যেন ভেসে বেড়াতে শুরু করলাম—কখনো মেঘের ভেতর দিয়ে, কখনো পাহাড়ে পাহাড়ে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি। আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এটা কি স্বপ্নদৃশ্য, নাকি বাস্তব!

ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রিয় গৃহকোণে খুঁজে পেলাম বটে, কিন্তু সেই স্মৃতি আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। এ ঘটনার দুই বছরের মধ্যে আমার বর আর আমার বন্ধু মঞ্জুরের সহযোগিতায় সেই স্বপ্নটাকে সত্য করার সুযোগ পেয়ে যাই। নীলগিরি হিল রিসোর্টে কাটানো একটা রাত, বিশেষ করে ভোরটা জীবনে সুন্দরতম আরেকটা স্মৃতি।

‘তেহ কো রিসা’ নামক একটা কটেজ বরাদ্দ ছিল আমাদের নামে। বান্দরবান থেকে একটা মাইক্রোবাসে চড়ে নীলগিরি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ১২টা বেজে গেল। অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির সুধারসে মত্ত ছিলাম আমরা সবাই আর গাড়িতে একের পর একজন ডেনভার মিউজিক। দুপুরে পাহাড়ে রোদ আর মেঘের লুকোচুরিতে বাতাসে বাতাসে পাহাড়িকন্যার প্রেমের গল্প বোনা হচ্ছিল।

দুপুরে খাবারের পর বিশ্রাম নিতে চাইছিল শরীর, আর মন চাইছিল আমি দুচোখে যতটা পারি সুন্দরকে ধারণ করি। সেই বসন্তের বাউরি বাতাসে নির্জন খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দুপুরটায় আমার সঙ্গী ছিল একটা নিঃসঙ্গ তক্ষক। একটানা তক-খক, তক-খক ডাকে দুপুরটা কী আশ্চর্য একাকিত্বে ভরে উঠেছিল। সেই একাকী দুপুর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত বিষাদময় বিজন সন্ধ্যায় পরিণত হয়েছিল।

কেন যেন মনে হচ্ছিল এই পাহাড়ে কোথাও কোথাও আমি ঘুরে বেড়াতাম বহু বহু আগে, প্রাচীনকালে। তাই এই নির্জন একাকিত্ব আমার বহু পুরোনো সঙ্গী। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার খুব মন খারাপ হচ্ছিল। মঞ্জুর ও রিপন বহু ধরনের আলাপনে ব্যস্ত, বন্ধুপত্নী রিতু কন্যা অহনাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমার জাদুর কন্যা দুটাও ঘুমাচ্ছিল। আর আমার মনে হচ্ছিল কেন অকারণে এই বিজন পাহাড়ে রাত্রি কাটানো, কেন কেন?

ভোরের সূর্যোদয়। ছবি: লেখক
ভোরের সূর্যোদয়। ছবি: লেখক

কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না, আমার দমবন্ধ-দমবন্ধ লাগছিল। ঘরে মিটিমিটি আলো সোলার প্যানেলের। ঘুমাতে ইচ্ছা হচ্ছিল না মোটেও। মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে গেলেই আমি হারিয়ে ফেলব একটা রোমাঞ্চকর সকাল। অনেকক্ষণ নিজেকে জাগিয়ে রাখতে রাখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

তোমরা কী ভাবছ বলো তো, আমি কি সূর্যোদয়টা হারিয়ে ফেলেছি? এত দূর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার পর এমন দুর্লভ দৃশ্য আমি দেখতে পাব না—এমন কঠিন আমার সৃষ্টিকর্তা কখনোই নন। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমার ঘুম শেষ। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিতেই বুক হিম করা সেই দৃশ্য এবং আমি দমবন্ধ করে গোগ্রাসে তা গিলতে লাগলাম।

আমাদের কটেজের বারান্দাটায় মেঘগুলো গা-হাত-পা মেলে ঘুমাচ্ছিল যেন। শুধু কি তা–ই, পুরো বিশ্বচরাচর মেঘের নিচে। একবুক মেঘসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমি কোলে-কাঁখে আমার সোনামণি দুটোকে নিয়ে পুরো রিসোর্টটা ঘুরে ফেললাম। আর বাচ্চাদের বাবা শুধু ফটাফট সাটার টিপছে। পৃথিবীর বাইরের এই দৃশ্যের জন্য এই যে আদেখলাপনা এটা যেন আমার সত্তায় মিশে আছে।

ওই দিনের পরে বহুবার প্ল্যান করেছি আমি আর আমার বর এ রকম আরেকটা মেঘ থমথমে পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখব। মাঝে আমরা চারজন থেকে পাঁচজন হয়ে গেলাম। সাগরের বুকে সূর্যোদয় দেখলাম, পাহাড়েও দেখলাম। কিন্তু সেই মেঘ থমথম পাহাড় কেমন ভুরুজোড়া নাচিয়ে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে ইশারা করে। সারাক্ষণ মনের মধ্যে বিজন পাহাড়ের সংগীত বাজে, কাকে বোঝাব সে কথা?

এবার সে সুযোগ পেয়ে গেলাম ওমানের সালালাহ ফটোগ্রাফি ক্লাবের সৌজন্যে। আমি এবং আমার বর দুজনেই সেখানকার সক্রিয় সদস্য। আমাদের এবারের ফটো ওয়াক ছিল সালালাহর শীর্ষ পয়েন্টে অর্থাৎ জাবাল সামহান থেকে সূর্যোদয়ের ফটোশুট। কে অবহেলায় এই সুযোগ হারাবে, অন্তত আমরা তো নই।

আগের রাতে বিছানায় যাওয়ার সুযোগ মিলেছিল রাত দুইটায়। কিন্তু মনের ভেতরে টিকটিক করে যাওয়া ঘড়িটা চোখ দুটো বন্ধ করতে দিল না। চারটার ভেতর দুজনে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অন্যদের সঙ্গে জাবাল সামহানেই একত্র হব। পেট্রলপাম্প গাড়ির জ্বালানির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জ্বালানিও মানে দুটো এক্সপ্রেসো কফি নিয়ে নিলাম। পথে যেতে যেতে আমরা আকাশের বুকে ঝলমলে পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প সেরে নিলাম।

সূর্যোদয়ের ঢের আগে আমরা কিন্তু পৌঁছে গেছি নির্দিষ্ট পয়েন্টে। যাত্রাপথ সালালাহ থেকে জাবাল সামহান। যাওয়ার পথে বড় শহর বলতে ত্বাকা। পুরো শহরজুড়ে রাতের বাতি জ্বলছিল আর আকাশে একটা ঝলমলে চাঁদ। পথের দূরত্ব ছিল ১০০ কিলোমিটার। ফোর হুইলারের সাহায্যে পৌঁছতে সময় লাগবে এক ঘণ্টার কিছু বেশি। কারণ পাহাড়ের ওপরে যাত্রাপথ হলো ৪০ কিলোমিটারের মতো, যার পুরোটাই পাহাড়ের বুক চিড়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গিয়েছে।

জাবাল সামহান থেকে সূর্যোদয়ের ফটোশুটে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি লেখক। ছবি: সংগৃহীত
জাবাল সামহান থেকে সূর্যোদয়ের ফটোশুটে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি লেখক। ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়ের মাথায় রাস্তাগুলো এমন সুন্দর করে বানানো যে দেখলে মনে হবে সোজা রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছি। মনে বড় আশা ছিল ওখানকার ন্যাচারাল হ্যাবিটেন্ট যেমন চিতা, হরিণ বা গাজাল দেখব। আরবদের বিশ্বাস পাহাড় হলো জিনদের আবাসন। পুরো পথে শুধু একটা শৃগাল, কিছু উট এবং অনেক অনেক গরু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। এই যে আবার ভুল বলে ফেললাম। আমাদের চারদিকে অসংখ্য ট্রিসট্রাম স্টারলিং পাখির ওড়াউড়ি আর তাদের গান।

এতক্ষণে সবাই চলে এসেছে এবং নিজের নিজের যন্ত্রপাতি অর্থাৎ ট্রাইপড-ক্যামেরা সাজিয়ে রেডি। আমি শুধু একটু সূর্যোদয় দেখতে চাইছিলাম। তাই অবাক নয়নে নির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যতটুকু মেঘ আশা করেছিলাম, বাতাসের ঘনঘটায় মেঘগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল। পাহাড়টা ১ হাজার ৩০০ মিটার বা ৪ হাজার ফিট উচ্চতার।

হঠাৎ মেঘের পর্দায় একটা টুকটুকে লাল টিপ। একটা পলক ফেলার আগেই টিপটা কাস্তের মতো, আবার পলক ফেলার আগেই কাস্তেটা ভরে উঠতে লাগল। পুরো ব্যাপারটায় দুই মিনিট সময়ও লাগেনি। কী আশ্চর্য একটা মুহূর্ত। আমি শাটার টেপা বন্ধ রেখে দৃশ্যটা চোখের পাতায় পুরে নিতে ব্যস্ত ছিলাম। একদম স্থির, নিশ্চল আর সকালের সৌন্দর্যে হতবাক।

পৃথিবী এত সুন্দর। ইচ্ছা আছে সবখানে ঢুঁ মারার। পাখির মতো মনটাকে শর্তারোপে বুকের খাঁচায় পুরে রাখি। মানবিক দায়িত্ববোধের অন্তরালে আমি বারবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি, পান থেকে চুন খসলে বিশ্ব সংসার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল কি না, সে আশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ঘর সাজাই, বিছানার চাদর বদলাই, পরিপাটি করে রান্নাঘর সামলাই, বেলায় বেলায় বাচ্চাদের দেখাশোনা করি।

তবু অধম এই আমি বারংবার প্রকৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকি। যাযাবর মনটাকে কিছুতেই শিকলে বাঁধতে পারি না। আমি জানি না আসলে কতটুকু নিজেকে শাসন করতে হয়। কিংবা কতটুকু প্রশ্রয় দিলে প্রকৃতির কোলে মনটার নিবিড়ভাবে আশ্রয় মেলে। বারবার এই আমার একটা নতুন দিনের সাক্ষী হতে মন চায়। মনটা আসলেই বড্ড বেসামাল।