সফল সম্বন্ধের খোঁজ ও আমাদের মানসিকতা

বিয়ের মধ্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু হয়। ছবি: সংগৃহীত
বিয়ের মধ্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু হয়। ছবি: সংগৃহীত

* চিটাগাংয়ে মেয়ে বিয়ে দেব না। এদের বাসায় সারা বছর মেহমান লেগে থাকে, মেয়ের রান্নাবান্না করতে করতে জান বের হয়ে যাবে, হাঁপ ছাড়ার সুযোগ পাবে না।

* সিলেটি লোকজন আজিব টাইপের। বিয়ের পর অ্যাডজাস্ট করতে না পারলে আফসোস করে দিন কাটাবে। না, না সিলেট বাদ।

*ঢাকাইয়া? মাথা কি সত্যি নষ্ট? ঢাকাইয়াদের শুধু টাকাই আছে। রুচি বলতে কিছু নাই।

*কুমিল্লার লোকজনের মনমানসিকতা ভালো না। শুরুতেই তো কু আছে। অসম্ভব, কুমিল্লা প্রশ্নই ওঠে না।

*পাবনা/সিরাজগঞ্জের লোকজন অসহ্য রকমের ডমিনেটিং। জীবন ভাজা ভাজা করে ফেলবে।

*শুধু শিক্ষিত আর ভদ্র দিয়ে কি হয়? অভাবের ঘর। এখানে বিয়ে দিলে মেয়েকে টাকাপয়সার কষ্ট করতে হবে। সব টাকা ছেলের ছোট ভাইবোন টানতেই চলে যাবে।

* নারে ভাই, এত কোটিপতি ফ্যামিলিতে সম্বন্ধ করতে চাই না। এদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে মানিয়ে চলতে খবর হয়ে যাবে।

বহু বাছাবাছির পর ঐশীর (ছদ্ম নাম) অবশেষে নিজের দেশের বাড়ির পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে হলো। তার বাবা–মা হৃষ্টচিত্তে সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন, ছেলের ফ্যামিলি খুব ভালো, কালচারাল গ্যাপ নেই, অযাচিত কোনো কোনো ডিমান্ড করেনি, বিয়েতে পাত্রপক্ষের স্বভাবজাত কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করেনি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সাদামাটা ঘর, ঠিক যেমন চেয়েছিলাম। সোশ্যাল স্ট্যাটাস এক রকম হওয়া খুব জরুরি, কমবেশি হলেই সমস্যা হয়। সমানে সমান হলে ইনশা আল্লাহ কোনো ঝামেলা হবে না। মেয়ে আমাদের সুখীই হবে!

ঐশীও অনেক আশা নিয়ে ঘর করতে গেল। সে নিজে সুন্দরী, শিক্ষিত, চাকরি করেন। কলেজে থাকতে তার একটা ব্রেকআপ হওয়ার পর আর কোনো সম্পর্কে নিজেকে জড়ায়নি। বিয়ের পুরো সিদ্ধান্তটা মা–বাবার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। মা–বাবার ওপর তার অগাধ আস্থা।

তার বাবা–মায়ের হিসেবে যে বিরাট বড়ো ভুল হয়েছে, তা ঐশী বিয়ের পরদিনই টের পেল। নাশতা খেতে বসে তার শাশুড়ি জানালেন, একটু পর কিছু প্রতিবেশী নতুন বউ দেখতে আসবে। ঐশী যেন সবাইকে বলে তার বাবা–মা শুধু তার রুমটিই নতুন সব আসবাব দিয়ে সাজিয়ে দেননি, শ্বশুরবাড়ির ড্রইং রুমটিও নতুন সোফা, টেবিল, টিভি ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার অফার দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শাশুড়ি মা রাজি হননি। তারা আধুনিক মনা, তাই ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে এত বেশি গিফট নেওয়া পছন্দ করেন না। ঐশী কথাটা শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তার দৃষ্টি দেখে তার শাশুড়ি বললেন, তোমাকে তো বুদ্ধিমতী মেয়ে ভেবেছিলাম, এটুকুও বুঝতে পারছ না? এটা বললে তোমার বাপের আর শ্বশুর দুজনেরই মান রক্ষা হয়...বাপ যে তোমার শুধু খাট আর আলমারি দিয়েছে, তা বললে কি তোমার সম্মান থাকবে? না আমার ইজ্জত থাকবে পাড়ার ভাবিদের কাছে? আমার ছেলেকে তারা কম দামি মনে করে আমাকে নিয়ে হাসবে না? তাদের কাছে নিজেকে ছোট করব নাকি? যদি তুমি বলো, অনেক রিকোয়েস্ট এরপর আমরা কিছু নিতে রাজি হয়নাই, তাহলে আমাকে ওরা মহান ভাববে, আবার তোমার বাপও বদনাম থেকে বাঁচবে। ঢুকল মাথায়?

ঐশীদের ফ্যামিলির নিয়ম হচ্ছে, বউভাতের দুই দিন পর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য দারুণ একটা ভূরিভোজের আয়োজন করা হয়, তারা এসে দাওয়াত রক্ষা করেন এবং ছেলে ও বউকে নিজেদের বাড়িতে ফেরত নিয়ে যান। ঐশীর শ্বশুরবাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো, বিয়ের দিন তো বাড়িতে বউ বরণ একবার হয়েছে। আবার কেন ছেলের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ওদের নিয়ে আসতে হবে? দুই দিন পার হলে তারা নিজেরাই যেন চলে আসে। ঐশীর মা–বাবা ভীষণ মন খারাপ করলেন। নতুন বিয়ে হওয়া আদরের মেয়ে তাদের। এমন এতিমের মতো শ্বশুরবাড়িতে ফেরত যাবে? তাদের সম্মানিত বেয়াই–বেয়ান এসে বউ নিয়ে গেল না, দাওয়াত রক্ষা করল না। মেয়েটার মন কত ছোট হয়ে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। আলোচনার ঝড় উঠল ঐশীর সামনেই। ঐশী সবই চুপচাপ দেখে, শুনে গেল।

সারা বুশরা।
সারা বুশরা।

শ্বশুরবাড়ি ফেরত আসার পর শাশুড়ি আগ্রহ নিয়ে ছেলের কাছে জানতে চাইলেন বৌয়ের বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরা দেখা করতে এসে ছেলেকে কী কী গিফট দিয়েছেন। ছেলে এতসব নিয়মকানুন জানে না, বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কি বউ নাকি যে আমার মুখ দেখে গয়না দেবে? আমাকে তো বিয়েতে ঘড়ি–আংটি এগুলো দিয়েছে। আবার কী? শাশুড়ি প্রথমে হতবাক হলেন, তারপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে সরাসরি ঐশীকে বললেন, ‘তোমাদের তো অবস্থাপন্ন জানি, আমাদের দেশের নিয়মকানুন তো তোমাদের না জানার কিছু নাই...তাহলে আমার ছেলেটা যে দুই দিন ওই বাসায় থাকল, জামাই হিসেবে কী পেল সে? খালি হাতে বিদায় দিয়ে দিল দেখি তোমার মা–বাপ! আমার মেয়ের জামাই যখন আসছিল, একটা ব্যাগও সাথে করে আনে নাই, তার ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সব জিনিস আমরা কিনে তার রুমে গুছিয়ে রেখেছিলাম, আত্মীয়রা দেখতে এসে তারে টাকাপয়সাসহ আরও কত রকম গিফট দিয়েছে। এত দিন হয়ে গেল এখনো সে যখন আসে, ফেরত যাওয়ার সময় আমরা তার হাতে কিছু না কিছু দিই। এই বাসায় তার কয়েক সেট কাপড়চোপড় আলমারিতে রাখা আছে, যাতে থাকতে এলে তাকে নিজের বাড়ি থেকে কিছু বেঁধে আনতে না হয়...। বলে দিয়ো তোমার মা–বাবাকে এই সব, শুনলে যেন কিছু শিখে।’

এতক্ষণ বিশেষ অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল দেখেই চুপচাপ শুনছিল ঐশী, এবার বলে উঠল, বিয়ের সময় আপনার ছেলেকে প্রচুর পরিমাণে জামাকাপড় এবং অন্যান্য যা যা লাগে, সবই তো দেওয়া হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে বউভাতের পর থাকতে গেলে যে জামাইকে আলাদা করে হাতে টাকা গুঁজে দেয়া লাগে, এই নিয়ম আমরা কোনো দিন শুনিনি। আপনার ছেলে তো হাভাতে না যে অকারণে শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নেবে। আর আত্মীয়স্বজনেরা তো সবাই বিয়েতে অনেক ভালো ভালো গিফট দিয়েছেন। নতুন করে জামাইয়ের মুখ দেখে গিফট দেওয়ার অদ্ভুত কথা এর আগে কেউ শুনেছে বলে আমি অন্তত জানি না।

ঐশীর শ্বশুর শান্ত স্বভাবের মানুষ, বড় একটা কথা বলেন না। আজ ঐশীর কথার পেছনে হঠাৎ করে বলে উঠলেন, ঐশী, তুমি বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো কেন? এটা তো ভালো না। তোমার শাশুড়ি খুব ভুলত কিছু বলেননি। তোমাদের আর আমাদের দেশের বাড়ি তো একই জায়গায়। নিয়মকানুন তো তোমাদের অজানা থাকার কথা না। সবকিছু জেনেও তোমার বাবা–মা যা করলেন, এটা আসলেও ঠিক হয় নাই। এত কিছুর পরও যে আমরা চুপ আছি, এটা কিন্তু অনেক বেশি বউমা। যাও এখন আর কথা বাড়িয়ো না, আজকে তোমার খালাশাশুড়িরা বেড়াতে আসবে। সবার সামনে চুপচাপ থেকো। কিছু বলে বোসো না আবার।

ঐশী আর কিছু বলল না। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল নিজের মা–বাবার ওপর। এত গবেষণা করে, এত দেখে শুনে, এত খোঁজখবর করে এই বিয়ে দিলেন তারা? খোঁচার কথা তো তাদের শুনতে হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু ঐশীকে। অমুক জায়গার মানুষ ভালো না, তমুক জায়গার মানুষের সমস্যা। টানাটানির সংসারের লোক লোভী হবে, টিপিক্যাল মধ্যবিত্তদের মন ছোট, খোঁচাখুঁচি বেশি কত যে কথা! কত বাছবিচার তাদের মেয়ের সুখের জন্য। বেশি বড়লোক হলে অহংকার থাকবে, সবাইকে ছোট করে কথা বলবে, এর থেকে মোটামুটি অবস্থাপন্ন পরিবার হলে সবদিক দিয়ে ঠিকঠাক হবে। মেনে আর মানিয়ে জন্য সহজ হবে। কী সহজ অঙ্ক! কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো? সেই তো চিরচারিত সব যন্ত্রণার মধ্যে পড়তেই হলো। সেই অভিযোগ, অনুযোগ, লোকদেখানো প্রতিযোগিতা, টাকাপয়সার নোংরামি, ছেলের বাড়ি মেয়ের বাড়ি বৈষম্য, ভদ্রতার আড়ালের কলুষিত মন—সবই দেখা হলো, সবকিছুর মধ্যে দিয়েই পার হতে হলো। আর শুধু আজ বা এখন নয়, চিরটাকাল এখানেই পার করতে হবে...ঠিক আছে, তাই হোক তবে!

ঐশীর জীবন এখন এক ছকে বাঁধা। সে চাকরি করে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব করে। ছুটির দিনে প্রায় সারা দিন তার মেহমানদারি, ঘরের কাজে চলে যায়। তার নিজের ইনকামের টাকা সে প্রায় পুরোটাই শ্বশুরবাড়িতে খরচ করে।

মা–বাবা প্রায়ই তাকে বলেন, স্বামীকে নিয়ে আলাদা বাসায় সংসার পেতে শান্তিতে, নিজের মতো থাকতে। কিন্তু ঐশী সে চেষ্টা করে না। এমনি তো কথার শেষ নেই। তার ওপর তাদের একমাত্র ছেলেকে তাদের থেকে আলাদা করলে আরও কত গঞ্জনা সইতে হবে, তা সে ভালোই আন্দাজ করতে পারে। ঐশীর বিবাহিত জীবন খুব বেশি দিনের নয়। তবু এর মধ্যেই সে বুঝে গেছে, যত চুপ করে থাকা যায়, তত বেশি অশান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। বাবা–মার প্রতি একটা ভীষণ ক্ষোভ তাঁকে মাঝেমধ্যে তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু সেখানেও সে নিশ্চুপই থাকে।

একজন ঐশীর গল্প এটুকুই। ঐশী তার ভাগ্য মেনে নিয়ে চুপচাপ জীবন কাটাচ্ছে। লোকে দেখবে কী সুন্দর সফল বিয়ে আর ওদিকে এক অদ্ভুত ফাঁকির শিকার হয়ে ঐশীরা নীরবে কেঁদে যাবে। কিন্তু সব মেয়ে ঐশী নয়, প্রতিটি মেয়ে যে ঐশীর মতো নীরব থেকে শান্তি খুঁজবে, এমন ভাবা বা আশা করাও ঠিক নয়। মুখ ফুটে, যুক্তি দিয়ে বলে এবং বুঝিয়ে অন্যায় মনোভাবগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দৃঢ়তা প্রত্যেক মানুষের থাকা উচিত। ভুলকে ভুল আর ঠিককে ঠিক মুখের ওপর বলা দোষের নয় বরং এটা ভীষণ রকমের জরুরি। নীরবে সব মেনে নেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে—এটা ঐশীদের বুঝতে হবে। ঠিক সেভাবেই ছেলের মা–বাবাকে বুঝতে হবে তারা ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন, ছেলে নিয়ে ব্যবসা করতে বসছেন না। আর মেয়ের বাবা–মাকে জানতে হবে অঙ্ক করে, হিসাব করে মেয়ের বিয়ে সফল হয় না।

বিয়ের ক্ষেত্রে হাজারটা জিনিস পরখ করে নেওয়া যায় কিন্তু কারও মনের ভেতর ঢুকে তার সত্যিকার মানসিকতা যাচাই করে নেওয়া যায় না। অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ওটাই। ওটার ওপরেই সুখ–শান্তি, ভালো থাকা, মন্দ থাকা নির্ভর করে। কে কোন অঞ্চলের, কোন অর্থ সামাজিক অবস্থানের—এগুলো দিয়ে আসলে কিছুই হয় না। সবদিক মিলে যাওয়ার পরও অনেক অনেক ব্যাপারই অদেখা থেকে যায়। সবকিছু দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও অনেক বড় বড় ভুল হয়েই যায়!

সফল বিয়ের গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। তাই অন্য সবকিছুর চেয়ে নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন বেশি জরুরি। যাতে আগামীর ঐশীরা একটু ভালো থাকতে পারে, যেন তাদের বাবা–মা বা শ্বশুর–শাশুড়ির মনোভাব ও আচার–আচরণের বলি হতে না হয়!