চলুন বদলে যাই

জেবুন্নেছা জোৎস্না
জেবুন্নেছা জোৎস্না

মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ তফাতে যা–ই বলেন, সত্য তো এই যে আমরা নারীরা পুরুষ থেকে কেবল শারীরিক গঠনে ভিন্ন। এ ছাড়া কোনো দিক থেকেই নারীরা পুরুষ থেকে কোনো অংশে কম নন। তারপরও সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত সামাজিক এবং ধর্মীয় গঠন কাঠামো নারীকে অবদমিত করে রাখছে।

একজন পুরুষ রাত ১২টা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারলে, একজন নারী তা পারছেন না। এর কারণ, আমাদের মানসিকতা এবং নিরাপত্তাহীনতা। নারীরা যতই শিক্ষাদীক্ষায় আধুনিকায়ন করুন না নিজেকে, আজও তাঁকে ঘরের মধ্যে এবং বাইরে হেনস্থার শিকার হতে হয় পান থেকে চুন খসলে। নারীকে হেনস্থা করতে সমাজ অথবা সংসারে কেবল পুরুষেরাই দায়ী নন, নারীরা এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন। আর ঠিক এই অজুহাত দেখিয়ে আমরা নারীরা নিজেদের অযোগ্যতা অথবা ব্যর্থতার জন্য অনেক সময় অন্যদের দায়ী করি অবলীলায়।

যদিও দিন পাল্টেছে; মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী এখন। তথাপি, আজও অনেক মেয়েই সমাজে এবং সংসারে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার। আমরা সমাজ অথবা সংসারকে বদলাতে পারব না ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বদলানোর মাধ্যমে আমাদের নারীদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে অবশ্যই সক্ষম। আসুন আজ থেকে আমরা নিজেকে বদলাই।

ইচ্ছা শক্তি একটা প্রধান ব্যাপার যেকোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য। আর সফলতা খুব সহজে আসে না। আমি অনেক নারীকে বলতে শুনেছি, তাঁর স্বামী তাঁকে সাহায্য করেন না, যার কারণে তিনি জীবনে কিছু করতে পারেন না। হ্যাঁ, পুরুষেরা তো চাইবেনই আপনাকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রেখে গরম ভাত আর ভর্তা-ভাজি খেতে। তবে মনে রাখবেন, আপনি সেই নারী, যে একটু কৌশল করলেই ঘাড় তেড়া পুরুষের ঘাড় যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ঘোরাতে পারেন। পুরুষকে তাঁর চাহিদামাফিক সব ব্যবস্থা করেই আপনি আপনার সময়ের যথার্থ ব্যবহার করেন।

মনে রাখবেন, কেউ আপনার চলার পথ তৈরি করে দেবে না, আপনার পথটি আপনাকেই তৈরি করে নিতে হবে আশপাশের জঞ্জাল সরিয়ে। আর তাই আপনি যখন আপনার ঘরের পুরুষ অথবা পরিবারের সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন যে হ্যাঁ, আপনিও দিন বদলে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন; বিশ্বাস করেন, সেই তিনি যদি মানুষ হন, তাহলে আপনাকে তিনি তখন পূর্ণ সমর্থন দেবেন…কেবল চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজের যোগ্যতাকে একটু প্রমাণ করুন। নিউইয়র্কে আসার পর দুটো বাচ্চা পালন আর শপিং-পার্টি করতে গিয়ে একসময় মনে হলো কাজ করার দরকার। বাসার পাশে টার্গেটে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, এখানে আমার সম্মান বা ভবিষ্যৎ কিছুই নেই। আমি সপ্তাহে তিন দিন কাজ আর তিন দিন করে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম বাচ্চাদের ফুল টাইম স্কুলে দিয়ে। ওদের ড্রপ করে সেই পথেই আমি বের হতাম, আবার ঠিক ওদের স্কুল ছুটি হওয়ার আগে ওদের পিকআপ করে বাসায় আসতাম। বাসায় এসে সব কাজ শেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি ঝিমোতে ঝিমোতে পড়তাম। আমার পথ আদৌ মসৃণ ছিল না, তবে আমার সংকল্প আমায় সাহায্য করেছে এত দূর আসতে। হাইস্কুল এবং অ্যাসোসিয়েট করার সময় আমি ঘরের সব কাজ কমপ্লিট করে তবেই বাইরে যেতাম আর ব্যাচেলরে নিউইর্য়কের একটি ইউনিভার্সিটিতে হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটিশনের মধ্যে যখন আমি চান্স পেলাম, তখন স্বামী আমার জন্য রান্না করে রেখেছে আমি বাসায় এসে খাব সে জন্য। তাই তুরুপের তাস আপনার হাতেই, কীভাবে সেটা ব্যবহার করবেন, তা আপনার সংকল্পের ওপরই নির্ভর করছে।

যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণই আশা থাকে; তাই নিজেকে যোগ্য করার সময় ফুরিয়ে যাইনি, বয়স কোনো ব্যাপারই নয় জীবন নতুনভাবে শুরু করতে। পাশ্চাত্য দেশে অনেক মধ্যবয়সী নারী আবার পড়াশোনা শুরু করেন ভালোভাবে বাকি জীবন কাটানোর জন্য। কেউ কোনো শর্ট কোর্স করেন; কেউ আবার পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন। পড়াশোনা কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, নিজের আত্মতৃপ্তি আর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনেক বৃদ্ধ নারীকে আমি দেখেছি পড়াশোনা করতে। কারণ, তাঁদের কেউ ইয়ং বয়সে সংসারের চাপে, কেউবা পথভ্রষ্ট হয়ে একাডেমিক পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। কেউ স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসাও করেন। এ যুগে স্বামীর একা সৎ উপার্জনে সংসার চালানো দুষ্কর। এ ছাড়া আজ মাথার ওপর বাবা অথবা স্বামী থাকায় মেয়েরা একটা আশ্রয় পান, কিন্তু হঠাৎ এমন যদি হয়, যেকোনো কারণে হোক, মেয়েটির আশ্রয়টুকু হারিয়ে গেল, সেই দুরবস্থায় নিজেকে বেঁচে থাকার জন্য টিকে থাকতেও মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া খুব প্রয়োজন।

তাই নারী, যদি আপনি ভালো থাকতে চান, তবে কেউ আপনাকে দুঃখ দিলেই সে জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে নিজের জীবনের মূল্যবান সময় আর শক্তির প্রতি অবিচার করবেন না, দয়া করে। ভাবুন একবার, আপনি সত্যিই কি এমন দুঃখ পাওয়ার যোগ্য? নাকি যিনি আপনাকে দুঃখ দিলেন, তিনি মানুষটা আপনাকে অনুধাবনে ব্যর্থ? উত্তর পেলে, নিজের ওপর আস্থা রাখুন; প্রতিজ্ঞা করুন, কারও অপমানে আপনি আর কাঁদবেন না; একেকটা অপমানকে বুলেট করে সেই প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োগে নিজেকে ছোটান রকেটের গতিতে। নিজেকে যোগ্য করুন, এমনভাবে যোগ্য করুন যে আপনাকে যাঁরা অপমান করেন, তাঁরা আপনার পায়ের কাছে এসে কুর্নিশ করেন।

হ্যাঁ, আপনি প্রথমত কেবল আপনার জন্য বাঁচবেন, আর আপনার আলোয় আপনা-আপনিই তখন দেখবেন আপনার সংসার, চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে; শুধু একটাই মন্ত্র, নিজেকে সম্মানজনকভাবে যোগ্য করুন, যেটুকু আপনার সাধ্য আর সামর্থ্য তার মধ্য দিয়েই। দুঃখ, যন্ত্রণাকে আকাশে মুখ করে খোলা বাতাসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে একবার দেখুন তো, কেমন সতেজ লাগে! পৃথিবীটা তখন আসলেই খুব সুন্দর মনে হবে; বেঁচে থাকার জন্য মন চাইবে!