সব পথ এসে মিলল এক পথে

বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো রকডেলের হাটবাজার কমিউনিটি সেন্টারে। ছবি: সংগৃহীত
বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো রকডেলের হাটবাজার কমিউনিটি সেন্টারে। ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো ১৫ মার্চ রকডেলের হাটবাজার কমিউনিটি সেন্টারে। বুয়েটের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাচের একটা করে শৈল্পিক নাম দেওয়া হয়। আর ৯৮ ব্যাচের নাম হচ্ছে ‘পথিক’, তাই এটাকে পথিকদের মিলনমেলা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

শুরুতে গত বছরের অক্টোবরে ২০ বছর উদ্‌যাপনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয় বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। তখনই পরিকল্পনা নেওয়া হয়, ২০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করা হবে পরের বছরের মার্চে। তবে এবারও এসে বাগড়া দেয় করোনাভাইরাসের প্রভাব। কিন্তু পথিকেরা করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে রকডেলের হাটবাজারে জমায়েত হতে থাকে সেই সকাল থেকেই।

মিলনমেলার কেক। ছবি: লেখক
মিলনমেলার কেক। ছবি: লেখক

জমায়েতের শুরুতেই পথিকদের কর্মী বাহিনী কাজে লেগে গেল। কেউ শুরু করল মঞ্চসজ্জার কাজ, আবার কেউ শুরু করল শব্দযন্ত্র দোতলায় তোলার কাজ। কেউ নিয়ে এল পথিকদের ব্যাচের লোগো সংবলিত টি–শার্ট, যার বুকের জমিনে ব্যাচের লোগো আঁকা আর পিঠের জমিনে ২০ বছর পূর্তির কথা লেখা। কেউ নিয়ে এল কেক, আবার কেউ শুরু করে দিল অনুষ্ঠান পরিচালনার পরিকল্পনা।

পুরো কার্যক্রমে সহায়তা করে গেল পথিকদের পরবর্তী প্রজন্ম। এরপর মূল কার্যক্রম শুরু হলো টি–শার্ট বিতরণের মধ্য দিয়ে। সবাই একই টি–শার্ট পরে যখন হলময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন ফিরে গেছেন তাঁদের বুয়েট জীবনে অনুষ্ঠিত র‍্যাগ কর্নারে। বুয়েটে প্রতিটি ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠানের নাম র‍্যাগ ডে, তবে এই র‍্যাগ সেই র‍্যাগ নয়, যার কথা শুনলেই এখন অভিভাবকদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়।

২০ বছর পূর্তির আয়োজন চলতে থাকুক, সেই ফাঁকে আমরা ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সময়কাল একটু ঘুরে আসি। বুয়েটে উচ্চমাধ্যমিক পাসের বছর অনুযায়ী ব্যাচের প্রাথমিক নামকরণ করা হয়। যেমন যাঁরা ১৯৯৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন, তাঁদের ডাকা হতো ৯৮ ব্যাচ হিসেবে, যদিও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৯৮ সালে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। ৯৮ ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ২৭ অক্টোবর। এরপর দ্রুতই সময় গড়িয়ে যায়।

বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলায় পরিবেশনা। ছবি: লেখক
বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলায় পরিবেশনা। ছবি: লেখক

তখনকার দিনে বুয়েটে র‍্যাগের যে প্রচলন ছিল, তাঁকে র‍্যাগ না বলে পরিচয় পর্বই বলা উচিত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো হলে ওঠার পর সেই ফ্লোরের বড় ভাইয়েরা একটা দিন ঠিক করে নতুনদের বরণ করে নেন। ফ্লোরের একটা কক্ষের দরজা–জানালা বন্ধ করে দিয়ে সারা ফ্লোরের সবাই সেখানে জড়ো হতে থাকেন। সবশেষে ডাকা হয় নবীনদের। তাঁদের জন্য কক্ষের মাঝখানে আলাদা চেয়ার রাখা হয়, যেন তাঁরা সেদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। অবশ্য সেটাকে অনুষ্ঠান না বলে পারিবারিক আলোচনা বলাই শ্রেয়। নবীনেরা আসার পর শুরুতেই তাঁদের পরিচয় নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বারোয়ারি আড্ডা।

নবীনদের দিয়ে আড্ডাটা শুরু হলেও তা এরপর আর কোনো নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ না করে চলতে থাকে তার আপন মহিমায়। সেখানে বুয়েট থেকে শুরু করে দেশ, দেশের ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি—সবকিছুই চলে আসে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, সেখানে একটা একান্নবর্তী পরিবারের আড্ডা চলছে। আপনি কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারবেন না যে কে সিনিয়র আর কে জুনিয়র, কিন্তু তার মধ্যেই এমন মানুষ আছে, যিনি দুদিন পর বুয়েট ছেড়ে চলে যাবেন। আবার এমন মানুষ আছেন, যিনি বুয়েটে ভর্তি হতে চেয়েছেন মাস ছয়েক আগে। সেই আড্ডা শেষে সামান্য খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই আড্ডার পরপরই জুনিয়ররা বুঝতে পারতেন, তাঁরাও সেদিন থেকে এই একান্নবর্তী পরিবারের অংশ হয়ে গেল।

এরপর সময় যতই গড়াত, হৃদ্যতা আরও বাড়তে থাকত। বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইদের নিজ গরজে নোটপত্র সরবরাহ করতেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন তাঁদের পরীক্ষা এবং ফলাফলের। পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই বড় ভাইয়েরা আবার বন্ধু থেকে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শাসনও করতেন। জুনিয়রদের টিউশনি খুঁজে দেওয়া থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধানে বড়রা সাহায্য করতেন। এমনকি অনেকের পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারেও তাঁরা সহযোগিতা করতেন। তাই যখন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে হল থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত হাজির হতো, তখন তৈরি হতো এক আবেগঘন পরিবেশের। সেদিনও বসত আড্ডা কিন্তু সেটা শেষ হতো বিদায়ী বড় ভাইদের চোখ ছলছল অবস্থা দিয়ে। অনেকেই জুনিয়রদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করতেন, যেন নিজের পরিবার ছেড়ে তাঁরা বহুদূরে চলে যাচ্ছেন।

হল জীবনের পাশাপাশি চলত ক্যাম্পাস জীবন। সেখানেও পড়াশোনার পাশাপাশি সব রকমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই চলত পাল্লা দিয়ে। লেভেল পূর্তি, বার্ষিক বনভোজন—সবকিছুরই আয়োজন চলত বছরব্যাপী। এবং একসময় চলে আসত বিদায়ের ক্ষণ। বিদায়ী ব্যাচের কর্মকাণ্ডকেও বলা হতো র‍্যাগ ডে। র‍্যাগ ডে সামনে রেখে বছরব্যাপী চলত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। প্রতিটি হলে হলে র‍্যাগ ডে পালনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবেও র‍্যাগ পালনের প্রস্তুতি চলত মহাসমারোহে। র‍্যাগের অনুষ্ঠান শেষ হতো র‍্যাগ কনসার্টের মাধ্যমে। সেই কনসার্ট শেষেও একই আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হতো। এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন, যেন আর তাঁদের দেখা হবে না। এভাবেই পথিকদেরও মিলনমেলা ভেঙেছিল সেই ২০০৪ সালে। তারপর পথিকেরা ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়, তবে বাংলাদেশের বাইরে সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি পথিকের বসবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, তাই ২০ বছর পূর্তির এই আয়োজন সামনে রেখে শুরু থেকেই সিডনির পথিকেরা ছিল আন্তরিক। প্রবাসের রুটিন জীবনের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করাটা আসলেই ঝক্কির বিষয়, বিশেষ করে যেখানে অনেক লোকের সমারোহ হওয়ার কথা আছে, তবু সিডনিপ্রবাসী পথিকেরা তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেটা সফল করেছে।

‘পথিক’দের পরের প্রজন্মও ব্যস্ত কাজে। ছবি: লেখক
‘পথিক’দের পরের প্রজন্মও ব্যস্ত কাজে। ছবি: লেখক

ফিরে আসা যাক ২০ বছর পরের সাত সমুদ্র তের নদীর পারের মিলনমেলায়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই পথিকদের পরবর্তী প্রজন্মের কণ্ঠে পরিবেশিত হলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। তারপর বুয়েটের শিক্ষার্থী সনি, আবরার এবং পথিক শিবলীর স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো।
উল্লেখ্য, পথিক ব্যাচ ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় সনি হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং পথিক ব্যাচই সেই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ জানিয়ে তখনকার সরকার এবং বুয়েট প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। আজ আবারও যখন আবরারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তখন দেশে–বিদেশে বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের বাইরে পথিকেরাই সবচেয়ে বেশি আন্দোলন ও কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। পথিকদের অন্যতম সদস্য আহমেদ জাভেদ জামাল, যিনি ছিলেন সনি আন্দোলনের অগ্রপথিক; তিনিই আবার নিজ উদ্যোগে আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুয়েটের শহীদ মিনারে সব বয়সী বুয়েটিয়ানদের নিয়ে সম্মেলন করে বুয়েটের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।

এরপর শুরুতেই পথিকদের পরবর্তী প্রজন্ম একে একে দারুণ সব পরিবেশনায় উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এ ছাড়া পথিক এবং তাদের পরিবারবর্গের পরিবেশনাও ছিল অনেক বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর। পথিকদের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে ওঠেন ৯৯ ব্যাচের মাশফিক। মাশফিক একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁর প্রতিটি গান পথিকদের আবার সেই ২০ বছর আগের কথা মনে করিয়ে দেয়। মাসফিকের পরিবেশনা শেষে চলে খাওয়ার পর্ব; পাশাপাশি চলতে থাকে বাচ্চাদের ফেস পেইন্টিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রম, যাতে করে বাচ্চারা বিরক্ত না হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে।

দুপুরের খাওয়ার শেষে মঞ্চে ওঠেন সিডনির প্রখ্যাত ব্যান্ড ধূমকেতু। ব্যান্ডটির পরিবেশনা ছিল এককথায় অসাধারণ। তাঁদের গানে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছেন এবং নেচেছেন সব পথিক। দেখে মনে হচ্ছিল, এটা যেন বুয়েট ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ার সামনের মাঠের সেই র‍্যাগ কনসার্ট।

বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলার মগ। ছবি: লেখক
বুয়েটের ৯৮ ব্যাচের সিডনিপ্রবাসী বুয়েটিয়ানদের মিলনমেলার মগ। ছবি: লেখক

সময় যে কীভাবে চলে যাচ্ছিল, সেটা টেরই পাওয়া যাচ্ছিল না। কখন যে সকাল গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, সেদিকে কারোরই খেয়াল ছিল না। এর মধ্যেই একসময় পথিক হানির হাতের তৈরি সুন্দর এবং সুস্বাদু কেকটি কাটা হলো। একসময় মিলনমেলা শেষ হলো। সবাই নিজ নিজ বাসায় ফেরার আগে আবারও একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে নিল ঠিক যেমন র‍্যাগ কনসার্ট শেষে সবাই একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেছিল সেই ২০০৪ সালে। এখন থেকে প্রতিবছর একটা করে পুনর্মিলনী আয়োজনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে শেষ হলো পথিকদের প্রাণের মিলনমেলা। তখন সবারই মনের কোণে বেজে চলেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান:

‘আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।’