২২ মার্চ ২০১৬, জীবনের ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা

বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত বিমানবন্দর। ছবি: সংগৃহীত
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত বিমানবন্দর। ছবি: সংগৃহীত

আবুধাবিতে দেড় ঘণ্টা যাত্রাবিরতি শেষে যখন ইত্তিহাদ এয়ারলাইনসের হাওয়াই জাহাজটা ব্রাসেলসের উদ্দেশে আকাশে উড়ল, তখন স্থানীয় সময় রাত সাড়ে তিনটা। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা প্লেনটা আমাদের আবুধাবি পৌঁছিয়েছে সাড়ে চার কি পাঁচ ঘণ্টায়। আরও কমপক্ষে সাত ঘণ্টার যাত্রা! নিজের দেশ, আপন মানুষদের মায়াবী মুখগুলো, মাটির ঘ্রাণ, সব যেন দূর থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। মায়ের আঁচলের ঘ্রাণটাই শুধু সঙ্গে আছে এখন। ওদিকে দুই মেয়ে ওদের মা কেউই যাত্রাপথে স্বস্তিতে থাকে না একদণ্ড। মোশন সিকনেস নামের এক ব্যামো, বাসে, প্লেনে, এমনকি ট্রেনেও ওদের বেশ জ্বালাতন করে। রিকশায় চড়লে আবার এটা হয় না, তাই ওদের কাছে এ গ্রহের সবচেয়ে প্রিয় বাহন ওই একটাই!

মেয়ে দুটো প্রথমবার মা–বাবার দেশ ভ্রমণ করে ফিরছে। প্রথম দিকে কয়েক সপ্তাহের অসুস্থতা আর ঢাকা কক্সবাজারের দীর্ঘ যাত্রা ওদের কষ্ট দিলেও পরে অবশ্য ভালোই উপভোগ করেছে সময়টা। প্লেনের মধ্যে কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে দেখে মায়া লাগছে ওদের জন্য। আবছা আলোয় যাত্রীদের বেশির ভাগ ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ কেউ হয়তো সিটে লাগানো স্ক্রিনে মুভি অথবা গান উপভোগ করছে। রাতের ভ্রমণে এর থেকে বেশি কিছু করা যায় না। দিনে অন্তত নীল আকাশ; পেঁজা তুলোর মতো নিচে ভাসমান সাদা মেঘমালা অথবা বিশাল কোনো মহাসাগরের কালো জলরাশি অথবা বিস্তীর্ণ বিবর্ণ ভূমি দেখেও ভ্রমণের বিরক্তি দূর করা যায়। আর মোটে তো কয়েকটা ঘণ্টা! সাড়ে সাতটায় ল্যান্ডিং আর বাকি আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঘণ্টা খানেকের একটা গাড়িযাত্রা শেষেই তো নিজের ঘর, মানে অফুরান শান্তি!

সকালের নাশতা সারতে সারতে নির্দিষ্ট সময়েই প্লেন গন্তব্য ছুঁয়েছে। ইমিগ্রেশনও বেশ জলদিই হয়ে গেল, এখন শুধু বের হওয়ার পালা! ওদিকে বন্ধু রিপন ভাই, যিনি গাড়ি নিয়ে আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন আমার শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে, তিনি ফোন করে জানালেন, ৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি পৌঁছাবেন। বেল্ট থেকে নামিয়ে দুটি ট্রলিতে লাগেজগুলো নিলাম। একটা ট্রলি আর ছোট মেয়ে আয়শাকে কোলে নিলাম, আর একটা হাতব্যাগ ও বড় মেয়ে জাইনাব ওর মায়ের সঙ্গে, বাকি একটা ট্রলি ভেতরে রেখে আমরা বের হলাম। মার্চের শেষের দিকে হলেও এখনো বেশ ঠান্ডা বাইরে। একটা নিরাপদ জায়গায় ওদের দাঁড় করিয়ে অন্য ট্রলিটা নিয়ে আসার জন্য আমি গেটটা পার হয়ে ভেতরে গেলাম। সব মিলিয়ে ৫০ মিটার দূরত্ব হবে। ট্রলিটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি বের হব বলে, ঠিক ওই মুহূর্তে ইমিগ্রেশন ডেস্কগুলো যেখানে সারিবদ্ধ, ঠিক তার ওপরের দিকের ছাদের একটা অংশ বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে খসে পড়ল! কর্তব্যরত দু-একজন লুটিয়ে পড়ল, হতভম্ব অনেকের মতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। ঠিক এমন সময় আরও একটা বিকট শব্দ...আরও কিছু ভেঙে পড়ার দৃশ্য...ভয়ার্ত মানুষের আর্ত চিৎকার ছুটোছুটি...এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী এসে মেইন গেট বন্ধ করে দিয়েছে, আর যে যেখানে আছে বসে পড়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। শত শত মানুষে ভর্তি পুরো হলটায় নেমে এল পিনপতন নীরবতা!

আমি এখনো কিছু জানি না কী হতে যাচ্ছে। অনেক সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার পরিবার বাইরে অপেক্ষা করছে, আমি কি দয়া করে ওদের কাছে যেতে পারি? তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ওপরের ডিপার্চার লেভেলে একটা ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এবং নিরাপত্তার খাতিরে কারও বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। আশা করছি বাইরের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে আপনার পরিবার নিরাপদে আছে। আমি লোকটির কথায় মোটেই আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আমার স্ত্রীর ফোন দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওর কাছে ছিল না, তাই ওদের কোনো খবর নেওয়ার সুযোগও আমার কাছে রইল না। এক ভয়াল অন্ধকার গ্রাস করে নিল আমার সমস্ত সত্তাকে। আমার প্রাণপ্রিয় দুই সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী জানি না কেমন আছে, আদৌ নিরাপদে আছে কি না...আমি ভাবতে পারছি না কিছু, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, সমস্ত দেহ শীতল হয়ে আসছিল ক্ষণে ক্ষণে। কতশত অশনি–চিন্তা আমাকে অন্ধকারের গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে নিচ্ছিল। বাইরে অপেক্ষারত রিপন ভাই আমার শাশুড়ির সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ করার সুযোগ নেই ফোন বন্ধ রাখার নির্দেশের কারণে।

শ্বাসরুদ্ধকর ৩০ মিনিট কেটেছে ৩০ বছরের উত্কণ্ঠায়। গেটটা খোলা মাত্র হন্যে হয়ে বাইরে ছুটে এলাম, যেদিকে দুচোখ যায় নিরাপত্তাকর্মীদের তৎপর বিচরণ ছাড়া সাধারণ মানুষের উপস্থিতি তেমন দেখতে পেলাম না। মানুষের লাগেজ, ব্যাগ, ট্রলিগুলো পড়ে আছে এখানে–ওখানে। মোবাইল খুলে রিপন ভাইকে ফোন করলাম, তিনি বিমানবন্দরের বাইরে কোনো জায়গায় গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য, তিনি জানালেন, অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে, পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। আমার শাশুড়ির কান্নাজড়িত প্রশ্ন, আমরা সবাই ঠিক আছি তো? মিথ্যে বললাম, বললাম, হ্যাঁ, আমরা ঠিক আছি। আমি রিপন ভাইকে সত্যটা বলে অনুরোধ করলাম আপাতত শাশুড়িকে কিছু না জানাতে। হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে এলাম সিঁড়ি বেয়ে। এখানে মানুষের ভিড়ে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পুলিশ, সেনা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সব মিডিয়া তখন পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। সব মিডিয়া লাইভ কভার করছিল পরিস্থিতির।

পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বিস্ফোরণের ছবিসহ সংবাদ। ছবি: সংগৃহীত
পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বিস্ফোরণের ছবিসহ সংবাদ। ছবি: সংগৃহীত

আমি পাগলের মতো ছুটোছুটি করে খুঁজতে লাগলাম ওদের। অনেকের মতো আমিও চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, কিন্তু কোনো সাড়া আসছিল না কোনো দিক থেকে। যেখানে যাকে পাচ্ছি জিজ্ঞেস করছি ওদের কথা। কেউ কোনো হদিস দিতে পারল না। তবে কি ওরা ভয়ানক কোনো বিপদে? আমি কিছু ভাবতে পারছি না, আমার প্রাণস্পন্দন বুঝি থেমে যাবে, এত কোলাহলেও যেন হৃৎস্পন্দন কানে এসে বাজছিল। এদিক-ওদিক, যেদিকে পথ গেছে, ছুটছি আর ছুটছি ওদের খোঁজে। রিপন ভাই এসে যুক্ত হলো আমার সঙ্গে আমার শাশুড়িকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে। বিমানবন্দরের চতুর্দিকের কয়েক কিলোমিটার জায়গা চষে বেড়িয়েছি দুজন দুদিক থেকে। প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা হবে অবিশ্রান্ত ছুটেছি আর চিৎকার করেছি। কোথাও কারও সাড়া পেলাম না। কর্তব্যরত অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি পূর্ণ বিবরণসহ, কেউ কোনো সাহায্য করতে পারলেন না, শুধু বললেন অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো পরামর্শ আপনাকে দিতে পারছি না। কেউ শুধু আমাকে বলুন ওরা বেঁচে আছে, নিরাপদে আছে, তাহলে আমি একজন্ম অপেক্ষা করব ওদের জন্য। করুণাময় আল্লাহর কাছে এত আকুতি করে কোনো দিন কিছু চেয়েছি বলে জানা নেই। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, হিন্দি, উর্দু, যাকে যে ভাষার মনে হয়েছে শুধিয়েছি ওদের কথা। আহত–নিহত মানুষদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সাইরেনের শব্দ যেন বুকের ভেতরটাকে দুমড়েমুচড়ে পিষ্ট করে যাচ্ছিল। আমি ভেঙেচুরে যেন বারবার গড়ছিলাম আর হন্যে হয়ে ছুটছিলাম। অন্ধকারেরও সীমা থাকে, কিন্তু আমি যেন অতলান্ত এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমার শরীরের সমস্ত রক্তবিন্দু যেন হিম হয়ে আমার পায়ের গোড়ালিতে এসে জমেছে, কোনো দিকেই পা দুটো আর যেতে চাইছিল না।

একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নিচের বিস্তীর্ণ চারপাশে অনেক মানুষ দেখা যায়, রিপন ভাইও আমার সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ মনে হচ্ছিল দূর থেকে কেউ একজন একটা বাচ্চা কোলে আরেকটা বাচ্চা মেয়েকে একহাতে ধরে এই দিকেই আসছিল! আমি খুব ভালো করে দেখার জন্য নিচের দিকে দৌড়ে নামছিলাম আর আল্লাহকে বলছিলাম, হে করুণাময়ম ওরাই যেন তারা হয়, যাদের জন্য আমি এতটা ব্যাকুল আর অসহায় হয়ে আছি। একটু এগিয়ে যেতেই আমার চোখ যা দেখছিল তাকে বিশ্বাস হলো না! আমি সত্যিই ওদের পেয়ে গেছি? নাকি এ শুধু আমার ভ্রম? সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার করে ডাক দিলাম ‘প্রিয়’ বলে (এই নামেই আমরা দুজন দুজনকে ডেকে থাকি)! আকাশ থেকে নেমে এসে যেন আমার প্রাণটাই আবার আমার সামনে দিয়ে এসে আমার শরীরে প্রবেশ করছে। আমাকে দেখে চিৎকার করতে করতে আত্মহারা প্রাণপ্রিয় তিনটা মানুষ আমার দিকে ছুটে আসছে! এর চেয়ে সুন্দর কোনো দৃশ্য কেউ কল্পনা করতে পারবে কি না আমার জানা নেই। এর চেয়ে বেশি কেউ পেতে পারে জীবনে, এটাও অসম্ভব! পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য পায়ের কাছে এনে দিলেও মানুষ এতটা খুশি হবে আমার মনে হয় না। চারজনের সেই কান্নাজড়িত আলিঙ্গন দেখে রিপন ভাইও অনেক বড় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল বলা বাহুল্য। এর আগে আমার শাশুড়ির বারবার ফোনের কারণে সত্যটা না বলে পারা যায়নি, আর সেই থেকে তাঁর কান্না এক মুহূর্তের জন্য থামেনি যতবার কথা বলেছি ফোনে। মেয়ে আর নাতনিদের ফিরে পেয়ে তাই তাঁর সজল নয়নের হাসিটাও মনে থাকবে সারা জীবন।

আমার কাছেই এখন আমার হারিয়ে ফিরে পাওয়া পৃথিবীটা! কখনো এভাবে হারাতে দেব না আর। সেদিনের সেই ঘরে ফেরার আনন্দ জীবনে ভোলার নয়। আমার কাঁধের ব্যাগে সবার পাসপোর্টগুলো ছিল...বাকি সবকিছুই পড়ে রইল এয়ারপোর্টের মেঝেতে অযত্নে, পড়ে থাক। একটুও মন খারাপ হয়নি কোনো কিছুর জন্য। জীবনের সবচেয়ে দামি যে জিনিস হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছি। এটা সত্যিই হয়তো জরুরি ছিল, আমি কতটা ঐশ্বর্যবান এটা জানার জন্য।

সেদিনের ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় এয়ারপোর্টে ২২ জন এবং আরও দুই জায়গায় ১০ জনসহ মোট ৩২ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। বহু মানুষ আহত হয়েছেন। সেই মর্মান্তিক হামলায় যে নিরীহ মানুষগুলো নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। যাঁরা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা–সমবেদনা জানাই। ২০১৬ সালের ২২ মার্চ এক বিভীষিকাময় দিন। আল্লাহ আমাকে আমার পরিবারকে অক্ষত রেখেছেন, এর চেয়ে বড় কোনো পাওয়া হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা পাক প্রতিটি নিরীহ মানুষ।