অবরুদ্ধ এক নগরের দিনগুলো

শহর ফাঁকা। ছবি: লেখক
শহর ফাঁকা। ছবি: লেখক

তীব্র বরফঠান্ডা শেষ হয়ে মাত্র গাছপালাগুলো রোদের আলোর দেখা পাচ্ছে। জানালা খুললেই সকালে এখন পাহাড়ি শুষ্ক বাতাস রুমে আসে। এই তো সপ্তাহ চারেক আগে উত্তর-পশ্চিম জার্মানির ছোট্ট কোবুর্গ শহরের অসম্ভব ভদ্র মানুষগুলো ছিল প্রাণোচ্ছল, কথায় কথায় ‘ডাঙ্কে শুন’ (অনেক ধন্যবাদ) বলা মানুষগুলো নিশ্চিন্তে কর্ম ব্যস্ত দিন পার করত। খুব সকালে বাচ্চারা স্কুলটিচারের পেছনে হাঁসের বাচ্চার মতো লাইন ধরে সিগন্যাল পার হতো।

পাহাড়ি ইটস নদীর পাড়ে সকালে–বিকেলে সাইক্লিং–জগিং করা মানুষগুলোকে দেখলে বোঝাই যেত, এরা কতটা আক্ষেপহীন সুখী। জানুয়ারির প্রথম থেকেই বিশ্ব আলোচনার কেন্দ্রে কোভিড–১৯, এই শহরও ব্যতিক্রম নয়। সুদূর চীনে অথবা পাশের ইতালিতে ছড়িয়ে পরা ভাইরাস নিয়ে হুট করে আতঙ্কিত হওয়ার জাতি এরা নয়। নিজের সরকার, দেশ যতক্ষণ নির্দেশনা না দেবে, এরা থোড়াই কেয়ার টাইপস!

জার্মান চ্যান্সেলর যখন হঠাৎ ঘোষণা করলেন ৭০ ভাগ নাগরিক পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, এক রাতের মধ্যেই নগরের রাস্তা, দোকান এবং মানসিকতায় সব পরিবর্তন! এই শহরের ভদ্র মানুষগুলো যতটা আতঙ্কিত, ততটাই শৃঙ্খল, না দেখলে বোঝা কঠিন। এই শহর এখন অবরুদ্ধ, মানুষগুলো প্রাণহীন দৃষ্টি নিয়ে বাসার বারান্দায় বসে থাকে, দূরে তাকিয়ে থাকে। রাস্তায় হঠাৎ খুব বেশি প্রয়োজনীয় দু–একটা মাস্ক পরা মানুষের ভয়ার্ত দ্রুত চলাফেরা দেখা যায়। সুপারশপগুলো প্রায় খালি। অনেক পরিবারকে দেখা যাচ্ছে খালি হাতে কিছু না কিনেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। এপোথিকাগুলোয় (ফার্মেসি) মাস্ক, স্যানিটাইজারের সংকট দেখা দিয়েছে, অসহায় মানুষগুলো বিষণ্ন মন নিয়ে বের হয়ে আসছে। এই মৃত প্রায় নগর সম্পূর্ণ অচেনা, কোনো কোলাহল নেই, আড্ডা নেই রেস্টুরেন্টগুলোয়, বারগুলোয়।

মানুষ নেই কোথাও। ছবি: লেখক
মানুষ নেই কোথাও। ছবি: লেখক

অযথা বের হলেই মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হচ্ছে, একটু পরপর মাইকিং করে সাবধান করা হচ্ছে। অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যাবে, এরপরও বের হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। খুব দরকারে দুজনের বেশি এক জায়গায় হওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। অমান্য করলে ২৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। এগুলো এখন আর ফেডারেল সরকারের পরামর্শ পর্যায়ে নেই, আইন মানতে বাধ্য। অবাক ব্যাপার হলো, নিজের সেফটির কথা চিন্তা করে ভদ্রতা থেকে বের হয়ে স্টুডেন্ট ডর্মের কাছের ভিনদেশি বন্ধুদের সরাসরি বলতে হচ্ছে, ‘আমার রুমে এসো না।’ এমন করুণ দশা হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি কেউ। এই লেখা পর্যন্ত আক্রান্ত বেড়ে ৪৭ হাজার ২৭৮ জন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় হু হু করে বেড়েই যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম এই জাতি এত বড় বিপর্যয়ে। তারা অযথা অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক, অকালমৃত্যু দেখে অভ্যস্ত নয় আমাদের মতো, আর সেখানে দিনে রাতে কফিন দেখছে, লাশের গাড়ির হুইসেল শুনছে, আক্রান্ত স্বজন নিয়ে হসপিটালে সময় পার করছে আতঙ্কে। শক্ত অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জার্মানরা হয়তো দ্রুতই বের হয়ে আসবে এই সময় থেকে কিন্তু ছিমছাম এই শহরের মানুষগুলোর ট্রমা কতটা সহজে কাটবে, এটাই দেখার বিষয়। এদের অবস্থা দেখে আমার দেশের জন্য অসহায় লাগছে। বাংলাদেশ এখনো এক সপ্তাহ দূরে আছে ভয়ংকর এই ট্র্যাজেডি থেকে, নিজে সচেতন হয়ে নিজের পরিবার, দেশকে বাঁচান। নাহলে এই দুঃস্বপ্ন জেগে থেকেই দেখা ছাড়া কিছু করার থাকবে না।

আমাদের সভ্যতার অত্যাচারে পৃথিবী, প্রকৃতি হয়তো অনেক বেশি ক্লান্ত, তাই হয়তো এই আক্রোশ। প্রতি এক শ বছরে হয়তো এমন মহামারি বলিদান নিয়ে মানবসভ্যতার ওপর করুণা করে আরও কিছু বছর বেঁচে থাকার জন্য। শেষ হোক, দ্রুতই শেষ হোক প্রকৃতির এই অসুস্থ উৎসব। ছেড়ে দাও, আরও কিছু সময় আমাদের সভ্যতাকে নিশ্বাস নিতে দাও এবারের মতো।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব কোবুর্গ ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, কোবুর্গ, জার্মানি