হসপিস কেয়ার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজ সকালে যে পেশেন্ট এল, দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিক নেই। এখানকার লোকজন আমাদের মতো অল্পতে ভেঙে পড়ে না। ভয়ানক প্র্যাকটিক্যাল।

জিজ্ঞেস করতেই শুরু করলেন, আমার ওয়াইফ হসপিটালে ছিল, এখন হোম হসপিসে!

আমার মুখে কথা সরল না কয়েক সেকেন্ড। আরেকটু জিজ্ঞেস করতেই কান্না আর আটকাতে পারল না। আগেই বলেছি এরা প্র্যাকটিক্যাল। ওয়াইফ বাঁচবে না জেনে তাঁকে কমফোর্টেবলে নিজ বাসায় মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছে!

হসপিস কী যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য এটি হচ্ছে মেডিকেলের এক শাখা, যেখানে মৃত্যু পথযাত্রী লোকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে কোনো কেমো বা এক্সট্রা চিকিৎসা দিয়ে তাঁদের মৃত্যুকে দেরি করার ব্যবস্থা করে, তাঁদের সাফারিং লং না করার চেষ্টা করা!

মনে হয় বোঝাতে পারলাম না।

আচ্ছা আবার চেষ্টা করি, কোনো এক্সট্রা চিকিৎসা না করিয়ে, সাফারিং না বাড়িয়ে কম কষ্টের মৃত্যু।

না, এটা মৃত্যুবরণ করার সাহায্য করা নয়।

বরং নিশ্চিত মৃত্যুতে কমফোর্ট দেওয়া।

এটা শুধু তাঁদের জন্য, যাঁদের আয়ু ৬ থেকে ১২ মাস, টার্মিনাল ইলনেস, মানে যেসব রোগের আর কোনো বাস্তবসম্মত চিকিৎসা নেই বা চিকিৎসায় তাঁদের কষ্টের মেয়াদ বা সফর বাড়ানো হয়, তাদের জন্য!

যদি কেউ এই সময়ে সুস্থ হতে থাকে বা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে বা এতটা কেপাবল হয় যে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে সে আর হসপিসে থাকবে না, তারা সে কেয়ার থেকে বের হতে পারে। যেটা খুব রেয়ার। মানে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ রোগীই মারা যায়।

এটি হসপিটাল, ক্লিনিক, বাসাবাড়িতে যেকোনো জায়গায় সার্ভিস দেয়।

আমার কাছে মনে হয় খুব ডিগনিফাইড ব্যবস্থা।

কেন?

আমি প্রায়ই দেখি স্টেজ ৪ ক্যানসার বা এমন সব অসুস্থতা যে তার বাঁচার সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ, তাদের জন্য এবং তাদের ফ্যামিলির জন্য এটা আশীর্বাদ! দেখি লোকজন পোস্ট করে ৫০ লাখ টাকা বাঁচাতে পারে একে বা তাকে বা সে রকম কিছু—ভাই তার চিকিৎসা হলো, তার দুই দিন পর মানুষটা মারা যাবে, ফ্যামিলি আশায় থাকে, ভিটামাটি বিক্রি করে, লোন বন্ধক রাখে সব—নিজেরা তো সর্বস্বান্ত হয়ই, সঙ্গে ফ্যামিলি বা বাচ্চাদের জীবনও শূন্য করে দিয়ে যায়।

তার চেয়ে সেই পয়সা নষ্ট না করে, মানতে হবে যেকোনো আশা নেই, কঠিন মানা, কিন্তু সত্যি! আমাদের আবেগি জাতির জন্য কষ্টকর মানা কিন্তু আসলে সময় ভাববার। ভুয়া আশা দিয়ে কষ্ট প্রলম্বিত না করে, কাউন্সেল করান—রোগী ও তার পরিবারকে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করান।

এরা কী করে?

রক্তশূন্য রোগীর কোনো ব্লাড দেবে না, ক্যানসারের কোনো ট্রিটমেন্ট। চলবে না, সিভিয়ার শ্বাসকষ্টের রোগীর কোনো ভেন্টিলেটর না, খেতে না পারতে নলের মাধ্যমে খাওয়া নয়! কোনো আইভি ফ্লুইড নয়! কোনো সার্জারি নয়! শ্বাসকষ্ট ও ব্যথানাশক দিয়ে যতক্ষণ বা যত দিন সে বেঁচে থাকে, ততক্ষণ সাধারণ চিকিৎসা। যারা খেতে পারে তারা খাবে, হাঁটাচলা করতে পারলে করবে। কষ্টবিহীন মৃত্যু বলে!

শুনতে খারাপ হয়তো শোনাচ্ছে, আসলে নয়! আমার প্রিয় মানুষটির কষ্টকরভাবে দিনের পর দিন বেঁচে থাকার পক্ষপাতী আমি নই। যদি নিজে শ্বাস নিতে না পারি, নিজের দেখাশোনা না করতে পারি, মানে সে রকম অবস্থা কখনো হয় যে ফিরে আসার চান্স শূন্য, আমি ভেজিটেবল হয়ে মৃত্যুর দিন গুনতে চাই না। আর এটার জন্যই হসপিস!

আমরাই বলি আল্লাহর মাল আল্লা নেবেন, আমাদের জন্য এটি তো আরও সোজা হওয়ার কথা।

এর মানে এই নয় যে স্ট্রোক হয়েছে, তার চিকিৎসা বন্ধ করে মেরে ফেলা। অথবা অ্যাজমার রোগীকে চিকিৎসা ছাড়া মেরে ফেলা। এটি শুধু জীবনের শেষ সময়ে, টার্মিনাল ইলনেসের চিকিৎসা।

যা–ই হোক, অনেক দিনের সংসার তার। ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে বেচারা। কিন্তু যেহেতু বাঁচতে পারবে না, ঠিক। করেছে, যে কয়দিন বাঁচবে, নিজের ঘরে, নিজের পরিচিত মণ্ডলে শান্তির মৃত্যুটা পাক! এখানে এটাও রেয়ার, কেউ নিজ বাড়িতে স্বামী, সন্তান, মা–বাবার মৃত্যু চায় না!

দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে—দুজনেরই প্রথম পক্ষ মারা গেছে, ডাবল কষ্ট লোকটির জন্য।

তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই, শুধু দোয়া করি তার স্পাউস শান্তিতে মৃত্যুবরণ করুক, আর সেটা সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর হোক!

আমরাও অনিবার্য মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করি।