গৃহবন্দীর জবানবন্দি-৪

লাশের কফিন।
লাশের কফিন।

গৃহবন্দী হয়ে কীভাবে আছি, বর্ণনা করার আগে শোনেন আমার অনুভূতি।

প্রতিটি জীবনই বাস্তব, প্রতিটি মৃত্যুই অকাল্পনিক। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাবিধুর। প্রতিটি মৃত্যুই কঠিন অসহনীয়। আমরা মৃতের সংখ্যা শুনতে চাই না। কিন্তু আমরা মৃতের সংখ্যাই এখন শুনি, এখন মৃতের সংখ্যা আমরা গণনা করি, আমরা সংখ্যা নির্ণয় করি।

২০২০ সালের ৪ এপ্রিল। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ৭০৮। মৃতের সারিতে পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা। সবচেয়ে ভারী এ সংবাদ তার মা–বাবার জন্য। ক্ষতিটা তাঁদেরই। এ ক্ষতি কখনো পুষিয়ে ওঠার নয়। ১৩ বছরের আরেকটি বাচ্চা মারা যাওয়ার পরের ঘটনাটা আরও মর্মান্তিক। মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন তাকে দাফন–কাপন করিয়েছেন। জানাজার যে ফটো দেওয়া হয়েছে, যা আমার ফেসবুকে শেয়ার করেছি, তা থেকে দেখা যায় দুই মিটার দূরত্বে থেকে মাত্র পাঁচ–ছয়জন লোক জানাজায় অংশ নিয়েছেন। তার মা–বাবা, ভাইবোন কেউ ছিলেন না। আত্মীয়স্বজন তাকে বিদায় দেননি। তাঁদের চোখে জল না পাথর, আমি জানি না। জানতে ইচ্ছা করে, আমার তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। মৃতের সংখ্যা, এই সংখ্যার প্রত্যেকেই একেকেজন ব্যক্তি, একজন সিনিয়র সিটিজেন, একজন যুবক, একজন চিকিৎসক, একজন নার্স। আমাদেরই একজন। আমাদেরই নিজের একজন। প্রত্যেকেই একেকটি চেহারা। একেকটি সত্যিকারের বাস্তব মানুষ। তাঁদের চেহারা আমাদের চোখের সামনে। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যার চিত্র চরম, প্রতি দিন মৃতের সংখ্যার চিত্র করুণ। আজকের (৪ এপ্রিল) মৃতের সংখ্যা লাফ দিয়ে উঠেছে ৭০৮–এ। মৃতের হার বেড়েই চলছে। মৃতের হার ঝড়ের বেগে বেড়েই চলছে।

লন্ডনের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এই বেড়ে যাওয়া সংখ্যা অস্বাভাবিক। আমরা লাশের ভার বহন করছি। এই ভার বহন করা কঠিন। খুবই ভারী। হে প্রভু, আমাদের মাফ করে দাও। গোনার কারণে আমাদের আর শাস্তি দিয়ো না। আমরা এই ভার বহন করে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

এখানে লন্ডন শহরে যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাঙালি আছেন। আমি বাইরে যাই কখনো কখনো। শুধু নিজের শপিংয়ের জন্য না। আরও একটি পরিবার (ভলনারেবল) আছে, তাদের শপিং করে দিই। তো নিজে যথাসাধ্য সতর্ক থেকে অবশ্যই আল্লাহর ওপর ভরসা করেই বাইরে যাই। আমি মাঝেমধ্যে ফজরের নামাজের পর দৌড়াতে যাই। গিয়ে দেখি আরও মানুষ ব্যায়ামের জন্য অলরেডি পার্কে। তো স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে উদ্ভাসিত (এক্সপোজ) করে ফেলি। একটু–আধটু রিস্কের মধ্যেই প্রতিনিয়ত। এই করোনাভাইরাসের আক্রমণের পর যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের কাছে জীবনের সংজ্ঞা হয়তো অন্য কিছু হবে। হয়তো কেউ কেউ বলবে, জীবন মানেই মৃত্যুর কোলে বসে কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার একটু জ্বর জ্বর ভাব করলেই আমি আম্মাজানকে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলি। আমি যখন দূরে থাকতে বলি, তখন তিনি আরও কাছে চলে আসেন। তিনি ভয় পেয়ে যান। ভাবেন, সম্ভবত আমার জ্বর হয়েই গেল। আরও কাছে চলে আসেন। মাথায় হাত দিতে চান। আমি ভাবি, হায় রে মায়ের মন! কত ভালোবাসেন সন্তানদের! আমি চিন্তা করি আমার সন্তান অসুস্থ হলে কি আমি তেমনি রিয়েক্ট করব! আমার উত্তর হয় পজিটিভলি। মানুষ সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিতে চান। মানুষ বেঁচে থাকে তাঁদের সন্তানদের লালনপালন করতে। মানুষ মরার সময় চিন্তা করেন, তারপর তাঁর সন্তানদের কী হবে। ওপরের দিকে চেয়ে চেয়ে হয়তো দোয়া করে যায় যে সন্তানদের মহান রাব্বুল আলামিন যেন তাঁর অনুপস্থিতিতে লালনপালন করেন।

এই দুর্যোগে আমার পোস্ট যাঁরা দেখবেন, তাঁদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, প্রত্যেকেই আপনাদের মা–বাবার যথাসাধ্য সেবাশুশ্রূষা করবেন। এই করোনাভাইরাস সবাইকেই ধরছে, এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। কিন্তু বয়স্কদের জন্য বেশি ঝুঁকির কারণ। মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের মা–বাবাদের লম্বা হায়াত দান করুন, যেন তাঁরা আমাদের জন্য অনবরত দোয়া করে যান।