কোয়ারেন্টিন এবং হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

আমার মতে বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে একজন মানুষই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আর তিনি হচ্ছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদ। অবশ্য শুধু কথাসাহিত্যিক বললে ওনাকে খাটো করাই হবে। কারণ ওনার কালজয়ী সৃষ্টিগুলোর মধ্যে মাথা উঁচু করে আছে কিছু কালজয়ী নাটক যেগুলো আবার ওনার নিজেরই লেখা বইয়ের চিত্ররূপ। এ ছাড়া আছে ‘আগুনের পরশমণি’র মতো দুর্দান্ত চলচ্চিত্র। এ ছাড়াও উনি নিজের চলচ্চিত্রের প্রয়োজনেই আবার লিখেছেন কিছু দুর্দান্ত জনপ্রিয় গান। এখনো ভরা পূর্ণিমার রাতে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা ওনার রচনা করা ‘আমার ভাঙা ঘরে’ গানটা বাজিয়ে ওনাকে স্মরণ করেন। মাত্র ৬৪ বছরের জীবনকালে উনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। তাই হয়তোবা তাঁর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে কিন্তু উনি এখনো মিশে আছেন বাংলাদেশের মানুষের রক্ত ও মানসে।

সত্যি কথা বলতে, হুমায়ূন আহমেদ একটি পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তাই ওনাকে নিয়ে এবং ওনার সৃষ্টিকে নিয়ে অনেক বেশি বেশি গবেষণা হওয়া দরকার কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি। আমরা ওনার সৃষ্টিকে নিয়ে গবেষণা না করে ওনার ব্যক্তিজীবন নিয়ে গবেষণা করতেই বরং বেশি পছন্দ করি। যা-ই হোক, করোনার এই দুর্বিষহ সময়ে হুমায়ূন আহমেদ কতখানি প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়ে আলোকপাত করার জন্যই আজকের লেখার অবতারণা।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখনী বাংলা সাহিত্যকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ যেমন কবিতার আগল ভেঙে কবিতাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্যকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। তথাকথিত সাহিত্যের ব্যাকরণ ভেঙে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সহজ ভাষায় বিবরণ দেওয়াতে সবাই সেগুলোকে অতি সহজেই আপন করে নিয়েছিল। জীবনানন্দ যেমন তাঁর জীবনকালে সমসাময়িক কবিদের রোষানলে পড়েছিলেন, তেমনি সমসাময়িক কথাসাহিত্যিকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদও। তবে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় শক্তি অগণিত পাঠক। একেকটা বইমেলাতে তাঁর বইয়ের একাধিক সংস্করণ বের হতো।

আমার মতে, হুমায়ূনের শিল্পকর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো শহরের সঙ্গে গ্রামের এবং ধনীর সঙ্গে গরিবের যোগসূত্র। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় শহর আর গ্রামের মধ্যে যোজন যোজন তফাৎ হোক সেটা চালচলনে, পোশাকে, মানসিকতায় বা জীবনযাত্রায়। হুমায়ূন আহমেদের শিল্পকর্মে শহর এবং গ্রামের সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর শিল্পকর্মের সংস্পর্শে এসে একজন শহুরে মানুষ যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, ঠিক তেমনি একজন গ্রামের মানুষও ভাববেন যে সেখানে তার কথাই তুলে ধরা হয়েছে। একইভাবে এসেছে রাস্তার খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে ভিক্ষুক কিংবা শহরে আসা উদ্বাস্তু প্রকৃতির নতুন মানুষ। উনি এসব মানুষের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরেছেন যাতে করে আপনার মনে কখনো ওই সব অচ্ছুত মানুষের জন্য করুণা হবে না বরং মনে হবে এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। সামান্যতে খুশি হওয়ার মন্ত্র আপনি এখান থেকেই পেতে পারেন। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জীবনযুদ্ধের বাস্তব গল্পই হুমায়ূনের শিল্পের প্রধান উপজীব্য।

হুমায়ূনের শিল্পকর্মে বাংলাদেশের প্রকৃতির নিপুণ ছবি আঁকা হয়েছে। বাংলাদেশের ষড়ঋতু এসেছে স্বমহিমায়। তেলচিটচিটে গরম, বর্ষার ভ্যাপসা গরমে প্রশান্তির বৃষ্টি, শরতের কাশফুল, হেমন্তের পাকা ধান, শীতের নানান রকমের পিঠা, বসন্তের ফুলরাজি সবই এসেছে ওনার শিল্পকর্মে। এ ছাড়া এসেছে বাংলাদেশের নদ-নদী, ফুল-ফল ও গাছ-গাছালি। বাংলাদেশের মানুষের জীবন যে প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটাই বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ওনার শিল্পকর্মে। আর দুটো বিষয়কে উনি একেবারে মহিমান্বিত করে ফেলছেন, একটা হলো বর্ষার কদম ফুল আর পূর্ণিমা রাত্রে জ্যোৎস্নাবিলাস। অন্য লেখকও হয়তোবা এসব বিষয় তাঁদের লেখায় এনেছেন কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এগুলোকে শুধু তাঁর লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং সেগুলোকে বাস্তব জীবনে কীভাবে উপভোগ করতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিয়েছেন সেলুলয়েডের ফিতায়। বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ হওয়াতে তাঁর সৃষ্টির সবকিছুতেই ছিল প্রতিভার স্বাক্ষর।

হুমায়ূন আহমেদের শিল্পে আবহমান গ্রামবাংলার ভাষারীতি এবং লোকাচার এসেছে স্বমহিমায়। গ্রামের মানুষের ভাষারীতি কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই উনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের সকালবেলা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া আবার বিকেলে সেই প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে আসার বিষয়টা দেখিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষে মানুষে বন্ধনটা কেমন হওয়া উচিত। আর লোকাচারের কথা বলতে গিয়ে লেটো গান থেকে শুরু করে লোকগীতি, লোকগান সবকিছুকেই তুলে এনেছেন। সেটা করতে গিয়ে নিজেই লিখে ফেলেছেন কিছু সুন্দর গান। যেগুলো আসলে আধুনিক এবং লোকগানের একটা সুন্দর মিশেল। তাই এই গান শহর এবং গ্রামে, শিক্ষিত থেকে শুরু করে অশিক্ষিত সবার কাছে সমান আবেদন তৈরি করেছে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের শিল্পের যে বৈশিষ্ট্য ওনাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে সেটা হলো সবকিছু নিয়ে ওনার ব্যঙ্গ (সার্কাজম) করার এক অবিশ্বাসী ক্ষমতা। অনেকেই বলে থাকেন হুমায়ূনের শিল্পে কোনো শিক্ষণীয় বিষয় নেই, পুরোটাই সস্তা মজার বিষয়। তাঁরা আসলে ধরতেই পারেননি বাংলাদেশের মানুষকে লাঠি বা বেতের বাড়ি দিয়ে শেখানোর চেয়ে মজা করে বোঝানো অনেক সহজ এবং ফলপ্রসূ। আর সবকিছু নিয়ে ব্যঙ্গ করার বা জীবনে সবকিছুকে সহজভাবে নিতে পারলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ওনার লেখার আরও একটা বিষয় লক্ষণীয় সেটা হলো শিক্ষা। উনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে স্বশিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং বাস্তববোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড’ নাটকের একটা দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে সেটা হলো সবাই যখন ডিগ্রি হাতে নিয়ে দৌড় দিচ্ছেন তখন ডিগ্রির কাগজগুলো পুকুরের পানিতে ভাসছে।

হঠাৎ করে হ‌ুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কেন লিখতে বসলাম দুঃস্বপ্নের এ সময়ে? করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে চলছে লকডাউন। বাংলাদেশ সরকারও ছুটি ঘোষণা করেছে। যা-ই হোক, বিশ্বব্যাপী এ লকডাউনের সময়ে সারা বিশ্বের ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশিদের কাছে আবারও হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর সৃষ্টি স্বমহিমায় হাজির হয়েছে। বাসায় বসে থেকে সবাই বিরক্ত না হয়ে অনেকেই শুরু করেছেন ওনার রচনা ও পরিচালনার সব নাটক দেখা আবার কেউবা টার্গেট নিয়েছেন এই লকডাউনে ওনার সব চলচ্চিত্র দেখে শেষ করবেন আবার অনেকেই ওনার রচিত উপন্যাস পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আমরাও ওনার তৈরি নাটক দেখার টার্গেট নিয়েছি এবং সেই মোতাবেক দেখা শুরু করে দিয়েছি। ওনার তৈরি প্রায় সব নাটক এবং চলচ্চিত্রই এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যেই বহুবার দেখা হয়েছে।

আমরা শুরু করেছি ‘বহুব্রীহি’ নাটক দিয়ে। ‘বহুব্রীহি’ দেখতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কাছ থেকে জানলাম তারাও হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখা শুরু করেছেন। বন্ধু রিজভী বললেন, ‘আমি সবে শেষ করেছি এরপর শুরু করব “নক্ষত্রের রাত”।’ কানাডা থেকে বড় ভাই গোলাম রাব্বি বললেন, ‘আমি সবেমাত্র শেষ করেছি তাই অন্য নাটক আর ভালো লাগছে না। আমরাও ভাবছি “বহুব্রীহি” শেষ করে “আজ রবিবার” তারপর “নক্ষত্রের রাত” রিভিশন দেব। আর সবশেষে আবারও দেখব “কোথাও কেউ নেই”। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে লকডাউনের এ সময়ে ঘরের মধ্যে রাখার জন্য বিটিভিতে আবারও “কোথাও কেউ নেই” দেখানো শুরু করেছে। এই উদ্যোগকে সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছে।’

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো সবার জন্য আনন্দের না অনেকের জন্যই এটা জীবন-মরণের সংগ্রাম হয়ে দেখা দিয়েছে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে বাসায় বসে আছে। একলা সরকার আর কতজনকে সাহায্য করবে। তাই ব্যক্তি এবং সামষ্টিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তবুও বহু মানুষ এই সাহায্য সহায়তার বাইরে থেকে যাবেন, কারণ তাঁরা কারও কাছে হাত পাততে লজ্জা পান কিন্তু ক্ষুধা তো আর লজ্জা পাবে না। তাই হয়তো আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে শেষমেশ কারও না কারও কাছে হাত পাতবেন। ক্ষুধার উপলব্ধি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কিছু চিরন্তন উক্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। ‘বহুব্রীহি’তে মামা ফরিদ রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলে তার প্রতি ভালোবাসাবশত বাসার কাজে সাহায্যকারী ছেলে কাদেরও বের হয়ে যায়। তারপর একসময় তাদের টাকা ফুরিয়ে যায় এবং তারা শুধু পাউরুটি এবং চিনি খেয়ে থাকেন।
এ সময় মামা বলেন, ‘চিনি দিয়ে রুটি জিনিসটা তো মন্দ নয়রে কাদের।’
কাদের বলেন, ‘আসল জিনিস হচ্ছে মামা পেটের খিদা, পেটে খিদা থাকলে সবই মজা লাগে।’
মামা বলেন, ‘নগরের এক প্রান্তে প্রচুর ডিনার কিন্তু ক্ষিধে নেই আর অপর প্রান্তে প্রচুর ক্ষিধে কিন্তু ডিনার নেই।’

‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে পাইপের মধ্যে বসবাসকারী চাল-চুলোহীন পরিবারটির কর্তা বাবা সামান্য সুধো ভাত শুকনা মরিচ দিয়ে খেতে খেতে তাঁর মেয়েদের বলেন, ‘বিসমিল্লাহ বইলা খাও, বিসমিল্লাহ বইলা না খাইলে পেট ভরে না। দুইটা খাদ্য হইলো পৃথিবীর সেরা, একটা হইলো ভাত অন্যটা কী?’ তখন সবচেয়ে ছোট মেয়েটা চিৎকার করে বলে উঠে, ‘ডিমভাজি।’ উত্তরে বাবা বলেন, ‘হয় নাই, পানি। ইংরাজি হইলো ওয়াটার। দুনিয়ার ব্যাবাক মজা হইলো ভাতে আর পানিতে।’

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এর চেয়ে সত্য কথা হয়তোবা আর নেই। ক্ষুধায় সবচেয়ে বড় সত্য আর সেই ক্ষুধার তাড়নায় দুমুঠো ভাত আর এক ঢোক পানির আশায় বহু মানুষ বেঁচে থাকে। তাদের কাছে দুনিয়ার আর কোনো সৌন্দর্যই চোখে পড়ে না। তবে তাদের জীবনেও প্রকৃতির নিয়মে আসে শীত, গরম এবং বর্ষা, আসে পূর্ণিমা এবং অমাবস্যা। গতকালও ছিল ভরা পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার আলোয় পৃথিবী এক মায়াময় পরিবেশ পেয়েছিল যেখানে ক্ষুধা নেই, নেই ভাতের জ্বালা। আমিও মনে মনে হুমায়ূন আহমেদের মতোই একটা সাধারণ স্বপ্ন দেখি, করোনার এই মহামারির কালে যেন বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর মানুষ যে দুবেলা-দুমুঠো খেতে পায়, কারণ এখন তাদের কোনো কর্ম নেই তাই ভাতের জোগানও মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আসুন আমরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়াই। হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিনের একটা গানের ভাষায়,

‘মানুষ ধরো মানুষ ভজ শোন বলিরে পাগল মন।
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।’