হোম কোয়ারন্টিনে অলস দিনে

এই রকম একটা দিনের কথা কখনো ভাবা হয়নি। হোম কোয়ারেন্টিনে অলস সময়। নিত্যদিনের কার্যসূচি বলতে কিছুই নেই। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়ার তাড়া নেই। বিন্দুমাত্র কাজের ছাপ নেই। রাশ আওয়ার ট্রাফিকের কোনো ব্যস্ততা নেই। মর্নিং ওয়াকে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের কোনো আনাগোনা নেই। গৃহিণীর শপিংয়ের কোনো আবদার নেই। ভাইরাস প্যান্ডেমিকের কারণে চারদিকে সুনসান নীরবতা। ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সকালে কাচের জানালায় বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি, ঝলমল রোদের খেলা। সামনের সবুজ লনে টিউলিপগুলো নতুন রঙে ফুটে উঠেছে। কাশফুলগুলো সত্যি অপূর্ব লাগছে। গাছে গাছে বসন্তের নতুন কুঁড়ি লাল নীল সবুজ। তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। মেঘের কোনো আনাগোনা নেই। চমৎকার এক আবহাওয়া। শীতের দেশে এ রকম একটা দিন মানে মহোৎসব। সাদা ধবধবে মানুষগুলোর সল্প বস্ত্রে ছোটাছুটি চোখে পড়ার মতো। আশ্চর্য হওয়ার কথা এমন কিছুই আজ চোখে পড়ে না। করোনা সবার মনে এক অজানা ভয় কাজ করে।
জরুরি পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে হোম কোয়ারেন্টিনে চার দেয়ালে বন্দী সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ। এই বন্দিদশা কত যে ভয়ানক, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সবচেয়ে কঠিন অবস্থা যাঁদের বাচ্চা আছে। থাকা–খাওয়ার চিন্তা না থাকলেও, মানুষের মাঝে এক অনিশ্চয়তা কাজ করে। কী হচ্ছে? কী হবে? এই সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি এবং শেষ কোথায়?
ব্রেকফাস্ট করে টিভির সামনে দুনিয়ার খবর নিয়ে বসি। বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরা লাইভ লিড নিউজ। ইউটিউবের কল্যাণে বাংলা টিভি নিউজে দেশের খবরাখবর আপডেট নিই প্রতিমুহূর্তে। আমরা প্রবাসীরা দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে সব সময় ভাবি। হয়তোবা দেশ থেকে সহস্র যোজন দূরে আছি বলে। অনিয়মে স্বভাবত আপসেট হই। আবার কল্যাণে উচ্ছ্বসিত হই। অনলাইন পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলো অসংখ্যবার ক্লিক করা হয়। তা ছাড়া মানবজমিন, ইত্তেফাক, পোটাল নিউজ—কোনো কিছুই বাদ যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ার হযবরল নিউজ অন্যতম।
দুপুরে আমার মেয়ে বলল,
ড্যাডি, আই নিড আ পিই (ফিজিক্যাল এডুকেশন) পার্টনার
ওকে
লেটস স্টার্ট, ফ্রক জাম্প টেন টাইম।
অনভ্যস্ত হওয়ায় টেনে টেনে দশটা ফ্রক জাম্প করা হলো।
এবার রানিং অন দ্য স্পট
আমি কি পারব
কাম অন ইজ নট হার্ড
ওকে, লেটস ট্রাই
এরপর জগিং অন দ্য স্পট
কাহিল অবস্থা
আর পারব না। টায়ার্ড।
ওকে, ইউ ফ্রি নাও
সময় যেন ফুরাতে চায় না। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি লাঞ্চ রেডি। আমরা বাপ ছেলে মেয়ে বউ একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ি। বাঙালি খাবার আলুভর্তা, ডাল আর শুঁটকি। ওয়াও ইয়ামি। যা আগে ব্যস্ততার কারণে হয়ে উঠত না। ছেলের ধারণা অচিরেই আমরা এ সংকট থেকে উতরাব। সায়েন্স বর্তমানে অনেক অ্যাডভান্স। প্রতিকূলতা অতিক্রম সময়ের ব্যাপার মাত্র। শত উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মাঝে মুখরিত ক্ষণিকের আড্ডা। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। স্বপ্নের ফানুস।
বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার জন্য কী করা যায়, ভাবছি। পিয়ানো শিখলে কেমন হয়? নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ব্যস্ত রাখা। হয়তোবা ভীমরতি। মেয়ের সাহায্য চাইলাম। আমার মেয়ে মহা উৎসাহ নিয়ে—
ওকে, আই উল টিচ ইউ
ক্যান ইউ টিচ মি ইজি ওয়ে?
ইট ইজ নট ইজি
ওকে
প্রথমে প্রপারলি পিয়ানোর সামনে বসা। সঠিকভাবে হাত রাখা। এবং সঠিকভাবে কি–বোড স্পর্শ করা।
একে একে মিউজিক্যাল নোট এবং নোটের সঙ্গে, কি–বোডের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করছে। মেয়েকে বললাম, কোনো রকমে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ শিখিয়ে দাও।
ড্যাডি, ইউ হ্যাব টু লার্ন বেসিক নোট ফার্স্ট
দ্যাটস লং ওয়ে
ইয়াহ
এভাবে চলে আমাদের হোম কোয়ান্টিনের দিনগুলো।
লকডাউনের দিনগুলোতে আমরা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। মহামারি এ সময়ে কোনো প্যানিক না করে কিংবা গুজবে কান না দিয়ে সরকারি নিয়ম–নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আপনিও ঘরে থাকুন। নিজেকে রক্ষা করুণ, অন্যকে রক্ষা করতে সাহায্য করুন।