থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-৩

বোনের নাগরিকত্বের সনদ নেওয়ার অনুষ্ঠানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
বোনের নাগরিকত্বের সনদ নেওয়ার অনুষ্ঠানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

আজ সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। সকাল হয়েছে কি না বুঝতে পারছিলাম না। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিলাম। সকাল আটটা বাজে। এই শহরে শীতের সকাল আটটায়ও সূর্যের দেখা মেলা ভার। এই শহরে শীতকাল শেষ হয়েও হয় না। সে কারণেই বেলা নয়টার আগে আলোর মুখ দেখা যায় না। শোবার ঘরে বিছানার দুপাশে কার্পেট ঘেঁষা লম্বা দুটো জানালা। জানালায় ভারী পর্দা টানানো আছে। সূর্যের আলো তেমন প্রখর না হলে ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকতে পারে না। আমি উঠেই প্রতিদিনই পর্দা সরিয়ে সকালের আকাশ দেখি। সকালের নরম রোদ যখন উঁকি মারে ঘরের দেয়ালে, আলোছায়ার খেলা করে, তখন ভীষণ ভালো লাগে। আলোর অন্য রকম মাধুর্য আছে, মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। আজ আর সে রকম হলো না। কারণ, শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। সকাল থেকেই গলাব্যথা, শুকনো কাশি আর ভীষণ দুর্বলতা নিয়ে ঘুম ভেঙেছে। মুখের ভেতরটাও তিতা হয়ে আছে।

আমার স্বামী এজাজ প্রতিদিনই খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে। এরপর সে দুকাপ চা বানায়। এক কাপ আমার চেস্ট অব ড্রয়ারে রাখে, অন্য কাপ সে নিজে খায়। এই চা পৃথিবীর জঘন্যতম চায়ের একটি। ঠেল ঠেলা দুধে পানসে, তেল তেলা চা। না হয় রং, না হয় স্বাদ। তবু আমি এই চা–ই আগ্রহ ভরে খাই। কেন?

প্রথমত বেচারা সকালে কষ্ট করে বানায়। তার এই কষ্টটাকে আমি সম্মান করি। দ্বিতীয়ত, প্রবাসে এক গ্লাস পানি ঠেলে খাওয়ানোর লোক নেই, তার ওপর আবার এক কাপ গরম চা। কে করবে? তৃতীয়ত, আর কিছু না হোক, আমার প্রতি তার কিছুটা হলেও মায়াও টের পাওয়া যায় এই চায়ে। আমার জন্য সে না বানালেও পারে। তার তেল তেলা চা খেতে খেতে বললাম, শরীরটা ভাল্লাগছেনা। শরীর ব্যথা, জ্বর জ্বর। আমি কি যাব শীলাদের সঙ্গে?
যাবে না কেন, না গেলে শীলা খোঁটা দেবে সারা জীবন।

কিন্তু আমার তো করোনা হয়েছে মনে হচ্ছে? আমি আড়চোখে তাকালাম ওর দিকে।
তুমি কি করোনাভাইরাস আক্রান্ত কারও সঙ্গে মিশেছ? দূরে দরজায় দাঁড়িয়ে সে বলল। সে কাল রাত থেকে বেশ দূরে দূরে থাকছে।
না, আমি তো আর জানি না। চায়নিজ বাচ্চাটা তো অসুস্থ ছিল কাল। আমি একটু ইতস্ততভাবেই বলি।

চায়নিজ বাচ্চা হলেই তার করোনা, তোমাকে কে বলেছে? সাসকাচুয়ান প্রভিন্সে এখনো কারওই করোনা ধরা পড়েনি। তাই তোমারও নেই, তুমি নিশ্চিত থাকো।

এজাজের কথায় যুক্তি আছে। এখন আমাদের প্রভিন্সে করোনার প্রকোপ নেই। স্কুল, অফিস, হসপিটাল—সবই স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। এমনকি নাগরিকত্ব সেরেমনিও আজ বাতিল হয়নি। শুধু দু শ মানুষের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আজ ছুটি নিয়েছি। আজ আমার ছোট বোন শীলার কানাডিয়ান নাগরিকত্বের সনদ নেওয়ার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে একজন বিচারক শপথবাক্য পাঠ করাবেন, জাতীয় সংগীত গাইবে সবাই, তারপর নাগরিকত্বের সনদ দেওয়া হবে সবাইকে। এই আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের পরই অভিবাসীরা সবাই কানাডার নাগরিক হয়। এর আগে নাগরিকত্ব পরীক্ষায় তাদের পাস করতে হয়। প্রত্যেক অভিবাসীর জন্যই এটি বিশেষ একটি দিন। কারণ, এই দিনেই ভোটাধিকারসহ কানাডিয়ান নাগরিকের সব অধিকার অর্জিত হয়।

কানাডার নাগরিকত্ব কেউ পেলে, অনুষ্ঠানে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সনদ দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
কানাডার নাগরিকত্ব কেউ পেলে, অনুষ্ঠানে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সনদ দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত

ডাউন টাউনের একেবারে মাঝে বিশাল বিল্ডিং। জায়গাটার নাম টিসিইউ প্লেস (TCU Place)। এখানে হলরুম ভাড়া করে বড় বড় অনুষ্ঠান করা হয়। শীলা আজ চমৎকার একটা শাড়ি পরেছে। তার ছেলেদের পরনে সুন্দর টি–শার্ট। অন্য সবাইও এখানে চমৎকার সাজে এসেছে। সবাই তাদের সবচেয়ে সুন্দর আর দামি পোশাক পরেই এসেছে এই অনুষ্ঠানে। আজ ওদের ভীষণ আনন্দের দিন। ওরা আজকের আনুষ্ঠানিকতার পর কানাডিয়ান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবে। উপস্থিত সবার মুখ খুশিতে ঝলমল। ভীষণ জমকালো অনুষ্ঠান। সেলফি তুলছে, ফটোসেশন করছে তারপরও কেমন যেন নীরবতা সবার মাঝে। কেউ হাঁচি, কাশি দিলেই সবাই তাকাচ্ছে বিরক্তি নিয়ে। যদিও করোনা ইউরোপে মরণ ছোবল হানছে, তবু কানাডিয়ানদের তেমন ভীত হওয়ার কারণ নেই, বিশেষ করে এই ছোট্ট শহরে। তবু সাবধান থাকা ভালো। আজ থেকে আমাদের প্রভিন্সের সরকার দু শ জনের বেশি লোকের সমাগম নিষেধ করেছে। তা ছাড়া প্রচলিত নিয়ম ভাঙা হলো, সনদ নেওয়ার সময় হাত মেলানো নিষেধ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত করোনা নিয়ে মজাই করছে এই শহরের মানুষেরা।

শীলার পাশের সিটেই একজন চায়নিজ বসেছে, তার মুখে মাস্ক। শীলা তখন থেকেই উসখুস করছিল
চায়নিজটা বসল তো বসল আমার পাশে। সে টেরাচোখে তাকাল তার পাশের সিটে।
অসুবিধা কী? আমি ফিসফিস করে বললাম।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেবে আমাকে।
যা, চায়নিজ হলেই করোনা ছড়ায়—কে বলেছে।
ওরাই তো জন্ম দিয়েছে এই ভাইরাস। এখন দুনিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এত ভয় পেলে চলে?
শীলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে বলল, কী হয়েছে তোর? মুখ-চোখ ফুলা?
আমি একটু কাশি দিলাম ওড়নাতে মুখ ঠেকে। শরীরটা ভালো লাগছে না, তোদের ওথ না হলে আসতাম না।
দেখিস আবার করোনা না তো?
না, কী যে বলিস, সাস্কাতুনে করোনা নাই, এখনো।

শীলা আড়চোখে চায়নিজটার দিকে তাকিয়ে বলল, বিশ্বাস নাই। আমার কপালটাই খারাপ, যেখানেই যাই আমার চারদিক দিয়ে শুধু চায়নিজ ঘোরে। কালকে ডাক্তারের কাছে গেছি, দেখি পাশের সিটে চায়নিজ।

শীলার মতো অনেকেই এখন চায়নিজ মানুষ, চায়নিজ জিনিস নিয়ে বেশ শঙ্কিত হয়ে আছে। কেউ প্রকাশ করছে, কেউ প্রকাশ করছে না। তবে কি চায়নিজরা অচ্ছুত জাতি হয়ে যাবে? তবে পৃথিবীর মানুষ এখনে তো অনেক মানবিক। সে কারণেই এখনো কেউ তাদের গালমন্দ করছে না। আমি চায়নিজদের অপছন্দ করি না, কিন্তু করোনা নিয়ে সে দেশের রাষ্ট্রনেতাদের লুকোচুরিও ভালো লাগছিল না। সেই কোন ডিসেম্বরে ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পারল, অথচ তারা সব গোপন করে গেল পুরো এক মাস। এটা একটা যুক্তিসংগত কথা হলো?

আমি হাসতে থাকলাম। গলাটা ভালোই ব্যথা করছে। মাথাটাও ভীষণ ব্যথা। চায়নিজ লোকটা বসে আছে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। সে কি আমাদের কথোপকথন বুঝতে পেরেছে? তার তো বাংলা বোঝার কথা না।

গলায় স্কার্ফটা আরেকটু ভালো করে পেঁচিয়ে নিলাম, আমার গলাটা খুশখুশ করছে। কাশি আসছে খুব, তবু ভয়ে কাশি আটকে রাখলাম। যদি লোকজন আমার দিকে তাকায় রেগে গিয়ে। সত্যিকারভাবে আমার করোনা হয়েছে? এ এক মুশকিল হলো দেখি। হাঁচি, কাশি কি আটকানো যায়? তবু আমি সত্যি সত্যি কেমন করে যেন আটকে রাখলাম। সামান্য হাঁচি, কাশিও যে ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ হবে কে জানত।

এখানে বেশ কিছু লোক মাস্ক পরে এসেছে। এক বাঙালি পরিবার মাস্ক পরেই ফটোসেশন করল। শীলা তো হেসেই শেষ। শহরের পুলিশ কমিশনার, আর বিচারকের সঙ্গে ফটোসেশন। ছবিটা স্মৃতি হয়ে থাকবে সারা জীবন। তখন তো এই মাস্ক পরা ছবিই থাকবে অ্যালবামের পাতায়।

আমি ধমক দিয়ে বললাম, এত হাসিস না, বেশি হাসলে কিন্তু বিপদ হয়। কথাটা আমার আম্মা বলত। মানুষ যখন সবকিছু বেশি করে, তখন বিপদ আসে।

কানাডার নাগরিকত্বের সনদ। ছবি: সংগৃহীত
কানাডার নাগরিকত্বের সনদ। ছবি: সংগৃহীত

শীলা সামনে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসতেই থাকল। আমারও হাসি এল। হাসি ভীষণ সংক্রামক। তখনো যদি জানতাম, এই হাসির সময় ফুরিয়ে আসছে শিগগিরই। আসলে মানুষ আগে থেকে সব জানতে পারলে জীবন অনেক সহজ হতে পারত, আবার অনেক বেশি ট্রেসফুলও হতো। তাই কী হবে পরের দিন, তা না জানাই হয়তো ভালো।

অনুষ্ঠানের শেষে সবাই মিলে এলাম স্টোন ব্রিজ টিম হর্টনে। টিম হর্টনটি রাস্তার পাশেই। এই আবাসিক এলাকার লোকজনই আসে এখানে। সকালের দিকে নাশতাও খায় এখানে অনেকে। ভালোই ভিড়। আমরা মোট ছয়জনের জন্য কোনো বড় টেবিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আরও দুটো চেয়ার টেনে সবাই গাদাগাদি করেই বসলাম। শাহীন বলল, ‘আপা, আমি আজ খাওয়াব।’

তাই? কিন্তু এত অল্প ট্রিটে তো হবে না, হেসে বললাম। আমার সঙ্গে সবাই হাসতে লাগল। কী চমৎকার সকাল দিয়েই শুরু হয়েছিল দিনটি। পারিবারিক আবহে ভুলে গেলাম কিছু সময়ের জন্য ভয়ংকর করোনাকে। সকালে কেউই ভালো করে নাশতা করেনি। সবাই নিজ নিজ পছন্দমতো খাবার অর্ডার করল। শাহীন শীলার স্বামী। হাসিখুশি ছেলে। আজ তাকে অনেক আনন্দিত লাগছিল।

আমাকে কফির কাপ এগিয়ে দিতে বলল, যা অবস্থা এজাজ ভাই, কেয়ার হোমের জন্য বেশি করে বাজার করে রাখেন।
আমিও শাহীনের সঙ্গে একমত হলাম, শাহীন তো ঠিকই বলেছে। কী যে হবে বোঝা যাচ্ছে না।
সে আমার দিকে তাকাল না।

সরাসরি শাহীনের দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর সুরে বলল, শাহীন শোন, এটা কানাডা। এখানে কখনো খাবারের অভাব হবে না। যদি সে রকম হয়, সরকার আগে থেকেই বলবে। বাজারে বাজারে ঘুরে খাবার স্টক করার মানে হয় না।
আমি কখনোই তার সঙ্গে একমত হই না। আজও হলাম না।

কণ্ঠে একটু ঝাঁজ নিয়েই বললাম, শোন, সে তো ঠিকই বলেছে। অন্তত যেসব খাবার স্টক করা যায়, যেমন পাস্তা, স্যুপের প্যাকেট, ফ্রোজেন ভেজিটেবল, ন্যাপকিন, টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার—এসব কিনতে পারো।
সে বলল, দেখা যাক সময় আসুক।
শাহীন হেসে বলল, অন্তত বাসার জন্য কিছু বাজার করে রাখেন। বাজারে সেদ্ধ চাল, মসুর ডাল উধাও।
তাই নাকি কী বল? মসুর ডাল ছাড়া তো তোমার এজাজ ভাইয়ের পেট ভরে না।
তাইলেই হইছে। মসুর ডাল কোথাও নেই।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কাল রাত থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই, আমাকে এক্ষুনি বাজারে যেতে হবে। কারণ, মসুর ডাল ছাড়া আমারও পেট ভরে না। খাবার প্লেটে একটু মসুর ডাল শুকনা মরিচ ভাজা দিয়ে, এক টুকরো লেবু ডলে খেলেই মনে হয় আহ্‌, শান্তি।
আপা, বসেন, কফিটা শেষ করেন।
না, শাহীন, শরীর খারাপ লাগছে, তারপর বাসায় বাজারও শেষ। একটু হোলসেলে যাই।
শীলা বলল, তাহলে আমাদের জন্য মসুর ডাল কিনিস তো।
আমি বললাম, ঠিক আছে। এজাজের দিকে তাকালাম, একটু কঠিন করেই বললাম,
তুমি যাবে? না হলে আমাকে বাসায় নামিয়ে দাও, আমি আমার গাড়ি নিয়ে যাব।
এজাজ আমার দিকে তাকিয়ে কী ভাবল—তারপর, একটু নরম সুরেই বলল, চলো।

গাড়িতে বসে কেউ কথা বলছি না। বেশ ঝাঁজালো রোদ উঠেছে। মধ্যদুপুর। বাসায় ফিরে দুপুরের ভাত খাওয়ার কথা। এজাজ ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। তাকে যেতে হচ্ছে এখন বাজার করতে। সে সামনের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। আমি তাকে পাত্তা দিলাম না। আমার শরীর এত খারাপ লাগছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি যদি একটা বিছানা পেতাম, তাহলে শুয়ে পড়তাম। বুঝতে পারছি না সামান্য ঠান্ডা কাশিতে কীভাবে এত কাবু হলাম। আর ভয় তো আছেই। চায়নিজ বাচ্চাটার ভাইরাসটা কি ফ্লু, না করোনা? যা আমাকে এমন দুর্বল করে দিচ্ছে? উহ্‌, ভাবতে পারছি না আর। ভীষণ রকমের মন খারাপ নিয়ে বরফ ঢাকা রাস্তায় তাকিয়ে থাকলাম। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে শরীরে, কী হচ্ছে মনে আর এই পৃথিবীতে। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ অস্থিরতা, ভীষণ অনিশ্চয়তায় বুকের ভেতর ভারী পাথর চেপে ধরেছে যেন।