বদ্ধ মাতাল

১ জানুয়ারি ১৯৯৬ সাল। আমার তৃতীয় সহোদর অনুজ খসরুর ঘটা করে বিয়ে হলো। সম্পন্ন হওয়া যে শেষ হওয়ার নয়, তা টের পেতে লাগলাম। বউ ভাতা, বিয়াই ভাতা, দুই পক্ষের নিকট আত্মীয়স্বজনের পুরো পরিবারের (একান্নবর্তী পরিবার বলে) মেগা সিরিয়াল দাওয়াত চলছিল। ১৫ জানুয়ারি তেমনি একটা দাওয়াত শেষ করে মধ্য রাত্রিতে সবাই বাসায় ফিরলাম। বিরামহীন ভূরিভোজনে পরিবারের সবাই পরিশ্রান্ত‌। আমার স্ত্রী ইমা আমাদের তিন ও দেড় বছরের দুই শিশু মেয়ে ফাবিহা ও আরিফাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর আমি খাটের পাশে ফ্লোরে পাতানো বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

ওই সময়ে রাজনৈতিক ঘোলাটে আবহাওয়ার কারণে দেশে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি ইত্যাদি বাড়তে লাগল। আর পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন ডাকাতির রোমহর্ষ ঘটনার বর্ণনা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চাপা পড়ে যেতে লাগল।

১৬ জানুয়ারির গভীর রাত। হঠাৎ মনে হলো কারা যেন আমাকে ঘুম থেকে তুলে বসানোর জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি ক্লান্ত থাকার কারণে আবার শুয়ে পড়ছি। এবার মনে হলো আমাকে বসিয়ে পেছনে হাত দুটিকে আড়মোড়া করে কেউ বেঁধে ফেললেন। এবার একটু দুচোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম দুজন কিশোর-যুবা লোক আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ডিমলাইটের আলোয় দেখলাম একটি লম্বা দা নিয়ে মাথার ওপর একজন ধরে আছে। আরও চার–পাঁচজন ডাকাত কিছু দেশীয় অস্ত্রসহকারে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার স্ত্রীর (ইমা) সঙ্গে কথোপকথন করছেন। ইমাকে জিজ্ঞেস করল আলমিরার চাবি কোথায়? ইমা বলল, আপনাদের আমি চাবি দেব, তবে আপনাদের সরদারকে ডেকে দেন। এরই মধ্যে একজন মধ্যবয়সী দাঁড়িওয়ালা সামনে এসে বলল, আমি সরদার ও হাজি সাহেব। তখনই ইমা বলল, আগে ওই ছোকরাগুলোকে আমার পাশ থেকে সরিয়ে দেন আর আমার স্বামীর মাথার ওপর থেকে দা–টা নামিয়ে ফেলতে বলেন। কথামতো ওই সরদার হাজি সাহেব (তিনি কিছুই হবে না বলে আমার স্ত্রীকে অভয় দিলেন) তাদের সরিয়ে দুজন বয়স্ক লোক দিলেন। ইমা ওদের চাবি দিয়ে আমাদের পাশের রুমে আলমারি আছে বললেন। আলমিরা থেকে ইমার গয়নাগাটি, কিছু নগদ টাকা, আমাদের দুজনের কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, গাড়ি বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা কোথায়? ইমা প্রতি উত্তরে বলল, আরেক রুমে আমার শাশুড়ি থাকেন। আর দেবরেরা ওপরের ফ্ল্যাটে থাকেন। গাড়ির ব্যবসা তাঁরাই করেন। তারপর ডাকাত সরদার হাজি সাহেব ইমাকে দিয়ে আমার আম্মাকে ডাকতে বলেন‌। আমার বাচ্চাদের আয়া অজিফা ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে চার–পাঁচজন সেখানে ঢুকে গেল‌। আম্মার আলমিরা থেকে আম্মার গয়নাগাটিসহ কিছু টাকা, আমার সদ্য বিবাহিত ভাইয়ের স্ত্রী রুশনীর বিয়ের গয়নাগাটি নেওয়ার পর পেয়ে গেল আমার লাইসেন্সকৃত রিভলবার আর আম্মার বন্দুকের কিছু কার্তুজ। এবার তো তারা মহাখুশি। বন্দুক কোথায় জিজ্ঞেস করাতে আম্মা বলল, আমার ছেলেরা দোতালায় রেখেছে। যদিও বন্দুকটি আম্মার আলমিরার গোপন স্থানে ছিল বিধায় তারা পায়নি। আশাতীত মালামাল পাওয়ায় ইমাকে সরদার সাহেব যাওয়ার সময় বললেন, আসসালামুআলাইকুম। আর ইমা প্রতি উত্তরে বলল, খোদা হাফেজ। উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে ইমা ও ডাকাত সরদারের এ কথোপকথন আমাদের পাড়ায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল।

ঘড়ির কাঁটা দেখলাম রাত প্রায় ৩টা ৩০ মিনিটে। আস্তে আস্তে বের হয়ে দেখি আমাদের পাড়ার দুজন দারোয়ানকে আমাদের গ্যারেজে বেঁধে রেখেছে আর ওদের মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়ায় শুধু গোঙানির শব্দ পাচ্ছিলাম। ওই ডাকাতেরা প্রথমে দুই পাহারারত দারোয়ানদের বেঁধে আমার রুমের (নিচতলা রাস্তা–সংলগ্ন) ব্যালকনির গ্রিলের তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে। ভীষণ ক্লান্ত থাকায় ইমা রাতে দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছিল। আর ডাকাতেরা অনায়াসে রুমে ঢুকতে পেরেছিল। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের চট্টগ্রামের পার্সিভ্যাল হিল এলাকায় কখনো ডাকাতি সংঘটিত হয়নি।

দুজন সাবেক আইজি আমার মরহুম বাবা হারুনুর রশিদ চৌধুরীর বন্ধু ছিলেন বিধায় পুলিশ মহলে আমাদের বেশ সামাজিক জানাশোনা ছিল। আমি বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় (থানা সদর) মামলা করার পর পুলিশ প্রশাসন জোরেশোরে ডাকাত ও মালামাল উদ্ধারের খোঁজে নেমে পড়ল। যদি ওই সময় কোনো ডাকাত দল কোনো মেট্রোপলিটন থানায় ধরা পড়লে আমাদের খবর দিত। ওই সময়ে ধরা পড়া ডাকাতের সামনে আমাদের হাজির করানো হতো। এরই মধ্যে চার–পাঁচ থানায় ওই সময়ে ধরা পড়া ডাকাতদের সামনে আমাদের হাজির করানো হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতে (হাকিম ম্যানশন) ডাকাতিতে অংশ নেওয়া কোনো ডাকাতের সন্ধান আমরা পেলাম না।

৩০ জানুয়ারি এক রাতের অভিযানে সাত–আটজন ডাকাত কোতোয়ালি থানা–পুলিশ ধরে ফেলে। আর আমাদের খবর দেওয়া হলো। ডাকাতি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি, আমার স্ত্রী ইমা ও আমার বাচ্চাদের আয়া ওজিফাকে ডাকাতদের দেখানো হলো। একি, এই সাত-আটজন সবাই আমাদের বাসায় ডাকাতির সময় সরাসরি অংশগ্রহণ করা ডাকাত দল‌। মজার ব্যাপার হলো, ১৬ থেকে ১৭ বছরের এক ছোকরা ডাকাত আমার শার্ট পরা অবস্থায় ধরা পড়েছে। বহুল আলোচিত হাজি সাহেবও ধরা পড়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (এসআই) সিদ্দিকী। তিনি আবার আমাদের দেশের বাড়ির লোক ছিলেন। তাঁকে আমরা ডাকাত দলই আমাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছিল বলে চিহ্নিত করায় তিনি রাতে ডাকাত দলের সরদারকে নিয়ে জেরায় নেমে গেলেন।

সিদ্দিকী: কে তোমাদের এই বাড়িতে ডাকাতি করার সহযোগিতা করেছে?

ডাকাত সরদার: আমরা নিজেরাই করেছি।

সিদ্দিকী: পাঁচ লাখ টাকার গাড়ি বিক্রির সংবাদ কীভাবে পেলেন?

ডাকাত সরদার: দারোয়ানকে মারধর করে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, রাতে একজন আরেকজনকে বলতে শুনেছেন গাড়ি বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে (উল্লেখ্য আমার ছোট দুই ভাই খসরু ও অশ্রু রাস্তায় কথোপকথন করেছিল)।

সিদ্দিকী: তোরা গ্রিল ভেঙ্গে বাসায় ঢুকে পড়লে বাড়ির গৃহস্থ (আমি) বুঝতে পারেননি?

ডাকাত সরদার: স্যার কীভাবে বুঝবে? তিনি তো একটা ‘বদ্ধ মাতাল’!

সিদ্দিকী: কী বললি, তাঁর মতো একজন ভালো মানুষকে তুই বদ্ধ মাতাল বললি?

ডাকাত সরদার: স্যার, আপনি যতই ভালো মানুষ বলেন না কেন, তিনি ছিলেন একটা বদ্ধ মাতাল।

সিদ্দিকী: তুই কী করে বুঝলি তিনি বদ্ধ মাতাল?

ডাকাত সরদার: আমার সাথিরা তাকে বিছানা থেকে তুলল। তিনি আবার ঘুমিয়ে গেলেন। দ্বিতীয়বার তুলল, আবারও শুয়ে পড়ল। এবার পিছমোড়া করে বাঁধার পরও তাঁর ঘুম ভাঙাতে পারিনি। এরই মধ্যে সন্তানদের কান্নায় ঘুম ভাঙল। স্যার আপনিই বলেন, মানুষটা কীভাবে ভালো মানুষ হয়? তিনি তো একটা ‘বদ্ধ মাতাল...।’

পাদটীকা: উল্লেখ্য, আমি জীবনে কখনো মদ পান করিনি। এই ঘটনা শুনে আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধু মহলে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া আমি বরাবরই ঘুমকাতুরে ছিলাম। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বিয়ের অনুষ্ঠানের ঝামেলা সামাল দিতে গিয়ে ক্লান্তিকর সময় অতিবাহিত করতে ছিলাম বিধায় ‘বদ্ধ মাতালের’ গ্লানি নিতে হয়েছে।