মেঘ একদিন সরে যায়

মেঘ কেটে যাবে, সবাই মিলে আবার খুব হাসব একদিন। ছবি: প্রতীকী
মেঘ কেটে যাবে, সবাই মিলে আবার খুব হাসব একদিন। ছবি: প্রতীকী

মার্ক স্মিড আমার পাড়ার লোক। মিউনিখে যে বাড়িটায় থাকি, তার দোতলায় থাকেন মার্ক। বয়স সাতাশ থেকে সাঁইত্রিশ—যেকোনো কিছু হতে পারে। চুলগুলো এক পাশে কদম ছাঁট, আরেক পাশ ইচ্ছেমতো বড় হয়ে কাঁধ ছুঁয়েছে। হাতে-পায়ে উল্কির উঁকিঝুঁকিও আছে। বাঁ কানে দুল। শীত-গ্রীষ্মনির্বিশেষে নীল-গোলাপি মাফলার গলায় প্যাঁচানো। সব মিলিয়ে বেশ একটা হিপ্পি হিপ্পি ভাব। তবে দেখা হলে মাথা নুইয়ে ফিক করে একটা ছেলেমানুষি হাসি দেয়। অদ্ভুতুড়ে বেশভূষা তখন আর কড়া হয়ে চোখে লাগে না। পড়শি হিসেবে মার্ককে আমরা পছন্দই করি।

তো, মার্ক একটা রিকশা কিনেছে। সবুজ রঙের ঝাঁ–চকচকে রিকশা। তার গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে আমাদের সেকেন্ডহ্যান্ড কালো ফক্সওয়াগনটা রাখতাম। রিকশার হঠাৎ আগমনে আরেকটা গ্যারেজ ম্যানেজ করে গাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। বিনা নোটিশে তিন চাকার এই পঙ্খিরাজ কিনে বিপদে ফেলায় মার্ক দুই মাসের ভাড়া নিল না তো নিলই না।

কিন্তু বরাত খারাপ। ক্রিং ক্রিং রিকশা দাপিয়ে শহর ঘুরে বেড়ানো আপাতত হচ্ছে না মার্কের। করোনাভাইরাসের বিষম গ্যাঁড়াকলে পড়ে মিউনিখ শহরজুড়ে ঘোর লকডাউন চলছে। গমগমে শহরে ভুতুড়ে সুনসান। গাড়িঘোড়া সব হাতে গোনা যায়। শখের নতুন রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামলে বেরসিক জার্মান পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খাবার আশঙ্কা আছে। তবে সাইকেল নিয়ে বেরোলে এখনো কিছু বলছে না। বেচারা মার্ক তাই হতাশ চেহারায় সাইকেলের তালা খুলে কই যেন বেরিয়ে পড়ে প্রায় সকালেই। তাজা হাওয়ায় এক-দুই পাক ঘুরে এসে আবার ঘরে সেঁধিয়ে যায় বাধ্য ছেলের মতো।

জানালার পাশে কফি হাতে একচিলতে রোদ পোহাতে পোহাতে মার্ক স্মিডের বেরিয়ে যাওয়া দেখছিলাম। চমৎকার রোদটা দেখে লোভ হচ্ছে। লম্বা একটা বিষণ্ন শীত পেরিয়ে এপ্রিলের কাঁধে চড়ে বসন্ত আসি আসি করছে। কিন্তু লাভ কী তাতে। করোনার মারণ থাবায় বসন্তও থমকে গেছে এবার। কফি মগ হাতে শাল জড়িয়ে উঠোনে নেমে এলাম।

যত্ন করে বানানো ছোট্ট স্পিলপ্লাৎজ শূন্য পড়ে আছে। এখানে প্রায় সব বাড়ির সামনে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ঘেরা এক ফালি বালুর খেলাঘর বা স্পিলপ্লাৎজ থাকে। শিশুরা খেলবে বলে। এখন আর বাচ্চারা তেমন বেরোয় না। নিজেই বড় শিশু সেজে নরম বালু মাড়িয়ে স্পিলপ্লাৎজের স্লিপারটায় চড়ে বসলাম। একেবারে উঁচু ধাপে বসেছি। দূরের আকাশ তাতে খানিকটা কাছে এগিয়ে এল বোধ হয়। রোদের তীব্রতায় অদ্ভুত মুক্তির আস্বাদ। কফির উষ্ণতা ছাপিয়ে কুসুম কুসুম মায়ায় মন ভরে উঠছে। ইশ্, পৃথিবীটা কত সুন্দর!

‘সাবরিনা! হাই!’ সংবিৎ ফিরে চমকে তাকালাম। ডরোথি ডাকছে। ডরোথিও দোতলায় থাকে। মার্ক স্মিডের পাশের ফ্ল্যাটে। সোনালি চুল অপূর্ব ভঙ্গিমায় কোমর অবধি লতিয়ে স্বর্ণলতা হয়ে নেমে এসেছে। কে বলবে এই মেয়ে পুরোদস্তুর পেশাদার ডাক্তার। মেয়েটা রূপকথার মৎস্যকুমারীর মতো সুন্দরী। তবে মোটা ফ্রেমের চশমাটা তার কমনীয় চেহারার সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না। বুঝতে পেরেই কি না, ডরোথি চশমা খুলে হাতে নিয়ে হালকা হাসল। তার সঙ্গে আমার দূরত্ব কয়েক মিটার। দূরত্বই যে এখনকার সামাজিকতা। আমি স্লিপারের টং থেকে ফিরতি হাসি দিয়ে বললাম, ‘ঘরে না থেকে বাইরে কই যাও?’ অপরাধ মেনে নিয়ে আবার হেসে জবাব দিল ডরোথি, ‘টুকটাক খাবার কিনতে যাই। ঘর খালি। তোমার কিছু লাগলে বলো। কলবেল চেপে দোরগোড়ায় রেখে যাব।’ এই দুর্দিনে এটুকুই–বা কে কাকে বলে। কিছুই লাগবে না আপাতত। তাই মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে না করে দিলাম। সেও বেণি দুলিয়ে পা চালাল।

ডরোথিকে কাছ থেকে দেখছি বছরখানেকের বেশি হবে। একাই থাকে। কোনোকালেও তার বন্ধুবান্ধব দেখিনি। অবশ্য বছরখানেক আগে কোত্থেকে এক ছোকরা ফুলের তোড়া হাতে উদয় হয়ে উঠানের বেঞ্চিটায় পুরোটা বিকেল বসে ছিল। ডরোথির নাম ধরে বেশ ডাকাডাকি করেও ঠিক সুবিধে করতে পারেনি। সেই প্রথম, সেই শেষ।

ব্যাটে-বলে কিছু হচ্ছে না দেখে কিছুটা আফসোসই লাগে। এমন নিখুঁত রূপবতীর পাশে এলোমেলো কালো চুলের ছিপছিপে ধারালো চেহারার একটা বাদামি ছেলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। ডরোথি নিটোল লম্বাটে গরনের। ছেলেটাকে কমসে কম ছয় ফুটি তো হতেই হবে। কিন্তু হায়, লোকে ভাবে এক, আর হয় আরেক। তবে যা হয়েছে, তা–ও শুকরিয়া।

দরজায় টাঙানো একটা চিঠি পেলাম একদিন। ‘...আজকে বিকেলে আমার বাবা-মা আসবে। জানোই তো, আমাদের গ্রামটা মিউনিখ থেকে অনেক দূরে, জার্মানির আরেক মাথায়। ওরা প্লেনে করে আসছে। ওদিকে বলিভিয়া থেকে আমার বন্ধু রড্রিগো আসবে। রড্রিগোকে তো দেখেছ সেদিন, মনে আছে? ওর সঙ্গে তাদের এবার দেখা করিয়ে দেব। তোমার কাছে চাবিটা রেখে গেলাম। যে–ই আগে আসবে, প্লিজ কষ্ট করে তার হাতে দিয়ে দেবে। আজকে আমার লম্বা ডিউটি। কিছুতেই এড়ানো গেল না।—ইতি, ডরোথি।’

চিঠি হাতে সেদিন রড্রিগোটা কে, ঠিক মনে পড়ছিল না। স্মৃতি হাতড়ে লোকটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই মাঝবয়সী পানামা টুপিতে মাথা ঢাকা বাদামি একটা মুখ ভেসে উঠল। মাসখানেক আগে বাড়ির সামনে আসা-যাওয়ার পথে দেখা হয়েছিল। ডরোথি সলজ্জে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, ‘আমার বন্ধু, রড্রিগো’। নিজের তাড়াহুড়ায় ‘হ্যাঁ হুঁ’, ‘আচ্ছা, দারুণ তো’ জাতীয় কিছু একটা বলে বিদায় নিয়েছি। তো এই বন্ধু তাহলে সেই বন্ধু? বহুত আচ্ছা দেখছি। সেকালে, একালে, এমনকি করোনাকালেও টেকো লোকেরা কী অনায়াসেই না সুন্দরী মেয়েদের বাগিয়ে নিচ্ছে। কোথায় তার লাতিন মুলুকের বলিভিয়া আর কোথায় জার্মান মুলুকের বাভারিয়া। রড্রিগোর টাকের জোরে একেবারে তাক লেগে গিয়েছিল আমার।

রড্রিগো বোধ হয় বলিভিয়ার পাট চুকিয়ে একেবারে পাকাপোক্তভাবে মিউনিখে ডেরা বেঁধেছে। ডরোথির বাবা-মায়ের কাছে পরীক্ষা দিয়ে এ প্লাস পেয়ে ডরোথির সঙ্গেই আছে সে। তা–ও ভালো, নইলে এমন বিদঘুটে সময়ে মেয়েটা একা থাকত। যাক, একটা ব্যবস্থা হয়েছে। এই-সেই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরেকবার ক্রিং ক্রিং শব্দ কানে এল। মুখ তুলে দেখি, ফ্রাউ মায়ার এসে ঢুকছেন সাইকেলের ছাউনিতে।

শান্ত-সৌম্য চেহারার ফ্রাউ মায়ার পঁচাত্তর পেরিয়ে গেছেন। পুরো নাম বারবারা মায়ার। আমাকে বার কয়েক বলেছেন যেন তাকে বারবারা বলে ডাকি। লাভ হয়নি। স্লিপারের ওপর থেকেই ডাক দিলাম, ‘ফ্রাউ মায়ার, কেমন আছেন?’ অনেকটা দূরের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা হাত নাড়লেন অল্প হেসে।

দূর থেকেই জবাবদিহির সুরে বাজারের ঝোলাটা দেখিয়ে বললেন, ‘এক–আধবার না বেরোলে কি চলে?’ তার ঝোলা থেকে একটা নধর শসা, চারটা কলা আর এক আঁটি পেঁয়াজের পাতা মাথা বের করে আছে। কী মুশকিল, টঙে উঠে বসে আছি দেখে লোকে আমাকে চৌকিদার ভাবছি নাকি। অত্র এলাকার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আজকে দায়িত্বে আছে ফ্রাউ সাবরিনা। দূরত্ব বজায় না রাখলে উনি গরম কফি ছুড়ে মেরে একহাত দেখে নেবে।

কফি না ছুড়ে চওড়া একটা হাসি ছুড়লাম ফ্রাউ মায়ারের দিকে। জবাবে অবাক করে দিয়ে বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছোটখাটো মানুষটা। এই দীর্ঘশ্বাসের মানে আমি জানি। অনেকগুলো বছর জার্মানদের সঙ্গে উঠে–বসে এই ভাষা আমার খুব জানা। বহুকালের যুদ্ধবিগ্রহ দেখা এই জাতটার মন কিছুটা ইস্পাতকঠিন। বিপদে এরা মচকায় না, ভাঙেও না। তারপরও প্রতিদিনের বেড়ে চলা মৃত্যুর সারিটা ঠিকই মনকে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে দিয়ে যায়। ফ্রাউ মায়ার আপন মনেই বলল যেন, ‘পৃথিবীটা কেমন বদলে গেল, তাই না? জানো, আমরা কেউ ভাবিনি, সব এমন ওলটপালট হয়ে যাবে। পুঁচকে এক জীবাণুর কাছে আমরা বন্দী হয়ে যাব।’ কথার পিঠে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। চুপ করে থাকলাম। কোত্থেকে এক খণ্ড মেঘ এসে আকাশটা ঢেকে দিল হঠাৎ।

ভদ্রমহিলা ছাউনি ছেড়ে যাচ্ছেন না। কিছু একটা শুনতে চান। মেঘটা যেমন এসেছিল, তেমনি উধাও হয়ে গেল। চারদিক আবারও ঝকঝক করছে। আমিও সোজা হয়ে বসলাম। ‘ফ্রাউ মায়ার, মেঘ কেটে যাবে নিশ্চয়ই। কাটতেই হবে। আমরা সবাই মিলে আবার খুব হাসব একদিন।’ মনের জোরে ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি টেনে আনলাম। ফ্রাউ মায়ার সেদিকে না তাকিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া সূর্যটার পানে চেয়ে কী যেন লুকালেন। কিন্তু রোদের ঝিলিক তার চোখের কিনারার চিকচিক লুকাতে দিল কই। শুধু অস্ফুট স্বর শুনতে পেলাম, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন একজন।’

নীল আকাশে মেঘেদের ভিড়ে আমিও স্রষ্টাকে আকুল হয়ে খুঁজতে থাকলাম।

*লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, মিউনিখ, জার্মানি