করোনায় প্রবাসী প্রণোদনা প্যাকেজ যেমন হতে পারে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বিশ্বে এখন করোনা মহামারি চলছে, এতে জনজীবন বলতে গেলে একপ্রকার স্থবির। প্রায় সব দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ধনী দেশগুলো হয়তোবা এই অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো চরম অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বাংলাদেশে এই করোনা আঘাত হানার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতির চালনশক্তি হিসেবে পরিচিত খাতগুলো ঠিকিয়ে রাখতে একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পোশাক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, মাঝারি শিল্প ও ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঠিকিয়ে রাখতে ৭২ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য ঘোষণা করেছেন ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। যেখানে বিশ্বের অনেক ধনী দেশও এভাবে পরিকল্পনা করে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
নিঃসন্দেহে এসব আর্থিক প্যাকেজ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে দারুণ ভূমিকা পালন করবে, যদি তা সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় পৌঁছায়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দেশের একশ্রেণির মানুষ কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে না, যাঁদের জীবন এই মুহূর্তে করোনা আঘাতে লন্ডভন্ড, যাঁদের আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলে দাবি করি, যাঁরা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কারণ, যাঁরা বিদেশে কাজ করতে যান, তাঁদের অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
করোনার কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালিতে যাবতীয় অফিস–আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে বলতে গেলে বাংলাদেশি প্রবাসীরা এখন একপ্রকার বেকার। আমরা সবাই জানি যে যেসব বাংলাদেশি এসব দেশে কাজ করতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই গরিব ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তাঁদের অনেকেই সুদে বিভিন্নজন থেকে ঋণ নিয়ে বা জমি বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে প্রবাসে যান। আবার এই শ্রমিকদের একটা অংশ যায় ফ্রি ভিসায়, অর্থাৎ তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো জব নেই, কফিল–স্পনসর নেই, যেদিন–যখন যে কাজ পান, তা–ই করেন। করোনার কারণে যাবতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কাজকর্ম বন্ধ থাকায় চরম আর্থিক কষ্টে দিন পার করছেন দেশে এই প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলো। তার ওপর প্রবাসেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন অনেক প্রবাসী। অনেক প্রবাসী আছেন দেশে তাঁদের পরিবারকে দেখার মতো কেউ নেই। তাঁরাই একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি তাঁদের পরিবারের। এই মহামারি চলে যাওয়ার পর হয়তোবা অনেক প্রবাসী চাকরি হারাবেন, অর্থনেতিক মন্দার কারণে বেকার হয়ে যাবেন শত শত প্রবাসী।
তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁদের জন্য একটা অর্থনৈতিক সাহায্য ঘোষণা করা একান্ত প্রয়োজন। এই সাহায্যটা দুই ক্যাটাগরিতে হতে পারে। একটা হচ্ছে, যেসব প্রবাসী বিদেশে করোনার কারণে বেকার জীবন পার করছেন এবং দেশে তাঁদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। দ্বিতীয়ত, যাঁরা বিদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। তবে সব প্রবাসীকে এই প্যাকেজের আওতায় আনার দরকার নেই, শুধু যাঁরা শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধন করে বিদেশে গেছেন, যাঁরা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাতেন এবং তাঁদের পরিবার–পরিজনও বাংলাদেশেই আছে, তাঁদেরই এই আর্থিক সহযোগিতার আওতায় আনা যেতে পারে।
যাঁরা প্রবাসে আছেন, তাঁদের মধ্য থেকে উল্লিখিত ক্যাটাগরির পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন হবে না। আর যাঁরা বিদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাঁদের প্রতিটা পরিবারকে প্রয়োজন অনুযায়ী এককালীন একটা আর্থিক সহযোগিতা করলেও খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এতে এই পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তাদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে। অন্যথায়, এই পরিবারগুলো পড়ে যাবে অবৈধ সমুদ্রে, যার কোনো কূলকিনারা নেই।
তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ, এই প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি আপনি একটু দৃষ্টি দিন। আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন এই অসহায় পরিবারগুলোর প্রতি। আগেও যেমন প্রবাসী আয়ের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে আপনি প্রবাসীদের মন জয় করেছেন, তেমনিভাবে এবারও আপনার একটু সহযোগিতা হাজার হাজার প্রবাসী পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এতে এই পরিবারগুলো পাবে নতুন জীবন, নতুন প্রাণ।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, জেদ্দা, সৌদি আরব