অস্ট্রেলিয়ায় এবারের রমজান

অস্ট্রেলিয়ার আকাশে চাঁদের দেখা নেই। ছবি: লেখক
অস্ট্রেলিয়ার আকাশে চাঁদের দেখা নেই। ছবি: লেখক

বছর ঘুরে আমাদের মধ্যে ফিরে এল পবিত্র রমজান। সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য অন্যতম ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। আবহমান গ্রাম-বাংলায় রোজার শুরু থেকেই কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব কাজ করত। কারণ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসত মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। হয়তোবা এক মাস রোজা রাখার কারণেই ঈদুল ফিতর হতো অনেক বেশি আনন্দের। অবশ্য চাঁদ দেখে ঈদ করার দিন নির্ধারণ হতো, সেটাও উৎসবে বাড়তি আনন্দ ও উত্তেজনা যোগ করত।

রমজানের শুরুও হতো চাঁদ দেখে। চাঁদ দেখার জন্য গ্রামের সব মানুষ এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াত, যেখান থেকে পশ্চিমের আকাশটা পরিষ্কার দেখা যেত।

তখনকার দিনে গ্রাম-বাংলায় যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল পাড়ার রেডিওগুলো। আর গ্রামের একটা বা দুটো বাড়ির টেলিভিশন। চাঁদ দেখতে কোনোভাবে মানুষ ব্যর্থ হলে রেডিও আর টেলিভিশনের খবরের ওপর ভরসা করত। সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই জানিয়ে দেওয়া হতো চাঁদ দেখা গেছে কি না। চাঁদ দেখা যাওয়ার পর মানুষ দল বেঁধে মসজিদের দিকে যাওয়া শুরু করত তারাবিহর নামাজ পড়তে। সারা দিন রোজা রেখে প্রতিদিন তারাবিহর নামাজ পড়াটা ছিল শিশু-কিশোর এবং উঠতি বয়সের মানুষের জন্য পুনর্মিলনীর মতো। তারাবিহর নামাজ পড়া শেষ হলে প্রায় প্রতিদিনই ছোটখাটো আড্ডা দিয়ে আমরা বাসায় ফিরতাম। বেশি দেরি করার উপায় ছিল না, কারণ ভোররাতে উঠে আবার সাহরি খেতে হবে।

ভোররাতে তখনকার দিনে তো আর এত এত মোবাইলের প্রচলন ছিল না। তাই নিজের গরজেই কাউকে না কাউকে উঠতে হতো, তারপর তিনি আশপাশের মানুষকে ডেকে তুলতেন। গ্রামের মাতুব্বর শ্রেণির মানুষেরা তরুণ যুবাদের নিয়ে একটা দল গঠন করতেন, যাঁরা পাড়ার রাস্তায় হেঁটে হেঁটে মানুষকে ডেকে তুলতেন। মসজিদে ডাকাডাকির বাইরে এভাবে ডাকাডাকিটা খুবই ফলপ্রসূ ছিল। প্রতিটি বাড়ির সামনে হাজির হয়ে সেই বাড়ির সদস্যদের নাম ধরে একে একে ডাকা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত না ভেতর থেকে কেউ উত্তর নিচ্ছেন। অনেক এলাকায় মুখে ডাকার পাশাপাশি তেলের চারকোনা খালি টিন বাজিয়ে মানুষকে সাহরি খাওয়ার জন্য জাগানো হতো। এর বাইরে এক প্রতিবেশী উঠে অন্য প্রতিবেশীকে ডেকে দেওয়ারও চল ছিল।

দিন শেষে ইফতারির সময়টা ছিল খুবই আনন্দের। আসরের নামাজ পড়ার পর থেকেই সবাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করত ইফতারের। যাঁদের কোনো কাজ নেই তাঁরা গ্রামের বন বাদার থেকে পরিচিত ছোট গাছ কেটে মেসওয়াক বানিয়ে দাঁত মাজা শুরু করে দিতেন। মেসওয়াককে আমাদের এলাকায় দাঁতন নামেও ডাকা হতো। আর দাঁতনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল আশশেওড়াগাছের ডাল। আশশেওড়াগাছকে আমাদের এলাকায় ‘দাঁত ছোলা’ নামে ডাকা হয়। এই গাছের ডাল দিয়ে যেমন মেসওয়াক বানানো হয়, তেমনি এই গাছের সবুজ ফল পেকে গোলাপি বর্ণ ধারণ করলে আমরা ছোটরা তুলে খেতাম। খেতে যথেষ্ট মিষ্টি এই গাছের ফল। এই গাছের একটা হালকা গন্ধ আছে যেটা আপনি এই গাছের কাছে গেলেই নাকে অনুভব করতে শুরু করবেন।

চাঁদ দেখা, তারাবিহর নামাজ পড়া, সাহরি খাওয়া, রোজা রাখা এবং ইফতারের এই প্রাকৃতিক আনন্দগুলো শহুরে জীবনে অনেকটাই ফিকে। প্রবাস জীবনে সেটা আরও বেশি রংহীন প্রবাস জীবনে সময় এবং পরিবেশের তারতম্যের কারণে। উপরন্তু কাজ আর ছুটির হিসাবে মিল না থাকায় উৎসব পালন করাটাও কষ্টকর হয়ে যায়। আমি তবুও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই আনন্দের উপলক্ষগুলো তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাই প্রবাসের এই গতিময় জীবনেও চাঁদ দেখে রোজা রাখা, ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার মতো চল এখনো আমাদের পরিবারে আছে। এবারও যখন রমজানের চাঁদ দেখার সময় হয়ে গেল, মেয়ে তাহিয়াকে বলে রাখলাম চাঁদ দেখার জন্য। আমিও মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে রাখলাম অফিস থেকে চাঁদ দেখার জন্য।

আমি অফিসে এসে গুগল করে দেখলাম সেদিন চাঁদের মাত্র শতকরা শূন্য দশমিক ১ শতাংশ দেখা যাবে। সময় হিসাব করে দেখলাম, অফিসের নির্দিষ্ট সময়ের পর আরও প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমি তাই অফিসের কাজটা চালিয়ে নিলাম সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। এরপর বাইরে গিয়ে অফিসের রাস্তার তেমাথায় অপেক্ষা করতে থাকলাম, কারণ সেখান থেকে পশ্চিম আকাশের অনেকখানি পরিষ্কার দেখায় যায়। বাইরে বের হয়ে তেমাথায় পায়চারি করছিলাম আর তাহিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম তারা দেখতে পেয়েছে কি না। তাহিয়া বলল, তারাও দেখতে পায়নি। আমিও প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে হাঁটাহাঁটি করে বাসার দিকে রওনা দিলাম। ভাবলাম, পরের দিন অন্ততপক্ষে দেখা হবে চাঁদমামার সঙ্গে।

পরের দিনও একইভাবে অফিসের কাজ দেরিতে শেষ করে বাইরে চলে এসে কিছুক্ষণ তেমাথায় দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হলো, আরও একটু হেঁটে গিয়ে হ্রদের ধারে অপেক্ষা করলে মনে হয় চাঁদমামাকে দেখা গেলেও যেতে পারে। কারণ, ওখানে তেমন একটা গাছগাছালি নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। হ্রদের ধারে গিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোন দিকে তাকালে চাঁদমামাকে দেখা যাবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে গুগল করে কোণের মাপটাও দেখে নিলাম। এরপর একটা কম্পাসের অ্যাপ ইনস্টল করে নিলাম। কম্পাসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোণে তাকিয়েও চাঁদমামার দেখা পেলাম না। ঘণ্টাখানেক সময় সেখানে অতিবাহিত করলাম কিন্তু চাঁদমামা সেদিনও তার ভাগনের সঙ্গে দেখা করলেন না। আমার অবশ্য সন্ধ্যাটা দারুণ কাটল। একটা অদ্ভুত সুন্দর গোধূলির সাক্ষী হয়ে থাকলাম। হ্রদের পাশ দিয়ে সিডনির অন্যতম ব্যস্ত সড়ক এম-৫ চলে গেছে। তার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে গাড়িগুলো ছুটে চলেছে আর তাদের ছায়া পড়ছে হ্রদের পানিতে। দুটো পানকৌড়িকে দেখলাম হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটছে। আমি কয়েকটা ভিডিও আর বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম।

পঞ্জিকা অনুযায়ী সেদিন রাতে সাহরি খাওয়ার কথা। তাহিয়া আগেই বলে রেখেছিল, এবার থেকে সে রোজা রাখবে। আমাকে জিজ্ঞেসও করেছিল, ভোররাতে কখন তার আইপ্যাডে অ্যালার্ম সেট করবে। আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই আমাদের প্রথম রোজা রাখা হলো সাহরি না খেয়ে। অবশ্য তাহিয়া ক্ষুধার জন্য দুপুরেই খেয়ে ফেলল। আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই, তুমি কালকে আবার অর্ধেক রাখলে তোমার দুদিন মিলে একটা হয়ে যাবে। বিকেলবেলা শম্পা আপুদের বাসা থেকে একগাদা ইফতারি চলে এল। তাই আর আমাদের ইফতারি বানানোর ঝামেলায় যেতে হলো না। প্রথম রোজাতেই মানুষের উপহার দিয়ে ইফতার শুরু করাতে আমার মনে হলো এবারের রোজাটা ভালোই কাটবে। পরের দিন আর আমরা ভুল করলাম না। পরের দিন অ্যালার্ম বাজার পর সবার আগে আমি উঠে গিয়ে তাহিয়া আর ওর মাকে ডেকে দিলাম।

ভোররাতে আমার খাওয়ার অভ্যাস নেই তাই ওদের খাবার তৈরি করে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তাহিয়া যথারীতি তার খাবার শেষ করতে পারল না। আমি তাই বাধ্য হয়ে ওর খাবারটা খেয়ে নিলাম। আমাদের পরিবারে আমরা বাচ্চাদের সব সময়ই এটা বলি যে আমরা পৃথিবীর অনেক সৌভাগ্যবান মানুষ যে আমরা তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারছি। সমসাময়িক সময়ে ইয়েমেনে হাজারো মানুষ না খেয়ে আছে। সিরিয়ায় শত শত শরণার্থী অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। আমাদের পাত থেকে ভাত পড়ে গেলে আমরা সেটা উঠিয়ে খেয়ে নিই। আমাদের দেখাদেখি আমাদের ছেলে চার বছরের রায়ান ভাত কুড়িয়ে খেয়ে নেয়। আর যদি ওদের খাবার বেঁচে যায়, আমরা সেটা ফেলে না দিয়ে নিজেরা খেয়ে নিই।

পরের দিন বন্ধু আসাদের গিন্নি আমাদের জন্য একগাদা ইফতারি পাঠিয়ে দিলেন। ইফতারের আগে আগে আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ইফতারের সময় উঠে তাই মনে করেছিলাম যে হয়তোবা ইফতারের সময় হয়ে গেছে কিন্তু ইফতারের তখনো এক ঘণ্টা দেরি ছিল। আমরা সবাই প্লেটে ইফতারি সাজিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। পঞ্জিকার সময় অনুযায়ী ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই একসঙ্গে ইফতার করলাম। ছোট রায়ানও এসে আমাদের সঙ্গে একসময় যোগ দিল। ইফতার করার পরও ভাবির দেওয়া ইফতারি বেঁচে গেল। আমি সেগুলোকে র‌্যাপিং পেপারে মুড়ে ফ্রিজে দিয়ে দিলাম, যাতে পরে আবার খাওয়া যায়। এরই ফাঁকে ফাঁকে আমি আর তাহিয়া পালা করে বাইরে গিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু সেদিনও সফল হতে পারলাম না। এভাবেই চাঁদ না দেখেই দুটো রোজা আমরা করে ফেলছি।

আজ (২৬ এপ্রিল) রোজার তৃতীয় দিন। আজ অফিস খোলা। তাই আজ পরিকল্পনা করে রেখেছি অফিসে থেকে ফেরার সময় আবারও যথারীতি চাঁদ দেখার চেষ্টা করব। সকালে অফিস শুরুর পর আমরা দল বেঁধে কফি খাই আর চক্রাকারে একজন গিয়ে কফি নিয়ে আসি। আজও আমাদের সহকর্মী মিক কফি আনতে যাওয়ার আগে তালিকা করতে এসে জিজ্ঞেস করল, আমার কফি লাগবে কি না। আমি ওকে বললাম, আই এম ফাস্টিং। ও আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি। এরপর দুপুরের খাবার সময়ও আজ আমাকে ডাকতে আসেনি। অস্ট্রেলিয়ার বা বিদেশের জীবনযাপনের এটাই সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আপনি আপনার ধর্মমত স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবেন। কেউ আপনাকে ঘাঁটাতে আসবে না বা কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না। আমার এখনো মনে আছে, আমরা যখন অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম আসি তখন প্রায় প্রতি শনিবার সকালে রুটিন করে এক অস্ট্রেলীয় দম্পতি আসত অনেকটা আমাদের দেশের তাবলিগ জামাতের আদলে কিন্তু কোনো দিনও ধর্মের কথা বলেনি। ওরা যখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এসব ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম, তখন ওরাই আসা কমিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য মাঝে দুবার বাসা বদলানোর ফলে যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তা না হলে আমি নিশ্চিত ওরা এখনো এসে আমাদের কুশল জিজ্ঞেস করত। ওরা সব সময়ই একটা ব্যাপার বলে যেত, তোমাদের কিছু লাগলে অবশ্যই জানিও।

রোজার তিন দিন হয়ে গেল, কিন্তু চাঁদ দেখা হলো না। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা আছে। আজকেও দেরিতে অফিস শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এতে দুটো কাজ হবে। অফিস থেকেই ইফতার করে বের হতে পারব। আর পশ্চিম আকাশ পরিষ্কার থাকলে চাঁদমামার সঙ্গেও হয়তোবা দেখা হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যেই জানালা দিয়ে দেখে এলাম পশ্চিম আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। তার মানে আজও হয়তোবা চাঁদমামার সঙ্গে দেখা হবে না। আর কিছুক্ষণ পরই ইফতার।

রোজা থেকে অফিস করতে গিয়ে দুপুরের পর থেকেই মাথায় এক ধরনের ঝিমুনি অনুভব করছিলাম। নিজেদের জীবদ্দশায় বহুদিন এমন গেছে যে সারা দিনে হয়তোবা একবেলা খাবার জুটেছে আর বাকি দুবেলা উপোস থাকতে হয়েছে। আমি তাই জানি ক্ষুধার চেয়ে সত্য এই দুনিয়াতে জন্ম নেওয়ার পর আর কিছু নেই। জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে সারাক্ষণ ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে। রোজার এই শিক্ষা যেন আমাদের জীবনে বাস্তব হয়ে ফিরে আসে। করোনা মহামারির এই সময় পৃথিবীর বহু মানুষ কর্ম হারিয়ে না খেয়ে আছে। আমরা যেন আমাদের প্রত্যেকের সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এবারের রমজানে এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য। আসুন সবাই একসঙ্গে লড়ি, একসঙ্গে বাঁচি।