শিথিল হচ্ছে পার্থের লকডাউন, শঙ্কা কাটছে না

লকডাউন শিথিল হওয়ায় পার্থের কিছু কিছু রাস্তায় গাড়ির দেখা মেলে। ছবি: লেখক
লকডাউন শিথিল হওয়ায় পার্থের কিছু কিছু রাস্তায় গাড়ির দেখা মেলে। ছবি: লেখক

মন ভালো নেই, ভালো থাকার কথাও নয়। পৃথিবীজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের মৃত্যুর মিছিল চলছে, তখন মন অস্থির হওয়ারই কথা। খালি চোখে যাকে দেখতে পাওয়া যায় না, সে যেন অদৃশ্য শক্তির মতো আঘাত হেনেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। ইতিমধ্যে আড়াই লাখের বেশি মানুষ করোনাযুদ্ধে হেরে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। লাখো মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো হেরে যাবেন। অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণু কাঁপিয়ে দিয়েছে মানবসভ্যতার ভিত।

কদিন আগেও মনে হতো জীবন মানেই শুধু ছুটে চলা। এই অবিরাম চলার চাপে সময় ছিল না সময় নষ্ট করার সময়। জীবনের এই ব্যস্ত ছন্দ হঠাৎ থমকে গেছে। দেশে দেশে পূর্ণ আথবা আংশিক লকডাউন চলছে। রাস্তায় গাড়ি আছে খুব কম, পথচারী দু–একজন, আকাশে বিমান নেই। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সীমান্ত বন্ধ। এমনকি দেশের মধ্যেও এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যাচ্ছে না ইচ্ছা করলেই।

এমন এক ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ, কেউ এ রোগে মৃত্যুবরণ করলে তার প্রিয়জন কেউ কাছে যেতে পারছে না। হাসপাতাল বা নিজের ঘরের নিঃসঙ্গতায় চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন কত শত মানুষ। যেসব শহরে মৃত্যুহার অতিরিক্ত, তাদের শেষ আশ্রয় মিলছে গণকবরে।

একবার মনে হয়, এভাবে ঘরে থাকলে একদিন মানসিক রোগী হয়ে যাব, পরমুহূর্তে দুশ্চিন্তা ভর করে চাকরি চলে গেলে কী হবে এই ভেবে। আমি জানি, এটা শুধু আমার একার কাহিনি নয়—মানুষের জীবনের সব পরিকল্পনা যেন হঠাৎ থেমে গেছে। সভ্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে এখনো যে সুস্থভাবে বেঁচে আছি, সেটাই অনেক বড় পাওয়া। অসুস্থ না হওয়াটাই এখন সৌভাগ্য। সবকিছু ছাপিয়ে আছে শুধু অজানা আশঙ্কা—মৃত্যুভয়, প্রিয়জন হারানোর বিভীষিকা।

পার্থের অনেক রাস্তা এখনো ফাঁকা।
পার্থের অনেক রাস্তা এখনো ফাঁকা।

লকডাউনের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, বহু মানুষ কাজ হারিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন। দেশে দেশে সরকারপ্রধানেরা হিমশিম খাচ্ছেন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। সবচেয়ে ভীতির ব্যাপার হলো, এ অবস্থা কত দিন চলবে, সেটা কেউ জানে না। যেসব দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে এসেছে, তারা ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নিচ্ছে। কিন্তু শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের।

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে গত সপ্তাহে কিছু বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়, আসছে সপ্তাহে হয়তো আরও কিছু তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু এ কাজটি করা হচ্ছে খুবই সতর্কতার সঙ্গে—সামাজিক দূরত্বের (১.৫ মিটার) বিধিনিষেধ বজায় রেখে। মানুষ তাতেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে জনমনে শঙ্কা রয়েই গেছে।

লেখক
লেখক

এখানে (পার্থে) যেহেতু করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা শতকরা ১ ভাগের কম, লকডাউন তুলে নিলে ব্যাপকহারে সংক্রমণ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তো গত সপ্তাহে স্কুল খুলে দেওয়া হলেও বেশির ভাগ বাবা-মা সন্তানদের বাড়িতে রেখে অনলাইনে স্কুল করাচ্ছেন। এখানে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিরা এখনো কেউ কারও বাড়িতে যাতায়াত করছেন না। যত দিন না করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বাজারে আসছে, তত দিন কেউই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। চীনের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও যদি এ ভাইরাস আবার আক্রমণ করে, তাহলে কী হবে—এমন ভাবনা মন থেকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

মানুষ এখন নিজ নিজ নিঃসঙ্গ প্রান্তরে বসবাস করছে এবং অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এরপর যখন লকডাইন পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে, তখন জন্মদিনের পার্টি, শপিং সেন্টার, স্কুল বা কর্মক্ষেত্র—যেখানেই যাই, পাশের মানুষটির কাছাকাছি যেতে অস্বস্তি হবেই। অনেকটা সেই খাঁচার পাখির মতো।

‘বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।

খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি, আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’

সর্বোপরি প্রবাসী বাঙালিদের জন্য একটি বড় ভাবনা, বাংলাদেশে অবস্থানরত স্বজনদের পরিস্থিতি। পার্থের অবস্থা ভালো হলেও দেশে ফেলা অসা বাবা-মা, ভাইবোনেরা বাস করছেন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে। অথচ কোনো খারাপ খবর শুনলে ছুটে যাওয়ার উপায় নেই। শেষ সময়ে পরম নিকটজনের পাশে থাকতে পারার নিশ্চয়তা নেই। এ এক অদ্ভুত সময়—অস্থির মন, স্থবির বিশ্ব।