কোনো এক মাকে

ছোটবেলা থেকেই তারিন দেখে এসেছে, ওর মা–টা কেমন যেন। সারাক্ষণ মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকেন। বিরক্ত লাগত ওর। এত কিছুর দরকারটা কী? কখন খাবে, কী পছন্দ করে—সব আগে থেকে জানে রাখা বা জানার চেষ্টার কোনো শেষ নেই। 

শীতের কাপড়, গরমের কাপড় মাপমতো সব সে তৈরি রাখবে আগে থেকে। মন যদি আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো হয় তারিনের কখনো, বৃষ্টি নামি নামি করছে জেনে সঙ্গে সঙ্গে মা চলে আসবে টের পেয়ে কেমন করে যেন। অতিষ্ঠ করবে আদরে আদরে, যতক্ষণ মন ভালো না হয়। ওর আশপাশে আর কারও মা তো এমন না। অসুখ হলে তো কথাই নেই, মাথার কাছে বসে ঘুমাবে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তারপর যেন তার শান্তি।


এমন তো না যে কাজ করে না। একটা ব্যস্ত গ্রোসারি শপে শিফটে কাজ করে। কিন্তু কোনো ক্লান্তি নেই বাসায় এসে। বাজার করে নিয়ে আসবে সব সময়, এসে রান্না করবে আর তারিনকে দেখে সব সময় বলবে, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ সে’। আজব ব্যাপার, নিজের সবচেয়ে দামি কাপড় বা ব্যাগ বা গয়না যা কিছু হোক, চাইলেই দিয়ে দেবে ব্যবহারের জন্য। অন্য বন্ধুদের মায়ের মতো নষ্ট হলে কিছু বকাবকি করবে না।


একটু বড় হতেই তারিন বুঝে গেল ওর বাবা যা বলে, মন খারাপ হলেও মা মেনে নেয়। যেমন সংসার চালানোর টাকাপয়সা দেওয়া, রান্না করা, ঘর গোছানো ইত্যাদি। ভুলেও ওর বাবা সাহায্য করবে না। তারিন বুঝে গেল, ওর মা দুর্বল। টিনএজার হওয়ার পর থেকেই তাই তারিনও পাত্তা কম দিতে শুরু করল মাকে। পড়াশোনার ডেটলাইন পার হওয়ার আগে আগে বহু দিন ওর মা ওর পেছনে ঘুরত, ও করত সবকিছু মায়ের সাহায্য নিয়েই, কিন্তু প্রায়ই প্রাইভেসির নামে মাকে রুম থেকে বের করে দিত ইচ্ছে হলেই। হাইস্কুলে উঠে ছোট কাপড় পরতে বাধা, সন্ধ্যার পরে বন্ধুদের সঙ্গে হ্যাং আউট করতে বাধা শুনতে শুনতে ওর মনে হতো এই মহিলার হাত থেকে কবে সে রেহাই পাবে। ওর বাবা প্রায়ই এসব বিষয়ে অভিযোগ শুনে বলত, ‘মারে এই মহিলা আমার জীবনটাও শেষ করেছে।’ এই টুকটাক বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলি, সন্দেহপ্রবণ মহিলা শুধু নিষেধ করে। আমার জীবন বলে কি কিছু থাকবে না? বোরিং মহিলা কি জানে?'


হাইস্কুলে সিনিয়র হয়ে গেল তারিন। কলেজ অ্যাপ্লিকেশনের শেষ দিন এগিয়ে আসতে লাগল বিদ্যুৎ বেগে। মা পারলে নিজে শেষ করে অ্যাপ্লিকেশন এমন অবস্থা। যাক, অ্যাপ্লিকেশন শেষ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তারিন। নামাজ পড়ে বলে ঘ্যান ঘ্যান, অতিরিক্ত রাত জেগো না বলে প্যান প্যান, ঠিক সময়ে খাবার খাও বলে পিছে ঘুর ঘুর করায় কোনো ক্লান্তি থাকল না। তারপর একদিন আমার বাবা তার গার্লফ্রেন্ডের কথা বলার সময় মা শুনে ফেলল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে হাতে আঘাত পেয়ে কালো হয়ে যাওয়া ফরসা হাত ধরে অনেক কাঁদল। ভাবলাম কেন চলে যায় না এই বাসা থেকে? আমি আর বাবা বেঁচে যাই তার (মা) হাত থেকে।


তারপর একদিন নিজের মনে কাঁদছি, মা এসে অনেকক্ষণ বোঝাতে চাইল। বোঝে না কেন সে আমার প্রাইভেসি হ্যাম্পার হচ্ছে? চিৎকার করে বের করে দিলাম ‘এফ ইউ’ বলে। মা চলে গেল ঘর ছেড়ে। প্রথম দুই দিন বেশ খুশি হলাম। প্যান প্যান করার কেউ নেই। তারপর দেখি বাসায় খাবার তেমন কিছু নেই। বাবা রাতদিন তার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। একদিন শুনলাম সে বলছে বান্ধবীকে, ‘মহিলা চলে গেছে, মেয়েকে সঙ্গে দিয়ে দেব, চিন্তা করো না, তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি এই বাসায় আনব। মেয়েকে কোনো খরচই দেব না।’ ডিপ ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন সবজি একটু গরম করে খেতে গিয়ে ভাবলাম, ‘মা, তুমি কই মা?’ পরদিন মা ফিরে এল। এসেই গরম ভাত রেঁধে সবজি আর মাছ দিয়ে সামনে চলে গেল ওর রুমে। ক্ষুধায় অন্ধকার দেখছিলাম বলে খেয়ে ওর রুমে গিয়ে দেখি জায়নামাজে বসে সে দোয়া করছে, ‘আমার মেয়েটাকে আপনি মাফ করে দিন পরোওয়ার দেগার, ভালো কলেজে চান্স দিন, ওকে আপনার পথে রাখুন।’


একটুক্ষণ কথা বললাম মার সঙ্গে। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, সবাই কোনো না কোনো কলেজে চান্স পেয়েছে, জেনে গেছে কোথায় যাবে। আমি কোনো কিছু জানি না। কষ্ট হচ্ছে বুঝে মা নিয়ে গেল বাইরে খেতে। বোঝাল মেঘের পর রোদ্দুর আসবেই, চিন্তা করিস না। বাসায় ফিরে দেখি একটা কলেজে আমিও চান্স পেয়েছি। বাবা বলে দিল ‘সরকারি কলেজে পড়ো, এসব ফালতু খরচ কে টানবে?’ মা বাবাকে তেজি গলায় বলল, ‘সারা জীবন কষ্ট করে থেকেছি এ সংসারে, বাচ্চাদের শিক্ষা ফান্ডে কোনো টাকা তুমি জমাতে দাওনি, বলেছ দুজনে চাকরি করি, কোনো সমস্যা হবে না আর এখন বলছ টাকা দেবে না?’ বাবা মাকে চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলল।


অন্য রুমে ঝাপসা চোখে নতুন দুনিয়ার চিনতে শেখা আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল মা, ‘তারিন, চল বাইরে হাঁটতে যাব।’ আমি গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে চিরপরিচিত পার্কে এসে দোলনায় বসলাম দুজন। মায়ের চেহারা কেমন যেন জ্বলজ্বল করছে। আমার দুর্বল মাথা নিচু করে থাকা মায়ের আজ অন্য চেহারা। বলল, ‘তারিন তোমার পড়ার খরচ আমি দেব। বিনিময়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কখনো কাউকে এলাও করবে না তোমাকে ছোট করতে, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আমরা আর কাউকে ছোট করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। মানুষ সবাই সমান, ধনসম্পদ বা দারিদ্র্য দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করা হবে। আর মানুষের সেবা করবে যখন পারবে। আমার আদেশ এটা।’ বললাম, মা, আমি তো তোমারই মেয়ে, তুমি দোয়া করলে পারব না?

সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি করছে এখন, কিন্তু আমার জীবনের সূর্য আমার মা, কেমন পবিত্র আলো ছড়িয়ে চলেছে আজীবনের মতো এখনো। কান্নার দমকে বলতে চাইলাম, মা, আমি খুব স...রি। ছোট্ট চুমি কপালে দিয়ে বলল, ‘পাগলি, আমার জীবনের বেঁচে থাকার আনন্দ, তোর কোনো অপরাধ কি আমার কাছে আছে রে?’ পৃথিবীর এমন সব মা খুব ভালো থাকুক, পথ দেখাক আমার মতো তারিনকে।