বিলেতে বিশ্বকবি

হোটেলের ব্যালকনিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
হোটেলের ব্যালকনিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবি কখনো একা ভ্রমণ করতেন না, দলবল নিয়ে বিশাল বাক্সপেটরাসহ বেরিয়ে পড়তেন। সঙ্গে কবির বাঙালি পাঁচক বাসমতী চাল, ডালসহ যেমন থাকতেন, তেমনি থাকত উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার সমগ্রসহ এক মিনি লাইব্রেরি। কখন কবির কোন বইয়ের দরকার পড়ে, তাই মিনি লাইব্রেরি সব সময় হাতের কাছে রাখতেন। শত বছর পূর্বে জাহাজ আর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের যুগে কবি পাঁচটি মহাদেশের ৩৪টি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। কিছু দেশে একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে বিলেতে তিনি এসেছেন পাঁচবারের ওপরে।

এই বিশাল বহর নিয়ে বেড়ানোয় অনেক বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়েছে। লম্বা আলখাল্লা পরেই তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন। বিশাল আলখাল্লায় পকেট থাকলেও কবি কোনো টাকা নিয়ে ঘুরতেন না। উনার লেনদেন সব সামলাতেন উনার ছেলে। একবার লন্ডনের এক সভা শেষে একা ট্যাক্সিতে ফিরছিলেন কেনসিংটনে উনার হোটেলে, তখন খেয়াল হলো সঙ্গে তো টাকা নেই! আসন্ন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্য কবি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন দেখেন গন্তব্যে উনার অপেক্ষায় উনার ছাত্র দাঁড়িয়ে আছেন। গুরুদেব যে সঙ্গে টাকা রাখেন না, তা শিষ্যের অজানা ছিল না। তাই কিছু বলার আগেই ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে দেন।

ট্রেনে বিশাল মালপত্র নিয়ে বিশ্বকবি ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইতালি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ান সরকার কবির জন্য রেলে প্রাইভেট সেলুন কার যুক্ত করেছিল। একবার স্টকহোমে ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস কবিকে নেওয়ার জন্য ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। ভেনিসে একবার কবি সর্বোচ্চ ২৬টি লাগেজ নিয়ে চেক ইন করেছিলেন।

অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র। উনি ছবি আঁকতেন। তাঁর বন্ধু ছিলেন লন্ডনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। প্রাচ্যের সাহিত্য ও চিত্রকলায় বিশেষ আগ্রহী রোদেনস্টাইন এক বছরের মতো ভারতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেটা ১৯১০ সালের দিকে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কবির সঙ্গে রোদেনস্টাইনের দেখা হলেও তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। হতে পারে ছবি আঁকায় কবির আগ্রহ তখনো তেমন প্রকট ছিল না।

১৯১২ সালের দিকে রোদেনস্টাইন তখন লন্ডনে, কবির ইংরেজিতে অনূদিত এক গল্প চমৎকৃত করে তাঁকে। তিনি জোড়াসাঁকোয় চিঠি লেখেন আরও লেখা পাঠানোর জন্য। বোলপুরের এক শিক্ষকের অনূদিত কবির কিছু কবিতা আসে রোদেনস্টাইনের হাতে, কিন্তু তা ছিল প্রাণহীন। রোদেনস্টাইন যে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পূর্বের লেখায় পেয়েছিলেন, তা যেন অনুপস্থিত।

সঙ্গী–সাথিসহ লন্ডনে বিশ্বকবি।
সঙ্গী–সাথিসহ লন্ডনে বিশ্বকবি।

তখন লন্ডনে ছিলেন কোচবিহার রাজ পরিবারের প্রমত্তলাল সেন। সেখানে দেখা হয় লন্ডনে বেড়াতে আসা ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সঙ্গে। তাঁদের মাধ্যমে রোদেনস্টাইন কবিকে লন্ডনে আমন্ত্রণ করেন।

ব্যারিস্টারি পড়তে কবির প্রথম বিলেত আসা ১৮৭৮ সালে। ব্রাইটনে সাগরের তীরে মেডিনা ভিলা নামে ঠাকুর পরিবারের একটা বাড়িতে ওঠেন। কয়েক মাস সেখানে কাটালেও তরুণ কবির ভালো লাগছিল না। তাঁর মনে আঁকা ইংল্যান্ড হচ্ছে গল্প–কবিতার ইংল্যান্ড, গানের সুরের ইংল্যান্ড, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা ইংল্যান্ড। ব্রাইটনে এর কোনো মিলই পাচ্ছিলেন না কবি। পারিবারিক বন্ধু তারকনাথ পালিত তা অনুধাবন করেন এবং কবিকে লন্ডনে পাঠাতে তাগাদা দেন।

ব্রাইটন থেকে তাই লন্ডনের রিজেন্ট পার্কের কাছে এক বাড়িতে ওঠেন কবি। লাতিন আর গ্রিক ভাষা শেখা শুরু করেন। পরে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ল কোর্সে। দুই বছর পর গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই দেশে ফিরে যান।

১৯১২ সালে রোদেনস্টাইনের আমন্ত্রণে কবির তৃতীয় বিলেত যাত্রা। সঙ্গে ছেলে ও পরিবারের কয়েকজন। ‘সিটি অব গ্লাসগো’ নামের জাহাজে করে কবির সে যাত্রা। জাহাজের ডেকে বসে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য কবিতার অনুবাদেই কেটেছে বেশির ভাগ সময়। কয়েক সপ্তাহের এই সমুদ্রযাত্রা কবিকে একমনে অনুবাদ করতে সাহায্য করেছে। পথেই দুটি নোটবুক ভরে ফেলেছিলেন কবিতার অনুবাদে। লন্ডনে পাতাল রেলে ভ্রমণের সময় ঘটে বিপত্তি! অনুবাদের একটি নোটবুক হারিয়ে যায়, যা কবিকে খুব বিমর্ষ করে। কিন্তু কয়েক দিন পরই পাতাল রেলের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড অফিসে কেউ তা ফেরত দিয়ে যায় এবং কবি তা ফেরত পান। বেকার স্ট্রিটে লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড অফিসের পাশেই ২২১/বি বেকার স্ট্রিট, শার্লক হোমস আর ডা. ওয়াটসনের বাড়ি! এটা কি শুধুই কাকতালীয়?

ডেভন থেকে ট্রেনে করে রোদেনস্টাইনের উত্তর লন্ডনের হেম্পস্টেডের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌঁছান, সঙ্গে দুই বন্ধু ও ছেলে। রোদেনস্টাইন কবিকে কাছে পেয়ে অভিভূত। বাড়িতে ঢুকেই কবি রোদেনস্টাইনকে তাঁর অনুবাদের নোটবুক দিয়ে তা গ্রহণের অনুরোধ করেন। সেই রাতেই রোদেনস্টাইন কবির দেওয়া ইংরেজি অনুবাদ পড়া শুরু করেন এবং মনে করেন, এক মহান কবির আগমন ঘটেছে। তিনি এক কপি পাঠিয়ে দেন আইরিশ কবি ইয়েটসকে।

রোদেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রোদেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রোদেনস্টাইন কবি আর দলের থাকার ব্যবস্থা করেন হেম্পস্টেডের এক বাড়িতে । পরবর্তী কয়েক মাস কবি এখানেই কাটান। রোদেনস্টাইনের বন্ধুদের অনেকেই ইংরেজি সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়। তাঁরা প্রায়ই কবিতা পাঠের আসর, সাহিত্য আলোচনায় মেতে ওঠেন। কখনো রোদেনস্টাইনের বাড়িতে বা দিন ভালো থাকলে হেম্পস্টেড পার্কের ঘাসে। দ্রুত কবি হয়ে উঠলেন আসরের মধ্যমণি। তরুণ কবিরা কবির পায়ের কাছে বসে মুগ্ধ হয়ে কবির নিজের অনুবাদগুলো শুনতেন, যেন দৈববাণী শুনছেন। সেখানে থাকতেন আইরিশ কবি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, টমাস স্টারজ।

প্রথম যৌবনে যে ইংল্যান্ড কবি পাননি, তা–ই যেন ধরা দেয় এই তৃতীয় সফরে। তাঁর কল্পনার ইংল্যান্ড, শেক্‌সপিয়ারের ইংল্যান্ড। রোদেনস্টাইনের অনুরোধে কবি ইয়েটস গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখে দেন, আর তাতে কবির নিজের অনুবাদ করা ১০৩টি কবিতা স্থান পায়। আর তা প্রকাশিত হয় ‘India society UK’ থেকে। কবি ইয়েটস আইরিশ মঞ্চে কবির ‘পোস্টমাস্টার’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। ইংল্যান্ড যখন তাঁকে নিয়ে, তাঁর গীতাঞ্জলি নিয়ে মত্ত; কবি তখন আবারও জাহাজে, আমেরিকার পথে।

পরের বছর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন সাহিত্যে নোবেল পাওয়া প্রথম অ-ইউরোপীয়। ১৯১২ সালে কবি শুধু একজন বন্ধুর আমন্ত্রণে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তাঁকে তাঁর দেশকে কবিতা শোনাতে আসেন, আর এক বছর পর তিনি হয়ে যান সবার কবি, সারা বিশ্বের কবি। তাই তিনিই বিশ্বকবি।

Ref:
Tagore centre, UK
http://www.open.ac.uk/researchprojects/makingbritain/content/rabindranath-tagore
https://www.tagorecentre.org.uk/features-and-articles/would-you-travel-with-rabindranath-tagore/
https://fortnightlyreview.co.uk/tag/william-rothenstein/
https://fortnightlyreview.co.uk/2013/05/tagore-in-london/
https://www.hamhigh.co.uk/…/heritage-the-hampstead-years-of…