ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে করোনা তামাশা

ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে করোনাভাইরাস নিয়ে তামাশাটা বন্ধ হওয়া উচিত। ছবি: সংগৃহীত
ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে করোনাভাইরাস নিয়ে তামাশাটা বন্ধ হওয়া উচিত। ছবি: সংগৃহীত

১.

মে মাসের ১ তারিখ। ৪টা ৪৩ মিনিট। ভোররাতের গভীর ঘুমটা মেসেঞ্জারের টুংটাং শব্দে ভেঙে গেল। খাটের ওপর দেহটাকে আলতো ঘুরিয়ে টেবিলে থাকা মোবাইলটা হাতে নিলাম। অন্ধকার ঘরে স্যামসাং গ্যালাক্সির অ্যান্ড্রয়েড ফোনটার তীক্ষ্ণ আলোটা শীতল চোখের আলতো খোলা পাতা ভেদ করে নরম রেটিনায় কড়া আঘাত দিল।


মেসেঞ্জারে লেখা ‘করোনার সঙ্গে লড়াই করতে হবে, ভয় পেলে চলবে না। বউকে ভয় পেতে হবে, লড়াই করলে চলবে না। এই দুটো ব্যাপার গুলিয়ে ফেলবেন না, দুটোরই ওষুধ বের হয়নি!’ মাথাটা গুলিয়ে গেল। করোনার ওষুধ বের হয়নি? নিজেকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু মাত্র দুই দিন আগে সেই মেসেজটায় কী ছিল। খুলে দেখি। ২৯ এপ্রিল রাত ১২টা ১৭ মিনিট। তাতে ঝলমলে লেখাগুলো পড়ি। মেসেঞ্জারে লেখা আছে ‘করোনাভাইরাসের রহস্য ফাঁস! এই কাজগুলো নিয়মিত করুন, করোনা আপনার কাছে আসবে না। ইনশা আল্লাহ!’

আহ! করোনা চিকিৎসায় বিনা পয়সায় কী সুন্দর ব্যবস্থাপত্র। মার্ক জাকারবার্গকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর ফেসবুক আর মেসেঞ্জারের মাধ্যমে খুব সহজেই চিকিৎসা হচ্ছে। মহামারির এই যন্ত্রণাদায়ক সময়ে ভিত্তিহীন অনেক ভিডিও ক্লিপ, অযাচিত মেসেজ, নিজের কাল্পনিক কথা, আর অন্যের কথা শুধু কপি করে গণহারে একে অপরকে পাঠাচ্ছেন। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এটা পড়ুন করোনা আপনার কাছে ভিড়বে না, এইগুলো খাবেন করোনা পালাবে, এই মেসেজ ছড়িয়ে দিন, যত পারেন শেয়ার করেন, পুরোটা পড়বেন এবং ফরোয়ার্ড করবেন, ১০০ জনকে শেয়ার করুন, ১০০ সেকেন্ডের মধ্যেই আপনার সুখবর পাবেন ইনশা আল্লাহ! আর হরেক রকম কায়দায় শুভেচ্ছা তো আছেই।

২.

একবিংশ শতাব্দীর এই ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীটা যখন মানুষের হাতের মুঠোয়, বিজ্ঞানের সহজ জিনিসগুলো তাই জানা কঠিন কিছু নয়। তবু কেন অনীহা? কেনইবা আমরা বিশ্বাস করি সেই কথা, ১০০ জনকে শেয়ার করুন, ১০০ সেকেন্ডের মধ্যেই আপনার সুখবর পাবেন ইনশা আল্লাহ! সাম্প্রতিক সময়ে রাতবিরাতে মেসেঞ্জারের টুংটাং শব্দে মেসেজে পাওয়া এসব খরচবিহীন অপচিকিৎসার তিক্ত অভিজ্ঞতায় কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলাম ‘এগুলো সত্যিই খুব বিরক্তিকর, এটা বোঝার ক্ষমতা থাকা উচিত।’

লেখক।
লেখক।

কাজের মধ্যে ডুবে থাকায় নিজেও হয়তো ভালো করে বুঝি নাই। করোনায় এই দুর্যোগের সময় আজকে মনে হচ্ছে, আসলে সবই কিন্তু বিরক্তিকর নয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই মহামারিতে ঘরবন্দী মানুষের জন্য সুন্দর বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। গান, আর মিউজিক আবশ্যক। আবার সেসব কিছু ভিডিও ক্লিপ আর উদ্ভট কোনো সংবাদ বাসায় বন্দিত্বকে মজা দিতে পারে। করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে বিশেষজ্ঞ নন, এমন মানুষের পরামর্শ একটি। এপ্রিল মাসের ৯-১০ তারিখে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এমনই একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বাংলাদেশের একজন প্রবীণ বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ফুসফুসটাকে কেটে বাইরে এনে তা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ডেটল, অ্যালকোহল কিংবা শুধু সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় কি না! ডাক্তারদের সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর এই আইডিয়াটাই পরে বেহাত হয়ে গেল কি না, সেটা বলে বাংলাভাষী মানুষের কেউ কেউ করোনায় দেহে জীবাণুনাশক ঢুকিয়ে দেওয়া সম্পর্কিত একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিলেন। এতে আছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা। যন্ত্রণাদায়ক বন্দীদশা থেকে সবাই বের হয়ে আসতে চাই।

সত্য এই যে সবাই কিন্তু ঘরে বন্দী নেই। করোনার এই আগ্রাসী সময়েও উত্তর আমেরিকার এক বড় গবেষণাগারে প্রতিদিন কাজ করছি। দেশব্যাপী জরুরি অবস্থার মধ্যেও সেটা এক দিনও বন্ধ হয়নি। করোনার কাজে আমরাও আছি বলে। এখানে সরকারপ্রধান বলেছেন, ঘরে থাকো, জীবন চালাতে সরকার টাকা দেবে। তবু মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে অনেক মানুষকে জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হয়। উন্নত বিশ্বে বড় বড় গবেষকেরা দিন-রাত কাজ করছেন। টেস্ট কিট, ড্রাগ আর ভ্যাকসিনের সন্ধানে। করোনার এই মহামারি থেকে জীবনকে বাঁচাতে। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এসব কাজে অন্য রকম মজা আছে। জীবন বাঁচাতে এই দলে আছেন গবেষক, ডাক্তার, নার্স, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলাসহ অনেকে।

৩.

বৈশ্বিক এই মহামারিতে মানুষকে বাঁচানোর কাজে বাংলাদেশেও প্রায় একই চিত্র। উন্নত গবেষণাটা ছাড়া। রোগাক্রান্ত মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন ডাক্তার মঈন উদ্দিন ও ডাক্তার মনিরুজ্জামান। খবরে জানা যায় অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষদের কথা। সাহসী, পরোপকারী, গরিবের ডাক্তারদের কথা। মৃত্যুর দুয়ার থেকে হাজারো জীবনকে ফিরিয়ে আনা সফল মানুষদের কথা। প্রাণ হারিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, আমলা। এই ক্রান্তিকালে আমাদের সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের কাজ দেখে গর্ব আর আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করে।

সব রকমের খবরে মুখ উজ্জ্বল হয় না। কখনো মাথা হেঁট হয়ে যায়। ত্রাণের চাল চুরির খবর দেখে কষ্টে বুকের মধ্যে বেদনার জোরালো অনুভূতি টের পাই। কৃষকের ধান কাটায় সাহায্যের কথা বলে নিজের বিশাল দলবহর আর অসংখ্য ক্যামেরাম্যান নিয়ে ধানখেত মাড়িয়ে সেই সবের মহড়া দেওয়ায় প্রচার কাঙাল মানুষের কুরুচির চিত্রটাই স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় একজন জনপ্রতিনিধি ধানখেতে কাঁচা ধান কাটছেন। এসব অন্যায়। তবে এর বাইরে অসংখ্য ভালো কাজের উদাহরণ চোখে পড়ে।

আশার কথা, ইতিমধ্যে জরুরি অবস্থায় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য রেমডিসিভির ব্যবহারে অনুমতি দিয়েছে আমেরিকার এফডিএ। প্রথম আলোর করোনা-আতঙ্কে বিজ্ঞান লেখায়, ‘করোনা-আতঙ্কে বিজ্ঞান’ (লিঙ্ক- https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1647142) রেমডেসিভিরের আলোচনা ছিল। দেশে করোনার শুরুতে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অপ্রতুলতায় আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বলি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে বাংলাদেশে তখন বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এটি তৈরি করা খুবই সহজ, অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড আর গ্লিসারিন মেশানো। আর বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে মহামারির এই সময়ে ল্যাবরেটরিতে এটা বানিয়ে মানুষের চাহিদা মেটানো অসম্ভব। এই কয়েকটি জিনিস মিশিয়ে বোতলে ভরে, সেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ ছবি উঠিয়ে প্রচারকে মোটেও দৃষ্টিনন্দন মনে হয় না। ‌‘জীবন যেখানে যেমন’ (https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1582371/) এ লেখা খুব যত্নে সেই লালিত স্বপ্ন অজানা কারণে ভেঙে যাওয়ার ব্যথাটা চিনচিন করে ওঠে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় উন্নত গবেষণা দরকার।

৪.

বাংলাদেশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। শিক্ষার মূল ভিত্তিটাও সেখানে। জীবনযাত্রায় দেশমাতা দুই হাত ভরে দিয়েছে জমিনটাকে ব্যবহারের জন্য। উন্নত দেশে বসবাস করলেও বর্তমানের এই মহাসংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষদের আহাজারি দেখে হৃদয়ের গহিনে শক্ত ব্যথাটা টের পাই। কথা বলি আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে। ডাক্তারসহ বর্তমান সময়ের সাহসী কর্মজীবী বন্ধুদের অনুরোধ করি জীবন বাঁচাতে কাজ করতে। বলি উৎসাহের কথা, তাঁদের এই মহান পেশার কথা। দেশের সব মানুষ—শুভ কামনা সবার জন্য। সুস্থ থাকুন, আর অর্থনীতির চাকা দ্রুত সচল হোক।


*ড. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা। [email protected]