করোনা রোগীর সঙ্গে কেন আমাদের বৈরী আচরণ

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

কয়েক দিন ধরে খবরে দেখালাম, করোনা রোগের ভয়ে সন্তানেরা মাকে বনে ফেলে চলে যাচ্ছেন, মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, করোনা রোগীদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় জনগণ বাধা দিচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুরপাড়ে আলাদা থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং করোনা রোগীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে।

একবার কি ভেবেছেন এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? একটি সভ্য সমাজে তো এমন হওয়ার কথা নয়। তবে কেন মানুষ এমন আচরণ করছে? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।

সাধারণত মানুষ যখন বিপদে পড়ে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভয়ে থাকে অথবা কোনো ঘোর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়, তখনই মানুষ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। সব সময় নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। একসময় এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠে যে তখন সে তার হিতাহিত জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলে। অবিবেচক কিংবা বিবেকহীনের মতো আচরণ করে। তার কাছে তখন সম্পর্ক, মনুষ্যত্ব এবং নৈতিকতার থেকেও নিজের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। একরকম ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ অবস্থা।

এখন কথা হলো, মানুষের এমনটা কেন হচ্ছে? মানুষ করোনা রোগী কিংবা করোনা রোগীর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনের দিকে কেন এমন বৈরী আচরণ করছে? এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে।

প্রথমত,
করোনা রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রকৃত তথ্য না জানার ফলে আমরা যে যার মতো চিন্তা করে নিচ্ছি। একেকজনের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে একেক রকমভাবে আচরণ করছি। কেউ ভালো কেউ খারাপ। আমরা অনেকেই এই মহামারি নিয়ে মনগড়া তথ্য দিচ্ছি। যে যার মতো ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিচ্ছি। না জেনে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে ব্যস্ত হচ্ছি। যার এই বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান আছে, সে তো বলেছিই, এমনকি যে এই বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ সেও একইভাবে পাণ্ডিত্য বজায় রেখেছি। যা মানুষকে প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে সচেতন করার বিপরীতে ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। ফলে মানুষ অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে।

দ্বিতীয়ত,

লেখক।
লেখক।

করোনার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক না থাকা এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা এবং কুসংস্কারের প্রভাব। যেহেতু এই রোগের কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই রোগ নিয়ে আতঙ্কিত এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছে। আর এই সুযোগে অনেকেই ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে করোনা নিয়ে বিভিন্ন রকমের মতামত দিয়ে যাচ্ছে। যেমন করোনা কেবল পাপী মানুষের হয়। এখন যে বা যারা এই মতামত দিয়েছে, তারা কী করে নিশ্চিত হলো যে এই রোগ কেবল পাপী ব্যক্তিরই হয়? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ মানুষেরই ধর্মীয় জ্ঞান সীমিত, তারা নিজেদের সুবিধার্থে পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে নিজেদের মতো অপব্যাখ্যা করে নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। এবং সাধারণ মানুষ তাদের বিশ্বাসও করছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে করোনা রোগীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব এবং ঘৃণা তৈরি হচ্ছে।

তৃতীয়ত,
গুজব ছড়ানো। করোনা রোগ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই পাওয়া যায়। এমন এমন সব তথ্য, যা শুনলে বা দেখলে রীতিমতো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ জেনেবুঝে নিজস্বার্থে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়ায় আবার কেউ কেউ না জেনে বা না বুঝে এই তথ্য অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে। একসময় গুজব এমন অবস্থায় চলে যায় যে গুজব সত্যের চেয়েও বেশি সত্য মনে হয়। ফলে সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করে। বর্তমান পরিস্থিতি এর ব্যতিক্রম নয়।

চতুর্থত,
হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া। রোগ হলে চিকিৎসা নিতে মানুষ হাসপাতালে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই পাল্টে গেছে হাসপাতালের সাধারণ চিত্র। মানুষ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত আসছে। ফলে গণমনে করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমনকি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হবে বলে গণমনে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে, যা মানুষকে ক্রমেই স্বার্থপর করে তুলছে। মানুষ নিজেকে বাঁচাতে, একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। করোনা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে উল্টো করোনা আক্রান্ত রোগীকে শত্রু বলে গণ্য করছে।

পরিশেষে, গণমাধ্যমের অনুপযুক্ত শিরোনাম এবং অতিরঞ্জিত শব্দচয়ন। প্রায়ই গণমাধ্যমে এমন এমন কিছু শিরোনাম চোখে পড়ে, যা নির্দিষ্ট প্রতিবেদনের থেকে আলাদা। শুধু পাঠকদের নজরে আসতেই এমন সব শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। যেহেতু আজকাল প্রায় সব গণমাধ্যমেরই সোশ্যাল মিডিয়া পেজ রয়েছে, সেহেতু পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছাতে এই খবর সোশ্যাল মিডিয়া পেজে পোস্ট করা হচ্ছে। ফলে বিপুলসংখ্যক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী শিরোনাম দেখে বিস্তারিত না পড়েই ভুল তথ্য ধারণ করছে। একই সঙ্গে শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে বাড়াবাড়ি। যেমন: ‘... স্থানে করোনার প্রকোপ/থাবা/তাণ্ডব’, ‘করোনা গ্রাস করল পুরো পরিবার’ ইত্যাদি। সাধারণত (প্রকোপ, থাবা, তাণ্ডব এবং গ্রাস করা) এই ধরনের শব্দগুলো মানুষের মনে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ভয়ের সৃষ্টি করে। আর ভয়ের থেকেই তৈরি হয় স্বার্থপর মনোভাব। সুতরাং গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

উপরিউক্ত কারণগুলো ছাড়াও এমন আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যা চাইলে আমাদের মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখতে পারেন। সবাই কেন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের পথে হাঁটতে পারলেই কেবল এই সামাজিক সংকট থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।