মায়ের অস্তিত্ব আমিই

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

বয়স যতই বাড়ুক, মায়েদের কাছে তাদের সন্তান সব সময়ই ছোট থাকে। যার প্রমাণ মায়ের কাছে আমি নিজে। মায়ের সঙ্গে শেষ গত ডিসেম্বর (২০১৯) মাসের শুরুতে দেখা করে বিদায় নিয়ে এলাম। আসার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলছিলেন, ‘আর হয়তো দেখা পাবি না, আয় একটু বুকে জড়িয়ে ধরি।’ বলেই বললেন, ‘ভালো থাকিস। তোদের তিনজনকে আশীর্বাদ করছি, ঈশ্বর যেন তোদের মঙ্গল করেন।’

এরপর জাপান ফিরে এসে মায়ের অবস্থা যে তেমন ভালো না সে কথা বাসায় ওদের বললাম। ছেলে শুনে বলল, ‘আমি ঠাকুরমাকে দেখতে যাব।’ সঙ্গে সঙ্গে তার মা সিদ্ধান্ত নিয়ে টিকিট কনফার্ম করে দিল। জানুয়ারিতে ফিরে এসে তার মাকে বলল, ঠাকুরমা মনে হয় বেশি দিন বাঁচবে না। এ কথা শুনে তার মা ফোন করে কথা বলল মায়ের সঙ্গে।


আমার অবর্তমানে যেহেতু ওরা মা-ছেলে দুজনে সব সময় ফোন করে কথা বলে, তাই এবারও কথা কী হয়েছে জানি না। শুধু বলল, তুমি যেমন বলেছ, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে কথা বলেছে। গত বছর শেষবার যখন আমি দেশে যাই, তার আগেই মায়ের স্ট্রোক করেছিল। যে কারণে কাউকেই ঠিকভাবে চিনতে পারছিলেন না। কথাও বলতেন অগোছালো। বাচ্চাদের মতো ছিল আচরণ। এটাই বলেছিলাম এসে ওদের কাছে। যে কারণে ওরা বলল, আমার কথার সঙ্গে মার কথার মিল নেই। তখনই বলেছি এটা মনে হয় শেষবিদায়ের আগে ভালো হওয়া। সবার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে পর বিদায় নেবেন।


তিনজনের আলোচনাকালে থাইও (আমার ছেলে) তার মাকে বলেছে আর হয়তো পাবে না, তাই পারলে ছুটি করে যাও দেখে আসো। সব সময় আমি দেশে জাপানের কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের কাজ নিয়ে যাই, যে কারণে মাকে বেশি সময় দেওয়া হয় না। তাই এবার ইউকি (আমার স্ত্রী) বলছিল, এবার অন্য আর কোনো কাজ নিয়ে দেশে না যেতে। পুরোটাই মাকে সময় দিতে হবে।


ফেব্রুয়ারিতে যেহেতু দেশে বইমেলা চলে, তাই বললাম, তুমি মাকে সময় দিয়ো, আমি বইমেলা করে প্রতিদিন বাড়ি থেকে আসা–যাওয়া করব। যেই কথা সেই কাজ করব মনে করে ১২ ফেব্রুয়ারি দেশে যাওয়ার টিকিট কনফার্ম করা হয়। এদিকে সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পর টেলিভিশন প্রোগ্রামের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন আসে। আমাকে দেশে নিয়ে যাবে একটি প্রোগ্রাম করার জন্য। আমি তাদের কথা শোনার পর ভাবছি বাসায় এসে শেয়ার করব স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে। দরকার হলে দেশে কিছুদিন বেশি দিন থেকে কাজটি করতে পারলে খরচ সব উঠে যাবে।

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

সে সময় এক কফি হাউসে বসে লিখছিলাম। কথা শেষ করে আবার যখন লেখায় মনোযোগী হলাম, এর মধ্যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে এসএমএস এল দেশ থেকে, মায়ের অবস্থা ভালো না, দেশে যেন যোগাযোগ করি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম ভাগিনী মিতার কাছে। সে-ই মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়েছে। খবরটা ভালো বলতে পারবে মনে করে তাকে কল দেওয়া। মিতা জানাল, আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। সবাই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। কারও সঙ্গে মা কোনো কথা বলছে না। শোনার পর অন্য ভাইবোনদের ফোন দিয়ে আরও বিস্তারিত জানলাম।


আমি যে দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, দেশে কাউকেই বলা হয়নি সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ভেবে। মায়ের এমন দুঃসংবাদ শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে বাসায় এসে বিষয়টি আলোচনা করে টিকিটের জন্য কথা বললাম পরিচিত এজেন্টের কাছে, রাতে বা পরের দিন ফ্লাই করা যায় কি না তা জানার জন্য। প্রথম বলছিল কোনো টিকিট নেই। তারপর কোনোভাবে দেওয়া যেতে পারে বলে বলল দাম অনেক বেশি। তাতেই বুকিং দিলাম।

মধ্যরাতেই আবার এসএমএস এল মা আর নেই। মনে হলো পৃথিবী ভেঙে পড়ল যেন মাথার ওপর। কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। ছেলে আর স্ত্রী পাশে বসে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল।


পরের দিন টিকিট শিওর পাব মনে করে দেশে ফোন করে বললাম আমি আজই ফ্লাই করব, লাশ যেন আমি আসা পর্যন্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আবার যখন টিকিটের জন্য ফোন করি, তখন দাম জানাল টিকিট ম্যানেজ করা গেছে, তবে দাম পড়বে যে দামে আমরা আগেই টিকিট কেটেছি তার চেয়ে বেশি হবে, চার গুণ প্রায়। ভেবে দেখলাম, এক দিন পরেই ফ্লাই করছি, এর জন্য এত দাম দিয়ে টিকিট করে যাওয়াটা বোকামি। মা বেঁচে থাকলে হয়তো গিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। এরপর অনেক ভেবে পরে জানিয়ে দিলাম, লাশ কবর দিয়ে দিতে। যেই কথা সেই কাজ।


১২ ফেব্রুয়ারি ইউকিকে নিয়ে দেশের উদ্দেশে রওনা দিলাম। ১৩ তারিখ ঢাকা গিয়ে পৌঁছালেও সেদিন আর গ্রামের বাড়ি যাইনি। ঢাকা কিছু কাজ ছিল, কাজ সেরে ১৪ তারিখ বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখি ভাইবোন সবাই বাড়িতে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনজন আসতে না পারলেও লন্ডন থেকে বোন আগেই এসেছিল। সবাই বাড়িতে মায়ের জন্য সামাজিকতা যা যা করণীয় তাই করল।


সামাজিকতা বলে কথা। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী আমারও কিছু করণীয় ছিল, যা বাড়িতে সম্পন্ন করি। দুই বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়িতে মা একাই থাকতেন বেশি সময়। এর মধ্যে যতবারই বাড়ি গিয়েছি, মা আমাকে চা–কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। ভাত খাওয়ার সময় হলে কী খাওয়াবেন, নিজে না খেয়ে তার ভাগের খাবারটুকুও যেন আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বলতেন মায়ের হাতের খাবার আর তো পাবি না, খা। আমাকে একটু বেশি খাওয়াতে পারলেই যেন মায়ের শান্তি। রাত হলে কখনো মায়ের পাশে একই বিছানায় ঘুমিয়েছি।


মা মারা যাওয়ার পর দেশে গিয়ে যে কয় দিন বাড়িতে ছিলাম, বাড়ির প্রতিটি পদেই মায়ের চেহারা চোখে ভেসেছে। বাড়িতে গেলে সব সময় কাপড় ছাড়ার আগে মা বলতেন, এই তোর বাবার লুঙ্গিটা নে পর, এই তোর বাবার একটা শার্ট আলমারি থেকে বের করে দিচ্ছি পর। এই, বিছানার নিচে স্যান্ডেল আছে দিচ্ছি পরে নে। মানে আমি কিছু ভাবার আগেই মা বলতেন। অনেকটা অস্থির হয়ে যেতেন আমার সেবা করার জন্য। নিজে পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে ভেজে খাওয়াতেন।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত যত দিন মায়ের কাছে থেকেছি, প্রতিটি মুহূর্তই এখন স্মৃতির পাতা জুড়ে আছে। লিখে শেষ করা যাবে না। মা বেঁচে থাকা অবস্থায়ও লিখেছি মাকে নিয়ে। আজ মা দিবস উপলক্ষে মাকে নিয়ে লিখছি। ভাবছি আবার বড় লেখা লিখব।


এবার যেদিন বাড়ি থেকে ফিরে আসি, সেদিন বুক ফেটে যাচ্ছিল। যেদিকে তাকাই, যেন সেদিকেই মায়ের উপস্থিতি টের পাই। বাড়ির পাশে কবরস্থান। দূর থেকে মায়ের কবর দেখতে দেখতে গাড়িতে চড়ছিলাম। মায়ের কথা মনে করে বুকফাটা কান্না আসছিল। কান্না চাপা দিতে পারলেও গাল বেয়ে চোখের জল সামলানো কঠিন ছিল। চলে এলাম জাপান। আসার সময় মায়ের কিছু স্মৃতি বহন করে নিয়ে এসেছিলাম। ঘরে এসব দেখি আর মায়ের কথা ভাবি। কিছুই করার নেই। জানি একদিন আমাকেও যেতে হবে। এভাবে একদিন সবাইকেই এই চিরন্তন সত্যের পথে এগোতে হবে। মেনে নিতে হবে মৃত্যুই আমাদের জীবনের শেষ ঘটনা। যা কেউ ঠেকাতে পারে না।


আমি জানি, যত দিন বেঁচে থাকব, মায়ের অস্তিত্ব আমার মধ্যেই বেঁচে থাকবে। আমার শরীর যে মায়েরই রক্ত দিয়ে গড়ে ওঠা।