ক্যানবেরার বসন্ত উৎসবে একদিন

টিউলিপ ফুলের বাগান। ছবি: লেখক
টিউলিপ ফুলের বাগান। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার ফ্লোরিয়াতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় Festival of spring, বাংলায় যাকে বলে বসন্ত উৎসব। সেপ্টেম্বর–অক্টোবর এই দুই মাসজুড়ে চলে নানা রঙের ফুলের মেলা, খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা আরও কত কিছু। তাই এই সময় এলেই পুষ্পপ্রেমীদের মন মেতে ওঠে আনন্দে। 

প্রতিটা স্টেটে এমন উৎসব হয়ে থাকলেও ক্যানবেরায় সবচেয়ে বড় আকারে এই উৎসব হয়। তাই সবার মধ্যে উত্তেজনা থাকে, দূরদূরান্ত থেকে আসতে থাকে মানুষজন, এই উৎসব উপভোগ করতে।

এখানে প্রধান আকর্ষণ হলো টিউলিপ। নানা রঙের বর্ণিল সব টিউলিপের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমি বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী। চাঁদ, সমুদ্র আর ফুল আমাকে ভীষণ টানে। ছবি তোলা তাই নেশা। মনে হয় সবকিছু ফ্রেমবন্দী করে ফেলি, যেন আমার চোখ দিয়ে যা দেখছি সেটা সবাইকে উপভোগ করাতে পারি।

গত বছর আমি তাই গিয়েছিলাম এই উৎসব দেখতে। তখন আমার একমাত্র মেয়ের বয়স দুই বছর মাত্র। ওকে নিয়ে আমরা ঘুরতে একটু ভয়ই পাই। কারণ সব সময় তটস্থ থাকতে হয়, কখন কান্নাকাটি শুরু করে দেয় আবার। ঘণ্টাখানেকের বেশি ড্রাইভ করে তখনো কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

বাহারি রঙের টিউলিপ নিয়ে ক্যানবেরায় আয়োজন হয় বসন্ত উৎসবের। ছবি: লেখক
বাহারি রঙের টিউলিপ নিয়ে ক্যানবেরায় আয়োজন হয় বসন্ত উৎসবের। ছবি: লেখক

আমার বাসস্থান সিডনি থেকে ক্যানবেরার উৎসবে যেতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। জ্যাম আর বিরতির কারণে সেটা ঘণ্টা তিনেকের মতো লাগে। আমাদের সঙ্গে আরও দুটি পরিবারও গিয়েছিল। আমরা সবাই মিলে সকালবেলায় রওনা দিলাম। সঙ্গে কিছু খাবারদাবার, পানি এসব নিয়ে।

ঘণ্টাখানেক পরে একটু বিরতি দিয়ে নাশতা করে চা খেয়ে নিলাম। আমাদের সবার বাচ্চাদেরও একটু রিলাক্স হলো। খাওয়াদাওয়া শেষে আবার রওনা দিলাম উৎসবের উদ্দেশে।

ঘণ্টাখানেক পরে ক্যানবেরা শহরে পৌঁছে আরেক ভাইয়ের বাসায় সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর তারাসহ সবাই মিলে রওনা দিলাম আসল গন্তব্যে। পৌঁছানোর পর শুরু হলো খোঁজাখুঁজি! এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পার্কিং পাওয়া। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টার পরে অবশেষে পার্কিং পাওয়া গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর কিছুটা হাঁটাপথ। আমার আর তর সইছে না! মনে হচ্ছে দৌড়ে চলে যাই।

টিউলিপে মুগ্ধ আসা মানুষ। ছবি: লেখক
টিউলিপে মুগ্ধ আসা মানুষ। ছবি: লেখক

বাকিরা আগেই চলে গেছে, আমরা পার্কিংয়ের কারণে একটু পিছিয়ে। আস্তে আস্তে উৎসবের মেইন গেট দিয়ে ঢুকলাম। আমি একটু বেশি আবেগপ্রবণ বলেই হয়তো চোখে পানি চলে এল। ক্যামেরা হাতে নিয়েই ছবি তোলা শুরু করলাম। আলায়না এক দৌড়ে ততক্ষণে চলে গেছে টিউলিপখেতে। একেবারে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলে ফুলে! মেয়েটা আমার ভীষণ ফুল ভালোবাসে, ঠিক আমার মতোই।

আমি এত সৌন্দর্যে বাকরুদ্ধ অবস্থায় আছি। ওদের ছবি তুলছি, ফুলের ছবি তুলছি, মানুষের আনাগোনা দেখছি। ওকে বললাম, আমার একটা ছবি তুলে দাও। আমার স্বামী বেচারা বুঝতে পারছে না, সে আমার ছবি তুলে দেবে, নাকি আলায়নাকে ধরবে! আমার মেয়েকে ধরে রাখা ভীষণ রকমের কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। সে একবার এই ফুলের খেতে, আরেকবার অন্য ফুল ধরে টানাটানি, মাটিতে গড়াগড়ি এইভাবেই চলছে।

আলায়না টিউলিপ খেতে। ছবি: লেখক
আলায়না টিউলিপ খেতে। ছবি: লেখক

এর মাঝে দেখলাম এক জায়গায় একটু ভিড় আর সিকিউরিটির কয়েকজন। খেয়াল করলাম ট্রফি। আমার স্বামী এগিয়ে গিয়ে দেখি ততক্ষণে নিজের আর মেয়ের ছবি তুলছে! আমি ব্যস্ত ছিলাম অন্যদিকে। দেখলাম এটা নারী টি–২০ ওয়ার্ল্ড কাপের আসল ট্রফি! আহ আমার বাংলাদেশের বাঘিনীগুলো আসবে কিছুদিন পরে এই ট্রফির জন্য লড়তে। ভাবতে কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে সব দিকের ফুলের আইলগুলো ঘোরা শেষ হলো।

আবার ফিরে আসতে হবে। লেকের পাশে বসে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। বিকেল হয়ে গেছে। এরপরের গন্তব্য Mount Ainslie lookout. এখান থেকে ক্যানবেরার পার্ফেক্ট ভিউ দেখা যায়। এর সুন্দর দৃশ্য যে দম বন্ধ করে উপভোগ করতে হয়। আমাদের হাতে সময় ছিল না আর। খুব অল্প সময়ে যাত্রা সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

বাকিরা সেখানে থাকার পরিকল্পনা করেছে। আসার পথে আমার মেয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। অন্যদিকে আকাশে মস্ত চাঁদ।

চাঁদের আলোয় জোছনামাখা পথ ধরে আমরা চলেছি। প্রথম বাচ্চাসহ এই লম্বা ভ্রমণ, ফিরতি পথে একা, তাই সবাই একটু চিন্তায় ছিল আমাদের নিয়ে। টানা চলে এলাম মেয়ে ঘুমানোর সুবাদে। স্বপ্নিল এক উৎসব উপভোগ করে রাত ১০টায় ফিরলাম আপন নীড়ে।
[email protected]