করোনা মোকাবিলায় কীভাবে সফল স্লোভেনিয়া

সরকারের উদ্যোগ, মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা করোনাভাইরাসের বিপক্ষে জয়ী হয়েছে স্লোভেনিয়া। ছবি: সংগৃহীত
সরকারের উদ্যোগ, মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা করোনাভাইরাসের বিপক্ষে জয়ী হয়েছে স্লোভেনিয়া। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনো ধরনের যুদ্ধ নয়, নয় কোনো ধরনের সামরিক অভিযান কিংবা কোনো ধরনের পারমাণবিক অভিযান অতিক্ষুদ্র একধরনের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন, ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ।

মধ্য ইউরোপের ৭ হাজার ৮২৭.৪ বর্গমাইলের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লাখ লোকের বসবাস। সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, বিভিন্ন ধরনের হৃদ, ব্রাউন বিয়ার ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি পর্যটকদের কাছে এক জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত। করোনার ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ইউরোপের ছোট ও সুন্দর এ দেশটি। তবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইতালি কিংবা ইউরোপের স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের তুলনায় স্লোভেনিয়ায় করোনা সংক্রমণের হার বরাবরই কম। এমনকি মৃত্যুর হার বিবেচনায়ও ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়া ছিল সবচেয়ে নিম্ন অবস্থানে।

গত ১৫ মে, ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে করোনাভাইরাসের মহামারি অবস্থার পরিসমাপ্তির ঘোষণা দেয় স্লোভেনিয়া। প্রধানমন্ত্রী ইয়ানেজ ইনশার পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ইউরোপের প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ১২ মে সব ধরনের ফ্লাইট চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় স্লোভেনিয়া। ১১ মে থেকে বাস, ট্রেনসহ সব গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। গত সপ্তাহ থেকেই রেস্টুরেন্ট, বার, কফিশপ খুলে দেওয়া হয়েছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতেও এখন আর কোনো বাধা নেই। গতকাল সোমবার থেকে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলেছে।

২৩ মে থেকে মাঠে গড়াচ্ছে ফুটবল ম্যাচ। মে মাসের শেষের দিকে যথাসময়ে স্টেট মাতুরা এক্সাম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্টেট মাতুরা এক্সামকে আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে কেউই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হননি। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এ ভাইরাসের প্রভাবে কোনো ধরনের প্রাণহানিও ঘটেনি। পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও পুনরায় সীমান্ত সংযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রাথমিক অবস্থায় বলা হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন দেশের নাগরিক স্লোভেনিয়ায় এলে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর নাগরিকদের ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ইউরোপে সবচেয়ে নাজুক দেশটি ছিল ইতালি। অথচ ইতালির প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্লোভেনিয়া সফলভাবে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করল? কেনইবা ইউরোপ এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়ায় সে অর্থে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেনি? এসব প্রশ্নেরই আজ উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।

প্রথমত, সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়া ডিসেন্ট্রালাইজড। পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্য করি, দেশটির অভ্যন্তরে বসবাস করা মানুষের জীবনযাত্রা একটি নির্দিষ্ট শহরকেন্দ্রিক। হতে পারে সেটি দেশটির রাজধানী শহর, আবার হতে পারে সেটি দেশটির বৃহত্তম কোনো নগরী। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলতে পারি। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস বাংলাদেশে, যাদের ২ কোটির ওপরে মানুষ বসবাস করে রাজধানী ঢাকায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকলাপ সবকিছুই ঢাকাকে ঘিরে। দেশের সচেতন যেসব নাগরিক রয়েছেন বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের যারা সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ঢাকাতে স্থায়ী হতে চায়।

আবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। আয়তনে পঞ্চম বৃহত্তম দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৩ কোটির মতো। ব্রাসিলিয়া রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সাও পাওলো এবং রিও ডি জেনিরোকে ঘিরে। তাই জনবসতির বিবেচনায় দুটি শহর দেশটির অন্য শহরগুলোর তুলনায় অত্যধিক ঘনত্ববিশিষ্ট। স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এ রকম নয়, স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা যা একই সঙ্গে দেশটির বৃহত্তম নগরী। তবে স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন শুধু লুবলিয়ানাকেন্দ্রিক নয়। স্লোভেনিয়ার প্রায় সর্বত্র জনবসতির বণ্টন রয়েছে এবং সমগ্র স্লোভেনিয়া সুউচ্চ আল্পস এবং ডিনারাইডস পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় জনবসতির এ বণ্টন অনেকটা ছড়ানো–ছিটানো। স্লোভেনিয়ার প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কারও আসলে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি আমার বসবাস ভিপাভাতে এবং আক্ষরিক অর্থে ভিপাভা একটি নিভৃত পল্লী অথচ ছোট এ এলাকাতেই আমার জীবনের সব প্রয়োজনীয় চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করা সম্ভব। করোনাভাইরাসের মহামারি বিস্তার প্রতিরোধে স্লোভেনিয়ার সরকার ১৭ মার্চ থেকে সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থায় নিয়ে আসে। অনুমতি ব্যতিরেকে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হলেও ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থার কারণে মানুষের খুব বেশি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিশেষ করে লুবলিয়ানা, মারিবোর, ছেলইয়ে, ক্রানিয়ের মতো বড় শহরগুলোয় যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়েনি।

স্লোভেনিয়া উত্তর দিক থেকে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের শাখা আড্রিয়াটিক সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। করোনাভাইরাসে নাজুক অবস্থানে ছিল ইতালি আর স্পেন। এ হিসেবে ইতালির সীমান্তবর্তী স্লোভেনীয় অংশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় থাকার কথা ছিল অথচ স্লোভেনিয়ার এ অংশে অর্থাৎ পশ্চিম স্লোভেনিয়ায় দেখা যায় যে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। সমগ্র স্লোভেনিয়ায় যখন করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছুঁইছুঁই তখনো স্লোভেনিয়ার এ অংশে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। ইতালিতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেস শাবেদার সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেন।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। ছবি: সংগৃহীত
স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিকভাবে ইতালি ও স্লোভেনিয়া বিভিন্নভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইতালির ত্রিয়েস্তে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শহর ছিল, যেখানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল। এ ছাড়া স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা যেমন: কপার, ইজোলা, পোর্তোরস কিংবা ক্রোয়েশিয়ার পুলা অথবা পরেচ এসব জায়গায় প্রচুর ইতালিয়ানদের বসবাস রয়েছে। এমনকি এসব জায়গায় যাঁরা স্থায়ী হন, তাঁদের স্লোভেনিয়ান অথবা ক্রোয়েশিয়ান এবং ইতালিয়ান দুটি ভাষায় দক্ষ হতে হয় এবং এসব জায়গার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও উভয় ভাষায় পাঠদান করে থাকে। এ ছাড়া সাগরের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোয় সব সময় জনসমাগম থাকে কিন্তু ইতালিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে না করতে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলগুলোতে মানুষের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। এমনকি সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের জমায়েতকে কমিয়ে আনার জন্য স্পেশাল পুলিশ ফোর্স মোতায়ন করা হয়। পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব প্রিমোরস্কাসহ এসব জায়গার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

গত ৪ মার্চ স্লোভেনিয়ায় সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মরক্কো থেকে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। স্কি স্লোভেনিয়ার একটি জনপ্রিয় খেলা এবং স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ স্কির প্রতি আসক্ত। স্লোভেনিয়ায় সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের শরীরে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে, তাদের একটি বড় অংশ কয়েক দিন আগে ইতালিতে গিয়েছিল স্কি খেলার জন্য। যেহেতু স্লোভেনিয়ায় করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে ইতালির মাধ্যমে এবং একই সাথে ইতালিতে যখন করোনার ছোবল সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে, ঠিক তখনই স্লোভেনিয়ার সরকার ইতালির সাথে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ইতালি থেকে যারা যারা স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করে, সবাইকে মেডিকেল চেকআপের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয় এবং তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়। পরে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৯ মার্চ থেকে স্লোভেনিয়াতে বাস, ট্রেনসহ সব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সাথে লুবলিয়ানার একমাত্র বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও সব ফ্লাইট স্থগিত করে দেওয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন ধরনের কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। ট্যাক্সি সেবার ক্ষেত্রে যদিও কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছিল না তবে ট্যাক্সিচালকদের বলা হয় প্রতিবার যাত্রী বহনের শেষে তাদের ট্যাক্সিগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে যাতে করোনাভাইরাসের বিস্তার অনেকটা প্রতিহত করা সম্ভব হয়।

রোগী শনাক্তের পরই জরুরি অবস্থা জারি
প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে স্লোভেনিয়ায় জরুরি অবস্থা জারি হয়, তখনো স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খুব একটা জটিল পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাচ্চাদের মাঝে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল থাকায় প্রথমে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করা হয়। সব গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে মোবাইলে ম্যাসেজে জানানো হয় যেকোনো পাবলিক প্লেসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবাইকে মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরতে হবে। পারস্পরিক ১.৫ এর দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কেউ নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে ন্যূনতম ৪০০ ইউরো জরিমানর সিদ্ধান্ত হয়। লুবলিয়ানা, মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়ের মতো বড় শহরগুলোতে পুলিশ প্রশাসনকে যতটা সম্ভব কড়া অবস্থানে থাকতে দেখা গিয়েছে, যাতে জনসাধারণ এ নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে পারে।

স্লোভেনিয়ার সরকারের পাশাপাশি মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সুপার শপ, খাবারের দোকান, পেট্রোল স্টেশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এ অবস্থার মধ্যেও কাজ মানুষ করে গিয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে একজন কিংবা একই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রথম দিকে অবশ্য মুখে মাস্ক এবং হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান না করা থাকলে কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে হ্যান্ড গ্লাভসের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হলেও প্রতিষ্ঠানের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত সবাইকে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে হলে সবার প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে।

হটলাইন চালু
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যেসব ফ্যাক্টরি চলছে, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করতে বলেছে স্লোভেনিয়া সরকার। প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা ছিল। সবাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় ছিলেন। এ ছাড়া স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে স্পেশ্যাল হটলাইন চালু করা হয়। কেউ শরীরে ব্যথা, সর্দি, কাশি, জ্বরসহ কোভিড-১৯–এর সাথে সম্পর্কিত কোনো উপসর্গের সম্মুখীন হলে তাকে তৎক্ষণাৎ ১১২, ০৮০১৪০৪ এবং +৩৮৬৩১৬৪৬৬১৭ এ তিনটি নম্বরে ফোন দিতে বলা হয়। মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় ১১২ এ বিশেষ নম্বরের লোগো–সম্বলিত গাড়ি টহলে নিয়োজিত ছিল। এখনো আছে। কোভিড-১৯–এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে নিকটস্থ হাসপাতালে ততক্ষণাৎ স্থানান্তরের জন্য সব সময় ১১২–এ বিশেষ নম্বরের গাড়িটি কাজ করছে।

আগের থেকে সতর্কতা এবং একই সাথে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করায় স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। ১৫ মে পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬৫ জন এবং মৃত্যু ১০৩ জন। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ৬৭–এর ওপরে এবং তাদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অ্যাজমাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ছিল বলে স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে।

স্লোভেনিয়ায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ২৪.১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯–এর মধ্যে। এ ছাড়া স্লোভেনিয়ার সরকারের ঘোষিত আর্থিক বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। কৃষক এবং স্লোভেনিয়াতে যাঁরা পেনশনভোগী, তাঁদের জন্য এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাসে ১৫০ ইউরো করে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং এ পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে যাঁদের কাজ নেই, তাঁদের বেতনের ৮০ ভাগ করে দিতে বলা হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। তবে একটি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে আর সেটি হচ্ছে স্লোভেনিয়াতে যেসব বিদেশি নাগরিক রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া সরকারের ঘোষিত সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্টেম সেল থেরাপি কিংবা প্ল্যাজমথেরাপির কথা বলা হচ্ছে। স্টেম সেল নামক বিশেষ ধরনের কোষ রয়েছে যারা শরীরের প্রতিরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, স্টেম সেলকে মেমোরি সেল হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। আমরা যখন কোনো রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠি পরবর্তী সময়ে যখন ওই একই ধরনের রোগজীবাণু আমাদের শরীরে আক্রমণের চেষ্টা করে স্টেম সেল সেগুলোকে পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ওই সব জীবাণুকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে যেসব ইনস্টিটিউট গবেষণা করেছে তার মধ্যে স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনোলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভাইরোলজির অন্যতম যাদের সমন্বিত গবেষণালব্ধ ফলাফল যা পৃথিবীর অনেক দেশই বর্তমানে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে তাদের প্রস্তুত করা ভ্যাকসিনের নমুনা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন
স্লোভেনিয়াতে বলতে গেলে এখন সবকিছুই স্বাভাবিক। তবে প্রধানমন্ত্রী ইযানেজ ইনশা বারবার বলেছেন যে বাইরের থেকে পরিস্থিতি যতই স্বাভাবিক মনে হোক না কেনও, বাস্তবিক অর্থে সবকিছু তার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। বিশেষত দেশটির অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপের সৃষ্টি হবে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৩ শতাংশ কিন্তু সম্পতি স্লোভেনিয়ার ইনস্টিটিউট অব ম্যাক্রোইকোনোমিক অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দেশটির এ আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে অর্থাৎ দেড় শতাংশে নেমে আসতে পারে। স্লোভেনিয়ান টাইমস পত্রিকার সূত্রে জানা গেছে ইতিমধ্যে দেশটিতে ১১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়েছে তাদের পরিসরকে সংকুচিত করতে। করোনা মহামারির অবসান হলেও স্লোভেনিয়া সরকারের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এ পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কাটিয়ে ওঠা।

ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার মেডিকেল সেন্টারে কাজ করা সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ম্যাটেয়া লোগারের মতে স্লোভেনিয়াতে করোনা মহামারি পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে কিন্তু তাই বলে দেশটি থেকে একেবারে নির্মূল হয়েছে এমনটি নয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সবাই এখনো সুস্থ না হওয়ায় এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো থেকে করোনাভাইরাসের এ মহামারি পরিস্থিতির অবসানের ঘোষণা না পর্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশটির অনেক বিশেষজ্ঞের মতে সেপ্টেম্বরের দিকে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণের হার বেশি থাকে আর তাই এ সময় দ্বিতীয় ধাপে করোনা ভাইরাসের মহামারি সংক্রমণ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা তাই স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য তারা পরামর্শ প্রদান করেছেন।

অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন একটি রাষ্ট্র স্লোভেনিয়া কেননা দেশটি ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়া অথবা পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমনঃ জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে স্লোভেনিয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কোনও রোগীর মৃত্যু ঘটে যখন তার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে বিঘ্ন ঘটে আর এ কারণে তার শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ভ্যান্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সাথে সেকেন্ডারি লেভেলে ব্যাকটেরিয়াঘটিত নিউমোনিয়াল ইনফেকশন জড়িত। জনসংখ্যা অনুপাতে দেশটিতে ভ্যান্টিলেশনও নেই খুব বেশি। বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইতালি—এসব দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে ভ্যান্টিলেশনের সংখ্যা একেবারে নগণ্য।

শুধু সরকারের উদ্যোগ, দেশটির সাধারণ মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের বিপক্ষে দেশটিকে জয়ী করেছে।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া