অচেনা মেলবোর্ন

অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গরাজ্য ভিক্টোরিয়া। রাজধানী মেলবোর্ন। লোকে বলে, স্বপ্ন নগরী। বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। স্বপ্নের ফুলঝুরি নিয়ে ২৪ বছর আগে দুটি ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসতি 

স্থাপন করেছিলাম। চমকে উঠেছিলাম। এ কোন আজব শহরে এলাম, পকেটমার নেই, ছিনতাইকারী নেই, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই, গাড়িতে হর্ন বাজে না, কন্ডাক্টর চড়ে না, ট্রেনে, ট্রামে টিটিই নেই।
মেলবোর্নে রাজনৈতিক দল আছে, মাস্তান নেই, রাজনৈতিক সভা, মিছিল—কিছুই নেই। অথচ দল আছে, মন্ত্রী আছে, প্রধানমন্ত্রী আছে। গার্ড রেজিমেন্ট নেই। নিজের গাড়ি নিজেই চালান। পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দেয় না। লোডশেডিং অভিধানে নেই। অফিস–আদালত কোথাও ঘুষ লাগে না। কে মন্ত্রী, কে সাধারণ আলাদা করা যায় না। মেলবোর্ন খুবই ব্যস্ত মেগাসিটি। কসমোপলিটান। বিদেশিরা আসছে, যাচ্ছে।
চীন, জাপান থেকে আসে অগুনতি পর্যটক দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য। রাতের মেলবোর্ন মোহনীয়। রাতভর ক্যাসিনো, নাইটক্লাব, হোটেল খোলা। ট্রেন, ট্রাম চলে বলতে গেলে সারা রাত। তারাভরা আকাশও নিষ্প্রভ রাতের মেলবোর্নের জৌলুশের কাছে।

আমরা যে আবাসিক এলাকায় থাকি, তার নাম নোবেল পার্ক। নগর কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে।

আমাদের ঘরের সামনে বাসস্টপেজ। নিকটস্থ শপিং সেন্টার মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। নাম পার্কমোর শপিং সেন্টার। হেঁটে, বাসে বা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যায়। আমি একজন সিনিয়র সিটিজেন। আমার জন্য শনি ও রোববার ট্রেন, বাস, ট্রাম ফ্রি। ভাড়া লাগে না। আমরা যখন–তখন চলে যেতাম শপিং সেন্টারে। আমি ও আমার স্ত্রী ফুডকোর্টে বসে কফি লাটে বা ক্যাপাচিনো খেতাম। ভারি সুন্দর শপিং সেন্টার। ঝকঝকে তকতকে টয়লেট। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সর্বক্ষণ টহলরত। হ্যান্ড ওয়াশ, টয়লেট পেপার সর্বদা মজুত। অথচ বিনা মূল্যে। কিছুক্ষণ পরপর সোফা পাতা। ক্লান্ত কাস্টমাররা যাতে বসতে, আরাম করতে পারেন, তার জন্য। বুড়া-বুড়িরা ক্যাফে বসে আড্ডা দেয়, কফি খায়। আবার ঘরে ফিরে যায়। সিনিয়র সিটিজেনদের কফিতে ১০ শতাংশ ছাড়। বৃষ্টিভেজা দিনে অথবা কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইলে চলে যেতাম ড্রাইভ করে পার্কমোর। কয়েক চক্কর দিতাম ডায়াবেটিসের বাধ্যবাধকতার কারণে। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দেখতাম দোকানের পণ্যসম্ভার। ক্লান্ত হয়ে পড়লে সোফায় বসে পানি পান করতাম।

হঠাৎ করে অন্যান্য এলাকার মতো মেলবোর্নেও হানা দিয়েছিল অজানা এক শত্রু। কোভিড–১৯। চোখের পলকে সবকিছু বদলে গেল। প্রধানমন্ত্রী জারি করলেন, জরুরি আইন। লকডাউন। মানুষ ঘরে বন্দী। পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হলো আইন অমান্যকারীদের জরিমানা করার জন্য। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, নাইটক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে—সব তালামারা। শুধু ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চাকরিসংক্রান্ত কাজে ঘর থেকে বের হওয়া যায়। এখানকার মানুষ আইনের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল। তাই চঞ্চল ও চপলা মেলবোর্ন হয়ে গেল নিমেষে নির্জীব। রাতে আর বসে না জুয়ার আড্ডা, মদ, নাচগান—সব বন্ধ। নিকষ আঁধারে তলিয়ে গেল স্বপ্নপুরী। চেনা শহর কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

পার্কমোর শপিং সেন্টারের ফুড কোর্টে তালা। বসার চেয়ার একত্রে রশি দিয়ে দিয়ে বাঁধা। কেউ যাতে বসতে না পারেন। বসার জন্য নির্ধারিত সোফাগুলো লাল টেপ দিয়ে মোড়া। ঘুরাঘুরি বা আড্ডা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধু ঘরে নিয়ে আসার জন্য ম্যাকডোনাল্ডসহ কিছু ক্যাফে খোলা। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে মাঝেমধ্যে গ্রসারি কিনতে যাই। প্রিয় ফুড কোর্ট, ক্যাফের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনটা খারাপ হয়ে যায়। পুলিশের উপস্থিতি ছাড়াই মানুষ নিয়ম মেনে কেনাকাটা করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আইন ভাঙার প্রবণতা নজরে পড়ে না।

মনে মনে ভাবি, আবার কবে সবকিছু আগের মতো হবে, বাঁধনহীন ঘুরে বেড়াব। কফি খাব, আড্ডা দেব। বৃষ্টিতে বা অতিরিক্ত ঠান্ডাতে জগিং করব। কোভিড–১৯ করোনাভাইরাসে সমগ্র ভিক্টোরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ১৫৮০। ১৪৬৫ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছেন, মৃত ১৮ জন। গড়ে দৈনিক ৫ থেকে ৬ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। সুতরাং বলা যায়, প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে।

খুব শিগগিরই হয়তো উঠে যাবে জরুরি শাসন। খুলে যাবে স্কুল–কলেজ, শপিং সেন্টার, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সবকিছু। ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে আবার মুখর হবে স্কুল, কলজে প্রাঙ্গণ, পার্ক। শুরু হবে সবার প্রিয় ফুটি খেলা। আলোর জোয়ারে ভাসবে তিলোত্তমা মেলবোর্ন। শপিং সেন্টারে পুনরায় উপচে পড়া ভিড়। যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা ফিরে পাবেন কাজ। সমুদ্রসৈকত, মসজিদ, গির্জা, ক্যাসিনো, নাইটক্লাবে আবার বসবে মানবমেলা। খুশির সুনামিতে আবার ভাসবে মেলবোর্নের আমুদে জনগণ।

মেলবোর্নের গাছপালার সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেবে নতুন সূর্য। মানুষের জীবননাশক ও পারিবারিক বন্ধন ছিন্নকারী ঘাতক করোনা নেবে চিরবিদায়। ভালোবাসার সম্পর্কগুলো আবার আগের মতো হবে দৃঢ় ও মজবুত। এই আশায় বুক বেঁধে থাকি ঘরে, করোনা তাই দ্রুত সরে যাচ্ছে দূরে।