হোম কোয়ারেন্টিনে কষ্টের ঈদ

ঈদের দিনে ঘোরাঘুরি। ছবি: লেখক
ঈদের দিনে ঘোরাঘুরি। ছবি: লেখক

একটা আশঙ্কা আর ভয়াবহ আতঙ্কের নাম করোনা। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ মানুষ এখনো হোম কোয়ারেন্টিনে। মানুষের মাঝে স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্যের সরব উপস্থিতি এখনো ম্রিয়মাণ। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নাম। স্বজন হারানোর আহাজারি আকাশে–বাতাসে। করোনার এই বৈরী হাওয়া দ্রুত সেরে ওঠার লক্ষণ অতি ক্ষীণ। শত উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মাঝে আবহমান ঈদের খুশি যেন অপূর্ণ থেকে যাবে এবার।

করোনার সংস্পর্শে পাল্টে গেছে মানুষের জীবন। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, সামাজিক আচার–আচরণ, রীতিনীতি। পাল্টে গেছে মানুষ। মানুষে ভাবনা, অবাধ মেলামেশার রেওয়াজ। নিকট আত্মীয় বাবা, মা, ভাইবোনের সঙ্গে ঈদ করতে না পারা অতিকষ্টের। তারপর ও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি দেখা করার একমাত্র ভরসা মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার।

দিনের শুরুতে মেঘলা আকাশে দমকা হাওয়া। বৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সূর্যের দেখা অলীক। তাপমাত্রায় শীত বলা যায়। উইকেন্ড হওয়ায় চারদিকে সুনসান নীরবতা। লকডাউনের অযাচিত নিয়মের কারণে মসজিদে ঈদ জামাত করা হয়নি। জীবনে এই প্রথম ঘরে বসে পড়া হলো ঈদের জামাত। নিজে কখনো জামাতের ইমামতি করিনি। এই অনভিজ্ঞ ইমামতিতে সাহস করে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার পেছনে বউ–ছেলেমেয়ে। অবশ্য ইউটিবের কল্যাণে কয়েকবার কয়েক প্রক্সি দেওয়া হয়েছে। বিচিত্র এই বিধান।

চাঁদনী রাত মোটামুটি জমজমাট হয় এখানে। সরব হয়ে ওঠে ব্রিকলেইনের বাংলা টাউন, হোয়াট সাপেল, গ্রিন স্ট্রিট কিংবা বোরিপাক। রোজায় দেশীয় স্টাইলে কোন দোকানের সামনে কিংবা রাস্তায় পাশে হরেক রকম ইফতারসামগ্রী সাজানো থাকে। ছানা, পেঁয়াজু, বেগুনি। চারদিকে অন্য রকম একটা গন্ধ। যেন পুরান ঢাকার কোনো রাস্তার ব্যস্ততা। কাপড়ের দোকানে প্রচুর ভিড় লক্ষ করা যায়। মেহেদির ডালা নিয়ে বসে এশিয়ান মেয়েরা। ছোট মেয়েরা আলপনায় রাঙিয়ে তোলে ঈদের উচ্ছ্বাস। বলা যায় একটা উৎসব উৎসব ভাব। ভীষণ ভালো লাগে, যখন দেখি ভিন্ন ধর্মের সাদা মানুষগুলো আগ্রহ ভরে উপভোগ করে। এমন একটা দিনের কথা ভাবা যায়নি এবার।

স্মৃতি মানুষকে নিয়ে যায় সুখের দিনগুলোয়। স্পষ্টতই মনে আছে ছোটবেলার কথা। গ্রামের বাড়িতে রোজার চাঁদ দেখার আনন্দ। সারা দিন অপেক্ষা করে থাকতাম কখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়বে, কখন আকাশে ফিকে রং ধরবে। সন্ধ্যা সময় পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে হালদা নদীর পাড়ে চাঁদ দেখতে যেতাম। নীল আকাশটা দূরে বহু দূরে টলটলে জলের সঙ্গে মিশে যেত। ক্লান্ত পাখিরা দলে দলে উড়ে যেত আপন নীড়ে। কোনো এক সময় আকাশের কোণে উদিত হতো ছোট্ট কাছির মতো বাঁকা চাঁদ। আর দেখার সঙ্গে সঙ্গে কী যে আনন্দ, হইহই–রইরই করে বাড়ির দিকে দৌড় দিতাম। পুরো গ্রামে চাঁদের খবর পৌঁছে যেত মুখে মুখে। সত্যিই চাঁদ দেখার এই অনুভূতি বা জৌলুস মিস করছি অনেক। আর ঈদের দিন সকালে সুগন্ধি সাবানে গোসল করা, ইস্তিরি করা সাদা পাজমা–পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি পরে, আতর মেখে ভাইদের সঙ্গে বাবার পিছু পিছু মসজিদে যাওয়া। বাবার দেওয়া নতুন টাকার গন্ধ এখনো মিস করি। ভীষণভাবে মিস করি।

এখানে আমরা স্বভাবত ঈদের দিন এ ঘর–ও ঘর করে ঘুরে বেড়ায় সারা বিকেল। কোলাকুলি, আড্ডা–গল্পগুজব করে মেতে ওঠা। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া। সেমাই, পুডিং, কোরমা, পোলাও খাবার জদ্দা সব খানে, সবার ঘরে। ঈদ মানে উৎসব, আনন্দ, উচ্ছ্বাস। সারা দিন গাড়ি নিয় ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঈদের সমাপ্তি হয় উত্তর লন্ডনের কোনো এক বাঙালি পাড়ায়। কালের যাত্রায় এবারের ঈদ মানে ভিন্ন গল্পের একটা কষ্টের আকাঁ আলপনা। ঈদের আমেজ রসকষহীন ফিকে। চারদিকে এত সবুজ–শ্যামল যেন বিবর্ণ। তারপরও আমরা অতি নিকটাত্মীয় কয়েকজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পাশের খোলা মাঠে, সবুজ ঘাসে মিলিত হই। কিন্তু আগের মতো কাছে আসা, গল্পগুজবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নেই। একটা ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সবার চোখেমুখে। প্রায় তিন মাস পর বাচ্চারা খোলা জায়গায় বের হলো। বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি দেখে বোঝা যায় খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতায়নে শ্বাস নেওয়া কতই আনন্দের। কতই মুক্তির।

শতাব্দীর এই মহামারিতে অজস্র প্রাণ হলো বলিদান। বিবর্ণ এই ঈদে স্বজন হারানো শোকের মাতম শক্তিতে পরিণত হোক। আর যারা জীবনবাজি রেখে মানবসেবায় ব্রত, তারা নমস্য।

একদিন শঙ্কামুক্ত হবে জনপদ। সংকট সংশয় আর শোকের বিবর্ণ রং মুছে যাবে অচিরে। উৎসবে–উচ্ছ্বাসে ভরে উঠবে ঈদের আনন্দ। আগামীর পৃথিবী হোক সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থান। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজে ভালো থাকুন, অন্যকে ভালো থাকতে দিন।
প্রথম আলোর পাঠকদের ঈদ মোবারক।