তুরস্কে কারফিউর মধ্য ঈদ

কারফিউর কারণে সব ফাঁকা। ছবি: লেখক
কারফিউর কারণে সব ফাঁকা। ছবি: লেখক

ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু সে আনন্দ কি সবাই সমানভাবে উপভোগ করতে পারে? ঈদ আনন্দ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, তাই নয় কি? আসলে আনন্দ কিন্তু একটাই। কিন্তু এটা বিভিন্ন রঙে বিভিন্ন মানুষের কাছে আসে। আমার সোনার বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে ঈদ করতে যাওয়া লোকের সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। আবার প্রবাসী অনেকে শুধু স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজের দেশে যান, যদিও তুলনামূলকভাবে সংখ্যাটা কম। আনন্দটা আসলে কিসের? নতুন জামাকাপড়ের? বিদেশে ঈদ করতে পারার? দেশে ফিরে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে পারার? আসলে আনন্দটা একেকজনের কাছে একেক রকম।

এ বছর করোনার কারণে বেশির ভাগ মানুষ যে মনের আনন্দে ঈদ করতে পারছে না, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবারের ঈদ অন্য অনেকের মতো তুরস্ক প্রবাসীদের ঈদও লকডাউনের মধ্যে কেটেছে। এখানে ঈদ হয়ে গেল ২৪ মে, বাংলাদেশের এক দিন আগে। কিন্তু যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো, ২৩ মে সন্ধ্যা থেকে ২৬ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুরস্কে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ থাকায় তুরস্কের স্থানীয় মুসলমানদের মতো আমরা বাঙালি কমিউনিটি ও ঘরোয়াভাবে ঈদ উদযাপন করেছি। জীবনে এমন ঈদও যে আসবে, সেটা কখনো কল্পনাতেও ছিল না।

আসলে ঈদ আনন্দ হলো আপনজনের সঙ্গে ঈদ করতে পারার। ঈদের আনন্দঘন মুহূর্তে ছেলেমেয়েরা যেমন বাবা মা ভাই বোনদের কাছে পেতে চায়, বাবা মাও তেমনি ছেলে মেয়েদের। প্রবাসে আপনজন ছাড়া আছে সবই। আনন্দের এমন কোনো উপকরণ নেই, যা বিদেশে নেই; নেই ট্রাফিক জ্যাম, আছে মনোরম বিনোদন পার্ক, ঈদের তিন দিন ফ্রি সরকারি পরিবহনসহ (তুরস্কে) আধুনিক আনন্দময়ী নানা রসদ। কিন্তু সঙ্গে আছে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ না করতে পারার চাপা বেদনা, যা স্বজনদের সঙ্গে থাকা কাউকে কখনো বোঝানো সম্ভব না। বিদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা নিজ দেশের কমিউনিটিই তখন হয়ে ওঠে স্বজন।

লেখক
লেখক

তুরস্কে প্রতি ঈদেই আনকারাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ঈদ পুনর্মিলনী আয়োজন করে। নিজ দেশের ভাষায় নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার আনন্দে মেতে উঠি সবাই। থাকে ভরপুর বাংলা খাবার। ঈদের গানসহ অন্যান্য দেশীয় গান পরিবেশন হয়ে থাকে অনুষ্ঠানে। আপনজন না হলেও সব বাংলাদেশির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে আনন্দ পাই। সবাই যেন ফিরে পায় দুরে রেখে আসা বাংলাদেশের স্মৃতি।

প্রতিবছর ঈদের তিন দিন তুরস্কে গণপরিবহনগুলোয় বেশ ভিড় লক্ষ করা যায়। জনগণ বেশ আনন্দের সঙ্গে এই তিন দিন পার করে দেয়। বাংলাদেশে সাধারণত ময়দানে ঈদের নামাজ হলেও তুরস্কে ঈদের নামাজ মসজিদে হয়। ঈদের বাজারে আমাদের দেশের মতোই দেখা যায় প্রাণচাঞ্চল্য। যে কথাটি না বললেই নয়, এখানে ঈদ উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে না।

ঈদের আগের দিন কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সব ধরনের বাজারে জনগণের যথেষ্ট ভিড় লক্ষ করা যায় আমাদের দেশের মতোই। তবে ঈদের আগের দিন বেশি ভিড় থাকে মিষ্টির দোকানে। মিষ্টির কথা শুনে রসগোল্লা বা আমাদের দেশের মিষ্টির কথা ভেবে বসেন না আবার। এখানকার মিষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এবং স্বাদের। সাধারণত দোকানে কিংবা মসজিদগুলোয় ঈদের নামাজের পর যে মিষ্টি পরিবেশন করা হয়, তাকে তার্কিশ ভাষায় ‘বাইরাম শেকার’ (বাংলাদেশের চকলেট) বলা হয়। তুরস্কের মিষ্টি ইউরোপে বেশ নামকরা। বাংলাদেশের মতো বাসা–বাড়িগুলোয় বেড়াতে গেলে তুরস্কে পায়েস ধরনের খাবার দেওয়া হয় মেহমানদের। সঙ্গে থাকে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী খাবার।

এ সব বর্ণনা করতে করতে মনে পড়ে গেল তুরস্কে কারফিউ চলছে। ফলে মিষ্টি মিঠাই, খাওয়াদাওয়া যা হচ্ছে সবই ঘরোয়া পরিবেশে। জনমানবহীন সড়কে সৃষ্ট হওয়া ভুতুড়ে পরিবেশ সত্যিই ঈদের সঙ্গে বড্ড বেমানান। কিন্তু করোনার কারণে এটাকেই সৌন্দর্য মেনে নিয়ে হলেও ঘরে কেটেছে আমাদের ঈদ। এবার আর হয়নি বাংলাদেশি কমিউনিটির ঈদ পুনর্মিলনী আয়োজন, বিস্কুটদোড়, বেলুন ফোটানো ইত্যাদি আনন্দময় আয়োজন। জীবনে প্রথম আমরা কারফিউর মধ্যে ঈদ করলাম। ঈদের নামাজও মসজিদে আদায় করা হলো না। কে জানে যদি বেঁচে থাকি বিধাতা হয়তো পরবর্তী ঈদটা আনন্দের সঙ্গে পরিবারসহ করার সুযোগ দেবেন।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, আঙ্কারা ইলদিরিম বেয়াযিত বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক। [email protected]