করোনাকালে কিছু চীনা বন্ধু

এক সপ্তাহ হয়ে গেল ল্যাবে আসতে শুরু করেছি। প্রায় চার মাসের পর ক্যাম্পাসে আসার অনুমতি পেলাম। গত চার মাস বাসায় পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময় টা বলতে পারি সুসময়ই কেটেছে। এতটা সময় আগে কখনো পরিবারকে একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব হইনি। সেজন্য বাচ্চাটাও অনেক খুশি। 

চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের ফুজো শহরের শেষ প্রান্তেই আমাদের বসবাস। ফুজিয়ান এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটিতে আমার পিএইচডির দ্বিতীয় বর্ষ প্রায় শেষ প্রান্তে। সেই সুবাদে পাহাড়ে ঘেরা সুনিবিড় একরকম গ্রাম্য পরিবেশের স্বাদ প্রতিনিয়ত পাই। পরিবার নিয়ে আসার পর খুব আনন্দের সঙ্গেই সময় পার করতাম। নির্দিষ্ট সময় ল্যাবে পার করার পর আমার ইবাইক (ব্যাটারী চালিত মোটর সাইকেল) নিয়ে বের হতাম বিভিন্ন মার্কেট আর অচেনা জায়গায়। এটা ছিল আমাদের নিত্যকার কাজ।

করোনার সতর্কতা জারি হওয়ার পর আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। শুধুই ভাবতাম আর হয়তো জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারব না। মা-বাবাসহ সব আত্মীয় স্বজনেরা বার বার ফোন করে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছিল। খুব কান্না কাটি করতেন মা। দিনে কয়েকবার ভিডিও কলে কথা হতো, সব বুঝিয়ে বলতাম। তারপরেও কাদের থেকে কি শুনে এসে আবার কল করে কান্না করেন। দেশে ফেরার ব্যাপারে আমি কিছুটা সম্মতি দিলেও স্ত্রী কখনো রাজি হইনি। সে অনড়, সে বলত মৃত্যু হলে এখানেই মরব কিন্তু বাচ্চা নিয়ে পথে বেরিয়ে এই দুঃসময়ে আরো ভোগান্তির স্বীকার হতে চাই না। এখন ভাবি আমাদের সিদ্ধান্ত হয়তো ঠিক ছিল। প্রায়ই দুই মাস পেরিয়ে গেল আমরা বাসার বাইরে যাইনি। সবসময় ভাবতাম কবে শান্ত হবে এসব? আবার কি আমরা আগের সেই সময়ে ফিরে যেতে পারব? এখন ফুজো শহর আগের মতোই প্রাণ খুজে পেয়েছে। করোনার ভয়াবহতার সময়ের কিছু কৃতজ্ঞতা চাইনিজদের প্রতি প্রকাশ না করলে সত্যিই অপূর্ণতা থেকে যাবে।

কিছু স্মৃতিচারণ...

১.

একদিন সকালে সুপারভাইজার মেসেজ দিয়ে আমাকে বাসার বাইরে আসতে বললেন। আমি আসতেই উনি আমাকে নিয়ে বাসার গ্রাউন্ড ফ্লোরের সুপার শপে ঢুকতে ঢুকতে বললেন আমাকে কিছু বাজার করে দেবেন। বলে রাখা ভালো চীন সরকারের স্কলারশিপের পাশাপাশি সুপারভাইজার আমাকে মাসিক আরো কিছু অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকেন। করোনাভাইরাসের কারনে ক্যাম্পাসের একাউন্ট সেকশন বন্ধ থাকায় সেটা কিছুদিন বিলম্বিত হওয়ায় উনি ভাবছেন আমি আর্থিক সংকটে আছি। তাই সুপার শপে নিয়ে আমার কি কি লাগবে সেটা জিজ্ঞাসা করছেন বারবার। অনেক অনুরোধ করেও সুপারভাইজারকে বোঝাতে পারিনি যে আমার বাজার লাগবে না। পরে কিছু বাজার করে দিয়ে উনি চলে যান।

একদিন সারাদিন খুব বৃষ্টি। আমরা সবাই দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছি। সুপারভাইজার আমাকে এবং আমার স্ত্রীর উইচ্যাটে অনেকবার মেসেজ দিয়েছেন। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। পরে আমার মোবাইলে কল দিয়ে নিচে নামতে বললেন। উনি গাড়ি নিয়ে এসে গেটে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন। খুব লজ্জা লাগছিল, গিয়ে বললাম আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। উনি মুচকি একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললেন এখানে তোমার বাচ্চার জন্য কিছু কাপড় আছে। আমি বললাম স্যার এগুলো কি জন্য? ওর তো এগুলো অনেক আছে। উনি জোর করে দিয়ে গেলেন। বাসায় নিয়ে দেখলাম অনেক গুলো (১০ টা জামা আর ৬ টা প্যান্ট) কাপড় কিনে দিয়ে গেছেন এবং সবগুলোই ব্র্যান্ডের শপের। ওনার স্ত্রী খুব ভালো মানের একজন সেফ বাসায় হওয়ায় বাসায় বানানো বিভিন্ন রকমের ব্রেড, কেক এগুলো করোনার সময়ে প্রতিনিয়ত আমাদের দিয়েছেন।

প্রতি মাসেই আমার কাছে উনি জানতে চাইতেন আমি বেতন পেয়েছি কি না। আমি বরাবরই বলি হ্যা, আমার সমস্যা নেই। আমি বলি সমস্যা হলে আপনাকে জানাব। গত মাসে এতবার জিজ্ঞাসা করেছেন আমি না লাগার সত্ত্বেও বলেছি হ্যা কিছু টকা দিলে ভালো হয়। সঙ্গে সঙ্গে উনি আমার উইচ্যাটে ২০০০ ইউয়ান (২৫০০০ টাকার মতো) ট্রান্সফার করেছে।

২.

এখানে আসার পরে বেশ কয়েকটা চাইনিজ পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠে। স্বভাবতই চাইনিজরা ইংরেজিতে খুব দুর্বল তাই অনেক চাইনিজ এগিয়ে আসলেও আমরা তাদের ভাষা না বুঝে পিছিয়ে যাই। একদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে পরিচিত হয় এক পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের ও আমাদের অন্তুর (আমার চার বছরের মেয়ে) বয়সী একটা মেয়ে আছে। তাই অন্তুর খেলার ছলে তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। অন্তুর বান্ধবীর নাম জেসিকা। জেসিকার মা ভালোই ইংরেজি বলতে পারেন। সেই সুবাদে জেসিকাও অল্প স্বল্প ইংরেজি বলতে পারে। জেসিকা আর অন্তু এত ভালো বন্ধুতে পরিনত হয়েছে যে তারা একে অপরের কথা শুনলে আর বাসায় থাকতে চায় না। সারাক্ষণ বলে তারা একসঙ্গে খেলতে যাবে। এখন প্রায় প্রতিদিনই তারা দেখা সাক্ষাত করে, খেলা করে। তারা যখন বাসায় থাকে দুইজন উইচ্যাটে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে একে অপরের অনুভুতি প্রকাশ করে।

ওরা আমাদের অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছে। অনেক নতুন নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য আমাদের অফার করে। প্রায়ই বলে তারা এখানে পিকনিক করবে ওখানে বারবিকিউ করবে। কিন্তু প্রথম প্রথম আমরা অতটা রাজি হতাম না। তার দুইটা কারণ ছিল। একটা নাজানি আবার কিসব রান্না বান্না করবে এই ভয়ে। কারণ এরাতো সবকিছুই খায়। আর একটা কারণ, এতটা আপন ভাবছে আমাদের পিছনে কোনো কারণ (আমরা বাঙালিরা যেমনটা ভাবি) নেই তো? প্রথম ভুলটা ভাঙছে খুবই সহজে। কারণ ওনারা ইন্টারনেটে দেখে অনলাইন থেকে মসলা কিনে রেখেছে আমাদের রান্না করে খাওয়াবে বলে। সব মেন্যু স্পাইসি করেই রান্না করেছে। আমরা মাছ পছন্দ করি এটা একদিন কথার ছলে শুনে নিয়ে আমাদের স্টাইলে মাছ কেটে রান্না করেছে। সেদিন ওদের বাসায় গিয়ে সত্যিই ওদের সম্পর্কে অনেক পজেটিভ ধারনা হতে শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্য দ্বিতীয় ভুলটাও ভেঙে যায়। ওনাদের বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। তারা এখানকার আশপাশের ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং একজন ডাক্তার। করোনার ভয়াবহ সময়গুলো তারা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। বারবার তাদের কথা ছিল যেকোন সমস্যা যেন তাদেরকে বলি। তারা আমাদের সাহায্য করবে। একদিন আমার স্ত্রী সামান্য অসুস্থ (গ্যাস্ট্রিকের জন্য হালকা বুকে ব্যথা) বোধ করছিল। আমি ডাক্তার বন্ধুর উইচ্যাটে বলা মাত্র আমাকে বলে এটাতে উদবিঘ্নের কোনো কারণ নেই আর উনি দুইটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন। সন্ধ্যায় উনি গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে এসে ওষুধ দিয়ে গেছেন। আমি কিছুতেই টাকা নেওয়ার জন্য ওনাকে রাজি করাতে পারিনি।

একবার সবাই মিলে আমাদের রেস্তোরায়য় খাওয়ার অফার করেছিল। লজ্জার খাতিরে না করতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম আজ আর রেহায় নেই। আজ হয়ত অক্টোপাস না হলে শামুকের সুপ খাইয়েই ছাড়বে। কেননা আমাদের কাছে না শুনে সেদিন খাবারের অর্ডার করেছিল তারা নিজেই। কিছুক্ষণ পরে যখন ওয়েটার একে একে খাবার দিল সত্যিই আমরা খুব অবাক হলাম। সবগুলো আইটেম ছিল মাছ, ডিম আর সবজির। অনেক মজার, স্পাইসি। ওনারা ঠিকমত খেতে পারিনি স্পাইসির জন্য কিন্তু আমরা পেটপুরে খেয়েছিলাম সেদিন।

আজ চীন প্রায় করোনা মুক্ত। সত্যিই অবাক লাগে যখন ভাবি যে, পৃথিবী কতটা বৈচিত্র্যময়! একটা সময় দেশের সবাই আমাদের নিয়ে চিন্তা করেছে আর এখন সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা অনেকটা নিরাপদ কিন্তু দেশের সবাই কে নিয়ে এখন আমরা অনেক চিন্তিত। সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় প্রার্থনা করি সবকিছুকে আগের জায়গায় নিয়ে এই কঠিন সময় থেকে সকলকে পরিত্রাণ করুন।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, চীন ও

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, ধানমন্ডি, ঢাকা।