শেষ বিকেলের পেন্টাগন

গত বছরের বসন্তকালীন ছুটিতে ওয়াশিংটন ডিসি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ভ্রমণ আকর্ষণ হিসেবে এখানকার মেমোরিয়ালগুলো অন্যতম। জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে ও সম্মানে এই মেমোরিয়ালগুলো বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। 

ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণের শেষ দিনের বিকেলে আমরা পেন্টাগনের উদ্দেশে মেট্রোয় উঠলাম। পেন্টাগন ডিসি থেকে দূরে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। ডিসির ইউনিয়ন স্টেশন থেকে পেন্টাগন প্রায় ৪৫ মিনিটের মেট্রোপথ। সময়টা তখন বসন্তকাল হলেও শীত কিন্তু পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। ছোট্ট বিকাল শেষে দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসে আর সঙ্গে থাকে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া।
মেট্রো স্টেশনের ঠিক বাইরেই সেই বিশালায়তন পাঁচতলা পেন্টাগন বিল্ডিং, যা মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর। সামনে থেকে দেখে এর পঞ্চভুজ আকৃতি বোঝার উপায় নেই; সেটা শুধুওপর থেকে দেখলেই বোঝা যায়। পেন্টাগনের ছবি তোলা নিষেধ তাই বিল্ডিং পার করে আমরা মেমোরিয়ালের দিকে হেঁটে চললাম।

পেন্টাগন মেমোরিয়াল আমাদের দেখা অন্য মেমোরিয়ালগুলোর চেয়ে অনেক আলাদা ছিল। অন্য মেমোরিয়ালের মতো এটায় সুউচ্চ স্তম্ভ বা ভাস্কর্য নেই, বরং রয়েছে সারি সারি বেঞ্চ, যার নিচে মৃদু আলোকিত জলধারা নিরন্তর বয়ে চলেছে। প্রতিটা বেঞ্চে মৃতদের নাম লেখা রয়েছে। ২০০১–এর সেপ্টেম্বরে পেন্টাগনে বিমান হামলায় নিহত ১৮৪ জনের স্মরণে এই মেমোরিয়াল তৈরি করা হয় এবং পরে ২০০৮–এর ১১ সেপ্টেম্বর তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তিদের বয়সের ক্রমানুসারে বেঞ্চগুলোকে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে ছোটজন তিন বছরের এক শিশু আর সারির শেষের বেঞ্চে মৃতজনের বয়স ছিল ৭১ বছর।
বেঞ্চগুলোর মাঝে রয়েছে ক্রেপ মার্টল গাছ, যা এর উজ্জ্বল রঙের ফুলের জন্য অনন্য। কিছুক্ষণ এখানে থাকলে শুধু বয়ে যাওয়া জলের শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। খুব নীরব আর শান্ত কিন্তু মন খারাপ করে দেওয়া একটা জায়গা। আমি জানি না অন্যদের কী অনুভূতি হয়। তবে পেন্টাগন মেমোরিয়ালে যতক্ষণ ছিলাম, মনটা বিষাদে ভরে ছিল। এমনকি আমার ছোট্ট মেয়েটা যে সারাক্ষণ কথা বলতেই থাকে, সেও খুব চুপ করে ছিল। পুরো পেন্টাগন এলাকায় শুধু এই মেমোরিয়ালের ছবি তোলার অনুমতি রয়েছে। দিনের আলো ম্রিয়মাণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়ার তীব্রতাও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা নামার আগে আমরা মেট্রোর উদ্দেশে রওনা হই। মানুষ হিসেবে এখনো একটাই চাওয়া, একজন মানুষ যেন আরেকজন মানুষের মৃত্যুর কারণ না হয়।

*লেখক: শিক্ষার্থী, দ্য ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা, ইউএসএ